ভদ্রমহিলার সঙ্গে চায়ের দোকানে এক রবিবারের শেষ দুপুরে আলাপ হল। মুকুটমণিপুর বেড়িয়ে ফিরছেন। রাতটুকু শহরের হোটেলে কাটিয়ে সকালে গড় পঞ্চকোট যাবেন। দু’দিন পরে বিষ্ণুপুর ঘুরে কলকাতা ফিরবেন। বসন্তে পলাশের জেলায় বেড়াতে এসেছেন।
ভদ্রমহিলার সামনের টেবিলে চায়ের কাপ, হাতে স্মার্টফোন, তাতে ব্রিগেড লাইভ। আফসোস করলেন, মুকুটমণিপুরে টাওয়ারের সমস্যা হচ্ছিল বলে ব্রিগেডের শুরুটা শুনতে পাননি। “জমায়েতটা দেখছেন! ব্রিগেড পুরো লালে লাল!” তাঁর মুখে উচ্ছ্বাস ও উত্তেজনার যুগপৎ বিচ্ছুরণ। বলতে ইচ্ছে হল, পুরো লাল নয় ম্যাডাম, কংগ্রেসের তেরঙাও আছে, আর এক নেতার অনুগামীরাও সংখ্যায় প্রচুর। বললাম না। বেশির ভাগ কথা উনিই বলছিলেন।
“জানেন, আমরা তিন প্রজন্মের বামপন্থী! আমার বাবা, এক কাকা আর এক মামা ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। আমি কলেজে ছাত্র ফেডারেশন ইউনিয়নের কালচারাল সেক্রেটারি ছিলাম। বিয়ের পর বাইরে বাইরে থেকেছি, সক্রিয় ভাবে তেমন কিছু করতে পারিনি। তবে আমার ছেলে ডাক্তার, সরকারি চাকরি করছে আবার পার্টিটাও করছে।”
কথার মাঝে তাঁর একটি ফোন এল। যেটুকু বুঝলাম, আজাদগড়ে তাঁদের একটি ফ্ল্যাট আছে, সেটি ভাড়া দিতে চান। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি সম্ভবত কোনও ভাড়াটের খবর জানাতে ফোনটা করেছিলেন।
“কী করেন উনি, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার? কী নাম বললেন ভদ্রলোকের? না অনিলবাবু, না না। মানে কিছু মনে করবেন না, আমি কোনও মুসলমান ভাড়াটে রাখতে চাইছি না। আপনি অন্য কোনও ভাড়াটের খবর পেলে জানাবেন।”
ব্রিগেডে তখন সেলিমের হাত ধরে সিদ্দিকি মঞ্চে উঠছেন। চা খাওয়া শেষ করে আমিও বেরিয়ে পড়লাম দোকান থেকে। কানে বাজছিল পড়ন্ত দুপুরে ভরন্ত ব্রিগেড নিয়ে আপ্লুত সেই ‘তিন প্রজন্মের বামপন্থী’ ভদ্রমহিলার কথা, যিনি কোনও মুসলমানকে ফ্ল্যাট ভাড়া দেবেন না।
যশোবন্ত্ বসু
প্রতাপবাগান, বাঁকুড়া
আত্মমর্যাদা
কেনাকাটা শেষ। রাস্তা পেরোব, রাজনৈতিক দলের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আসছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। হুডখোলা গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে ভোটপ্রার্থিনী, চলচ্চিত্রের পরিচিত মুখ, জনগণকে নমস্কার করতে করতে এগোচ্ছেন। কেন জানি না, তাঁর চোখ পড়ল আমার দিকে। হাত নেড়ে ডাকলেন। অন্য দিকে চোখ ফেরালাম। তখন দলের একটি ছেলে এসে বলল, “ম্যাডাম ডাকছেন আপনাকে।” শান্ত স্বরে বলতে হল, দরকারটা ওঁর কাছে আমার নয়, আমার কাছে ওঁর। ওঁকে আসতে বলো।” ছেলেটি, এবং আশপাশে যারা ছিল, সবাই স্তম্ভিত। সিনেমার নায়িকা ডাকছেন এক নগণ্যাকে, আর সে পাত্তাই দিল না! এই আত্মমর্যাদা বজায় রাখা খুব দরকার।
ঐশী কর
কলকাতা-৮৪
জীবন্মৃত
সম্প্রতি পাভলভ মানসিক হাসপাতালে এক যুবকের অসহায় মৃত্যুতে হৃদয়হীনতার যে চিত্র উঠে এল (‘না-মানুষ’, সম্পাদকীয়, ১৯-৩) তাতে ‘একটি প্রাণ এ ভাবে চলে গেল কেন?’ প্রশ্নটিকে ছাপিয়ে উঠে আসে, ‘আরও অনেক প্রাণ কেন বেঘোরে চলে যায় না?’— এই প্রশ্নটি। অনুরূপ দুর্ভাগ্যজনক দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আবাসিক বিদ্যালয়, ও তথাকথিত ‘নেশামুক্তি’ কেন্দ্রগুলিতেও। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, উচ্চহারে মাসিক অর্থমূল্য দিয়ে অসহায় বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের এই সকল স্থানে রেখে আসেন। প্রথম দিকের যত্নআত্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ হতে থাকে। ওষুধ প্রয়োগে হিংস্র মনোভাব, কাউন্সেলিং-এর অভাব, সর্বোপরি স্নেহ-ভালবাসাহীন, অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এই সমস্ত আবাসিক ‘না-মানুষ’দের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এক দিকে কর্তৃপক্ষের চোখরাঙানি ও কঠোর নির্দেশ, অপর দিকে স্বাভাবিক জীবনের হাতছানি ও প্রত্যাশা— এই দোলাচলে এদের মনের অবস্থা কী রকম হয়, তা আমাদের কল্পনার অতীত।
আক্ষরিক অর্থেই জীবন্মৃত হয়ে, অপ্রশস্ত আলো-বাতাসহীন চৌখুপিতে এঁরা দিনাতিপাত করতে বাধ্য হন। নিয়মিত বিধিপালনের বিষয়টিও অনুপস্থিত থাকে। উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ ছাড়া চলা এই সব কেন্দ্রে রোগীদের অবহেলা ও উৎপীড়নের কাহিনি মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে জায়গা করে নিলেও প্রশাসনের সার্বিক নজরদারির অভাবে এমন ব্যবসা চলতেই থাকে।
সুপ্রতিম প্রামাণিক
আমোদপুর, বীরভূম
সম্প্রীতির ঊর্ধ্বে
অন্বেষা সরকারের ‘গাজির মেলায় হরির লুট’ (২৫-৩) নিবন্ধটি সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। তবে, ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের গ্রামীণ মেলা, তথা উৎসব আজও পরম্পরাগত ভাবে চলে আসছে। হয়তো সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার প্রসার, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি, মেহনতি মানুষের পেশা পরিবর্তন আর রাজনীতির অনধিকার প্রবেশের ফলে পার্বণগুলি কিছুটা লাবণ্য হারিয়েছে। তবুও পুরনো ঐতিহ্য ও প্রাসঙ্গিকতাকে ছাপিয়ে যায়নি।
বর্তমানে এই উৎসবগুলোর প্রচারে মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও, এগুলির মূল সুর এই সম্প্রীতিরও অনেক ঊর্ধ্বে। কারণ, মেহনতি মানুষ তথাকথিত ধর্মের থেকেও পেটের দায় নিয়ে, এবং যে শরীর তাঁদের একমাত্র পুঁজি, তার সুস্থতা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করেন। তাই অনুষ্ঠানগুলি আজও প্রকৃত অর্থে মানবতার মিলন মেলা হিসেবে বেঁচে আছে, যার মূল ভিত্তি সম্ভবত সরল বিশ্বাস।
অরিন্দম ঘোষাল
আরামবাগ, হুগলি
ভাষাসন্ত্রাস
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ ফরমান জারি করেছে, অফিসের বিভিন্ন কাজে হিন্দি ভাষা ব্যবহার করতে হবে। এই খবর (‘হিন্দি ব্যবহারের নির্দেশে বিতর্ক’, ২৪-৩ ) অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছি। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, ছাত্র, গবেষক শিক্ষাকর্মীদের প্রায় ৯০ শতাংশই বাঙালি, সেখানে হিন্দি চাপানোর চেষ্টা অত্যন্ত অন্যায়। একদা উর্দু ভাষাকে জোর করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল।
জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া ভাষাসন্ত্রাসের নামান্তর। এ রাজ্যে সরকারি কাজকর্মে সর্বত্র এখনও বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রচলিত হয়নি। তার উপর সরকারি নির্দেশনামা জারি করে বাঙালিদের হিন্দি ভাষায় সরকারি কাজকর্ম পরিচালনার নির্দেশ এক প্রকার অত্যাচার।
পরেশনাথ কর্মকার
রানাঘাট, নদিয়া
বিষ প্লাস্টিক
‘এক কাপ চায়ে’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২৫-৩) পত্রে লেখক প্লাস্টিক-কোটেড কাপের বিষক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে যাঁরা কিছু পড়াশোনা করেন তাঁরা জানেন, আপাত-অদৃশ্য ‘হাইড্রোফোবিক ফিল্ম’ তথা প্লাস্টিকের আস্তরণ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার বিষক্রিয়ার কথা। তবে হয়তো এই সব বিষয়ে টনক নড়ে না তাঁদের, যাঁরা উচিত-অনুচিত নির্ধারণ করার জন্য দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। এই ধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার অবিলম্বে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা দরকার। আর দরকার মাটির ভাঁড় নির্মাতাদের জন্য কারিগরি পদ্ধতির সরলীকরণ, যার ফলে চা বিক্রেতা ও ভাঁড় বিক্রেতা, উভয় পেশার মানুষই স্বচ্ছন্দে উপার্জনের পথ খুঁজে পাবেন।
প্রদীপ রঞ্জন দাস
কলকাতা-১৫৭