অম্লান বিষ্ণু-র লেখা ‘স্কুল বন্ধ, রাষ্ট্র নিশ্চল, সমাজ?’ শীর্ষক প্রবন্ধ (২৬-৭) প্রসঙ্গে কিছু কথা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য সমাজের কিছু মানুষ উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অনেকেই হয়তো কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের ভ্যাকসিন দিতে পারা যায়নি। কারণ, তাদের উপযুক্ত ভ্যাকসিন এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যে এর পরীক্ষা শেষ হবে এবং বাজারে এসে যাবে। এ অবস্থায়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়তো সম্ভব। কিন্তু স্কুলের ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের ভ্যাকসিন প্রদানের পরেই খোলা উচিত নয় কি? শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই চাইছেন, এ বার ধীরে ধীরে স্কুলগুলোতে অনলাইন ক্লাস বন্ধ করে অফলাইন ক্লাস শুরু করা হোক। করোনা পরিস্থিতির জন্য প্রায় দেড় বছর ধরে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হয়েও স্কুলের অনলাইন ক্লাস চালানো হচ্ছে। আরও যদি কয়েক মাস অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে পঠনপাঠন চালানো হয়ে থাকে, তবে পড়ুয়াদেরই উপকার হবে। হ্যাঁ, হয়তো এতে তাদের পড়াশোনার আরও কিছুটা ক্ষতি হবে। কিন্তু স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়া হলেও পড়ুয়াদের না হওয়ায় ভ্যাকসিন না-পাওয়া শিক্ষক বা শিক্ষাকর্মীদের থেকে তাদের সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অনেক অভিভাবকই তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাইবেন না। পড়ুয়ারা স্কুলে গিয়ে যদি সংক্রমিত হয়, তার দায় যাঁরা স্কুল খোলার দাবি করছেন, তাঁরা নেবেন কি? সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, পড়ুয়াদের সুরক্ষা আগে নিশ্চিত করে তবেই স্কুলের অফলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হোক।
ঋতুপর্ণা ভট্টাচার্য, চুঁচুড়া, হুগলি
নাগরিক দায়িত্ব
‘স্কুল বন্ধ, রাষ্ট্র নিশ্চল, সমাজ?’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে করোনাকালে চূড়ান্ত অবহেলিত শিক্ষাব্যবস্থার ছবি যথার্থই তুলে ধরা হয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে আঘাতের তীব্রতা যে কতখানি, রাষ্ট্র বা সমাজ কেউই তার কোনও তল খোঁজার চেষ্টা করছে না। বরং শিক্ষকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন না দিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজে লাগানো হোক— এ জাতীয় রসালো আলোচনায় সমাজের একটি বড় অংশ মশগুল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠন বন্ধ থাকায় আমার নিজের দুই সন্তানের মনে সীমাহীন হতাশা ও যন্ত্রণা জমা হয়েছে। এক জন শিক্ষক-পিতা হিসেবে অনুভব করতে পারি, এই মানসিক আঘাত শুধুমাত্র অনলাইন পঠনপাঠনের মাধ্যমে দূর করা যাবে না। তা ছাড়া গ্রামীণ এলাকার স্কুলগুলোতে অনলাইন পঠনপাঠনে হাজিরা বেশ হতাশাজনক। এ ছাড়া আর্থিক অনটনের জন্য স্মার্টফোনের অপ্রতুলতা, খারাপ ইন্টারনেট সার্ভিস, বা পরিবারের খরচ চালানোর জন্য শিক্ষার্থীদের কাজে লেগে পড়ার ঘটনা অনলাইন পঠনপাঠনের হতশ্রী অবস্থাকেই জনসমক্ষে তুলে ধরে।
এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের গা-ছাড়া ভাব, শিক্ষকদের একটা বড় অংশের মধ্যে স্কুল বন্ধ তো কী হয়েছে— জাতীয় মনোভাব ও বৃহত্তর সমাজে শ্রেণিশত্রু হিসেবে শিক্ষকমহলকে তুলে ধরা, এ সমস্ত ঘটনা শিশুমনের হদিস পেতে কোনও সাহায্য করে না।
দেড় বছর যথেষ্ট সময়। বিদ্যালয় ভবনে পঠনপাঠন পুনরায় চালু করার কোনও পরিকল্পনা বা লক্ষণ, কিছুই এখনও স্পষ্ট নয়। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বহু পরিবারের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই পড়াশোনার জীবন অতীত। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বিষয়ে, বা শিক্ষকদের বেতন কেন বন্ধ হবে না— জাতীয় মন্তব্য না করে সচেতন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষক সমিতিগুলি কী ভাবে কার্যকর অফলাইন ক্লাস নেওয়া যেতে পারে, তার খসড়া প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিক। অন্তত সিলেবাসভিত্তিক হোম অ্যাসাইনমেন্ট-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাড়ি বসে প্রস্তুতি নিক। রাষ্ট্রেরও বোঝা উচিত ভবিষ্যতের নাগরিকদের মানসিক স্থবিরতা কখনও উন্নতির সূচককে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। কাজেই প্রবন্ধকারের সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায়, শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘ট্রোলিং’ নয়, বরং নাগরিক সমাজ এগিয়ে আসুক শিশুমনের হদিস পেতে, তাদের কাউন্সেলিংয়ের কাজে।
তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
স্কুল খুলুক
গত দেড় বছর শিক্ষা নিয়ে সরকার আশ্চর্য রকম উদাসীন! স্কুল খোলার কোনও উদ্যোগই নেই। অথচ, নির্বাচন করানো নিয়ে যথেষ্ট তৎপরতা রয়েছে। গণতন্ত্রের পক্ষে নির্বাচন যতটা জরুরি, উন্নত সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষাও ঠিক ততটাই প্রয়োজনীয়। তা ছাড়া, বিনামূল্যে শিক্ষা প্রত্যেকের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার। সরকারের উদাসীনতায় লক্ষাধিক পড়ুয়া আজ সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁক গলে বহু শিক্ষার্থী আজ গার্হস্থ হিংসার শিকার। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়েছে রাজমিস্ত্রির জোগানদার, কারখানার শ্রমিক, বা ফেরিওয়ালার জীবন বেছে নিতে। পরিবারের চাপে ছাত্রীদের অনেকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। বন্ধ স্কুল, বদ্ধ জীবন— এই দুইয়ের দ্যোতনায় তাদের শৈশব-কৈশোর আজ ক্ষত-বিক্ষত, বিপন্ন। মানসিক ভাবে স্কুল পড়ুয়ারা বিপর্যস্ত। অন্য দিকে নাবালিকা-বিবাহ ডেকে আনছে অকাল মাতৃত্ব। অপরিণত বয়সের মা জন্ম দেয় অপুষ্টিজর্জর অপরিণত শিশু, যা ভবিষ্যতে এক দুর্বল সমাজেরই ইঙ্গিত দেয়! স্কুল বন্ধের এমন গভীর অভিঘাত বুঝতে চাইছে না সরকার, বা বুঝেও নির্বিকার থাকছে। তাই সংক্রমণ কমানোর প্রয়োজনে প্রথমে বন্ধ হচ্ছে স্কুল, আর সংক্রমণ কমে গেলেও বন্ধ স্কুল খোলা হচ্ছে না। পুরোপুরি ভাবে করোনা থেকে কবে মুক্তি মিলবে, তা অজানা। তবে অনতিবিলম্বে বিশেষ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকারের স্কুল খোলার উদ্যোগ করা প্রয়োজন।
শুভ্রা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
সর্বনাশা ‘গেম’
ইদানীং সর্বত্র দেখা যায় কিশোর বয়সের ছেলেরা মোবাইল-গেম-এ বুঁদ হয়ে আছে— কখনও একক ভাবে, কখনও বা দল বেঁধে। গেম খেলা চলে সকাল-বিকেল, দিনে-রাতে। যে বয়সে হাতে হাতে মোবাইল থাকার কথা নয়, এক অতিমারি তাদের অপ্রত্যাশিত সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রায় দেড় বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ। অনলাইন ক্লাসের জন্য বেড়েছে মোবাইলের ব্যবহার, সঙ্গে গেম খেলার প্রবণতা। এই সর্বনাশা গেম যেমন কেড়ে নিয়েছে বই পড়ার অভ্যেস, তেমনই বাড়িয়ে তুলছে মানসিক অস্থিরতা। সপ্তাহখানেক আগে মোবাইলে গেম খেলা নিয়ে দাদা ও মা আপত্তি করায় তাঁদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপান বছর একুশের যুবক চন্দ্রকান্ত মণ্ডল। পরে নিজেও বিষ খান তিনি। চণ্ডীপুরের ওই ঘটনার পর প্রায় একই ছবি দেখা গেল মেদিনীপুরের বেলদা থানার চরাই গ্রামে। গেম খেলার জন্য মোবাইল ফোন কিনে না দেওয়ায় আত্মহত্যা করে আকাশ সাউ নামের কিশোর। সপ্তম শ্রেণির এই পড়ুয়া লকডাউনে বাড়ি থাকার কারণে পাড়ার বন্ধুদের মোবাইলে মাঝে মধ্যে গেম খেলত। কিন্তু সব সময় বন্ধুদের মোবাইলে খেলার সুযোগ পেত না, তাই বাড়িতে স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করত। ঘটনার দিন বন্ধুদের মোবাইলে গেম খেলে বাড়ি ফিরে ফোন কিনে দেওয়ার জন্য মা-কে জোরাজুরি করে। বাবা বকাবকি করার পরেই কীটনাশক খায় সে। হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে তার।
এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে দেয়, সর্বনাশা অনলাইন গেম শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের পড়শোনার ক্ষতি করছে না, কেড়ে নিচ্ছে অনেক অমূল্য প্রাণও। তাই মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি দূর করতে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন।
মঙ্গল কুমার দাস, রায়দিঘি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা