Religion

সম্পাদক সমীপেষু: ধর্ম থাকবে অন্তরে

মন্দির হোক বা মসজিদ-গির্জা, তা যেন পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি না করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যাতে নষ্ট না হয়, তা দেখা কর্তব্য শাসক দল তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৪:১৪
Share:

অযোধ্যার রামমন্দির। —ফাইল চিত্র।

সম্পাদকীয় ‘রাজসূয় পর্বের পরে’ (২৩-১)-তে যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসাবে অযোধ্যায় যে সমারোহ বা প্রদর্শনী সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হল, তা কতটা ধর্মীয়, কতটা রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন হিসাবে আমজনতার দরবারে পৌঁছল, তা ভাবার বিষয়। ধর্মাচরণ থাকবে অন্তরে, যা সুস্থ আচার বা সংস্কৃতির পরিচায়ক হবে। ধর্ম একটি বিশ্বাস, যা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। মহাকাব্য রামায়ণের চরিত্র নিয়ে যে উৎসাহ উদ্দীপনা সামনে এসেছে, তা যে কোনও সম্প্রদায়ের কাছে গর্বের বস্তু, তাদের নিজস্ব অস্মিতার পরাকাষ্ঠা হতে পারে। তবে ধর্মের মূল কথা ত্যাগ, দুঃখ সহ্য করার সাহস, তা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, যখন তাঁর ‘গান্ধারীর আবেদন’ কাব্যে গান্ধারী তাঁর স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন, ধর্মকে রক্ষা করতে হলে প্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে হবে। ধর্ম নতুন নতুন
দুঃখই দেয়।

Advertisement

মন্দির হোক বা মসজিদ-গির্জা, তা যেন পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি না করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান যাতে নষ্ট না হয়, তা দেখা কর্তব্য শাসক দল তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের। রামমন্দির স্থাপন বা রামলালার মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা এমন ভাবে করা হল, তা যেন দেশবাসীর কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থের যৌথশক্তির অতিকায় জাতীয় প্রকল্প। ভক্তরা আপ্লুত হবেন, আরাধ্য চরিত্র বা দেবতাকে নিয়ে উৎসব করবেন, আনন্দে মশগুল থাকবেন বেশ কয়েক দিন ধরে, স্বাভাবিক। তবে ব্যাখ্যা এ-ও শোনা যায়, ধর্মের নামে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের সুকৌশল ছিল এটা। দেশ জুড়ে মন্দির মসজিদের কমতি নেই, ঐশ্বর্য-বৈভবে বিভিন্ন প্রদেশের মন্দিরগুলো জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও, ধর্মের দিকে জনগণকে আকর্ষণ না করে কর্মের পথে মাততে দিলে জাতীয় উৎপাদনশীলতা বাড়ত, ফলে অর্থনৈতিক সুঠাম অবস্থার সাক্ষী থাকত দেশের কোটি কোটি শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার কর্মহীন যুবক-যুবতী। সামাজিক অস্থিরতা কমত, মন ও মননে সুস্থতার লক্ষণ ফুটে উঠত। মন্দিরগুলো থেকে যে বিপুল অর্থ আয় হয়, তা কতটা দেশগড়ার কাজে লাগে?

এখন দেখার এ দেশের নিরিখে কোনটা বেশি জরুরি, জাত না ভাত, মন্দির না মসজিদ, ধর্ম না কর্ম!

Advertisement

সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪

রাষ্ট্রের ভূমিকা

সনাতন ধর্মীয় রীতি মেনে রামমন্দিরে রামলালার ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ হচ্ছে না বলে শঙ্করাচার্যদের সুরে সরব হয়েছিল রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার অন্যতম মামলাকারী ‘নির্মোহী আখড়া’ও। শঙ্করাচার্য বলে পরিচিত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মগুরুদের মূল অভিযোগ ছিল, মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ না করে মন্দির উদ্বোধন বা ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ শাস্ত্রসম্মত নয়, এবং এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তির হাতে মন্দির উদ্বোধন অনুচিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চার জন শঙ্করাচার্য তাঁদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পুরীর শঙ্করাচার্য স্বামী নিশ্চলানন্দ সরস্বতী বলেছিলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নিজের সীমার মধ্যে কাজ করা উচিত। সংবিধানসম্মত বিধি-নিষেধ পালন করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব।এই বিধিকে উপেক্ষা করে নিজের প্রচারের চেষ্টা করা উচিত নয়।” (“‘রামের নামে যা হচ্ছে উন্মাদের লক্ষণ’, সরব পুরীর শঙ্করাচার্য”, ১৪-১)। তাঁর মতে, এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। উত্তরাখণ্ডের জ্যোতিষপীঠের শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী। তাঁর বক্তব্য, মন্দির উদ্বোধনে কোনও পরম্পরাও অনুসরণ করা হচ্ছে না। ভারতে রাজনৈতিক নেতা এবং ধর্মীয় নেতারা ছিলেন পৃথক। কিন্তু এখন রাজনৈতিক নেতারাই ধর্মীয় নেতা হয়ে যাচ্ছেন। এটা ভারতের ঐতিহ্যবিরোধী এবং রাজনৈতিক লাভের জন্যই তা করা হচ্ছে। (দ্য টেলিগ্রাফ, ১৩-১)।

এ প্রসঙ্গে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করব। নিষ্ঠাবান হিন্দু মাধব গোডবোলে-র নাম আমরা অনেকেই শুনেছি। উনি ছিলেন এক সময়কার কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব। পরে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৩ দিন পর কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাঁকে অযোধ্যা যেতে হয়েছিল। মসজিদ ভাঙার পর রামলালা দর্শনের ব্যবস্থাপনার অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে তাঁর এই অযোধ্যা সফর। অবসরের পর তাঁর লেখা বই আনফিনিশড ইনিংস-এ তিনি লিখেছিলেন, সে দিন রামলালা দর্শন করার ইচ্ছা তিনি অনুভব করেননি। ধর্মবিশ্বাসী মানুষ হয়েও সে দিন অযোধ্যায় কোনও টান অনুভব করেননি। মন থেকে অনুভব করেছিলেন যে, শঠতা, প্রতারণা আর ভয়াবহ হিংসার জোরে তৈরি মন্দিরে তাঁর দেবতা বাস করতে পারেন না। এ হল ইতিহাসনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষদের ‘মন কি বাত’। সেই ভাবনাকে এড়িয়ে তাই পরে মন্দির স্থাপনায় বদ্ধপরিকরদের আদালতের উপর ভরসা করতে হয়েছিল।

যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্ম হওয়া উচিত মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। যিনি যে ধর্মে বিশ্বাস করেন, সেই অনুযায়ী আচরণ করাও তাঁর অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেটা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা দেখা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কর্তব্য। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিশেষ কোনও ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে না। অথচ, এখানে দেখছি বিশেষ একটি ধর্মের হয়ে কোমর বেঁধে খোলাখুলি মাঠে নেমে পড়েছেন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা। স্বাভাবিক ভাবেই, ধর্মীয় নেতা থেকে শুরু করে সমাজের বিশিষ্ট ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের অনেকেই এই অদ্ভুত ঘটনা মানতে পারছেন না।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

বিরোধীর সঙ্কট

রামমন্দির নির্মাণ শুধুমাত্র ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বেই যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের প্রতিটি কোণ থেকে হিন্দু সমাগম যেমন হয়েছে, তেমনই অন্য ধর্মের ব্যক্তিরাও যোগ দিয়েছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে এই রামমন্দির নির্মাণ উত্তেজনার পারদ বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ এ বছরই লোকসভা নির্বাচন। সংখ্যালঘু তথা মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোটের দিকে চেয়ে অধিকাংশ আঞ্চলিক দল পড়েছে বিড়ম্বনায়। রাজনীতির দোহাই দিয়ে উদ্বোধন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরিরা। অথচ, তাঁদের এই সরে দাঁড়ানোটাও রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। শরদ পওয়ার উদ্বোধনে না গেলেও জানিয়েছেন, মন্দির সম্পূর্ণ হলে তিনি মন্দির দর্শনে যাবেন। অর্থাৎ,তিনি দু’দিক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না গেলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর মন্দির স্থাপনাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষয় আসছে কী ভাবে?

বাবরি মসজিদ না রামমন্দির, এ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। অনেক তথ্যপ্রমাণ, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে অবলম্বন করে রামমন্দিরের পক্ষে রায় দিয়েছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। অথচ, এখনও রামমন্দিরের বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে চলেছেন কিছু রাজনীতিবিদ, যা সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধাচরণ। রামমন্দির নির্মাণ বিজেপির কৌশল হলেও একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া নয়। সকলেই জানে যে, হিন্দুত্বকে বাঁচিয়ে রাখা বিজেপির অন্যতম উদ্দেশ্য। সুতরাং রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে বিজেপির এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক।

বিদেশে কোথাও গীতাকে সিলেবাসে পাঠ্য করা হয়েছে, কোথাও রামসীতাকে মুদ্রাতে স্থান দেওয়া হয়েছে, কোথাও বা রামায়ণ মহাভারতকে জাতীয় গ্রন্থ করা হয়েছে। কোথাও হিন্দু দেবদেবীকে ভাস্কর্য হিসাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। তা হলে ভারতে এত আপত্তি কেন? যে কোনও ধর্মস্থানে প্রচুর আর্থিক লেনদেন হয়। তাই অযোধ্যা তথা উত্তরপ্রদেশের অর্থনৈতিক ভোল বদলে দেবে এই রামমন্দির। এলাকা জুড়ে মানুষের শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের পথে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচিত হবে। প্রমাণিত হবে ধর্ম এবং অর্থনীতির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।

বরুণ মণ্ডল, রানাঘাট, নদিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement