সাধারণ মানুষের সম্পত্তি রক্ষার্থে হাতি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। ফাইল ছবি।
হাতির হানায় মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই (দফতরেই চাকরি হাতির হানায় মৃতের পরিজনকে, ১০-২)। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, চাকরির পরীক্ষা না দিয়ে, শুধুমাত্র অনুকম্পাজনিত কারণে যদি চাকরি হয়, তবে শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীরা কী করবেন? পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়া মুখের কথা নয়। হাতির হানায় মৃত্যু বন্ধ হবে কী করে, সে প্রশ্নটাও করা দরকার। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান থেকে হাতি কোনও দিন যাবে না। তাদের তাড়িয়ে এ-বনে ও-বনে রাখা হবে, চলবে উৎপীড়ন। হাতিরা আজ বড্ড অসহায়। এ-জঙ্গল ও-জঙ্গলে দৌড়তে গিয়ে শাবকেরা মারা যাচ্ছে, বা দলছুট হচ্ছে।
বনবিভাগও খাল কাটছে, ইলেকট্রিক ফেন্সিং দিচ্ছে। অগত্যা হাতির পাল কৃষকের জমির উপর দিয়ে যাতায়াত করছে। জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। মাটি বা টিনের ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে। পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা ও বাঘমুণ্ডির অর্থনীতি নির্ভরশীল পর্যটনের উপর। অথচ, এই সব এলাকায় বুনো হাতির উৎপাত বছরভর। বাঁকুড়া জেলার অবস্থা আরও ভয়াবহ, ২০২৩ পড়তে না পড়তেই এ পর্যন্ত অন্তত চার জন হাতির হানায় প্রাণ হারিয়েছেন— ১০ জানুয়ারি বড়জোড়ার মঙ্গল বাউরি এবং ঝরিয়ার তুলসী বটব্যাল, ১৮ জানুয়ারি বেলিয়াতোড়ের সাগরাকাটার কালিদাস বাউরি, ৩০ জানুয়ারি সোনামুখীর রাঙাকুলের জঙ্গলে হুলাকর্মী গুরুদাস মুর্মু। তবুও সাধারণ মানুষের সম্পত্তি রক্ষার্থে হাতি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। ‘হচ্ছে-হবে’ বলে দায়সারা গোছের বিবৃতি দিয়ে চলেছেন অফিসারেরা।
হাতি মারমুখী হয়ে পড়লে বনবিভাগ ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে ছেড়ে আসে। যথেষ্ট ভাল ব্যবস্থা, সন্দেহ নেই। তবে বনবিভাগের সঙ্গে বনসংলগ্ন মানুষ তেমন সহযোগিতা করছেন না। বন সুরক্ষা কমিটিগুলোও তৎপর নয়, হাতির গতিবিধি সম্পর্কে বন বিভাগের সতর্কতার প্রতি কমিটিগুলি উদাসীন থাকে। রাজনৈতিক প্রভাবে বন আধিকারিকদের অসহায় হলে চলবে না।
সর্বোপরি, হাতিদের পিছনে লাগেন এক শ্রেণির মানুষ। হাতির পালের দিকে পাথর ছুড়ে, পটকা ফাটিয়ে, কৃষিজমিতে ইলেকট্রিক তার ফেলে রেখে, জমির জলে বিষ মিশিয়ে রাখেন অনেকে। এগুলোর প্রতি নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। বনবিভাগে এখন বনসহায়ক পদে নিয়োগ হওয়ায় কাজের লোকের অভাব নেই। আছে বিট অফিস, রেঞ্জ অফিস। মুখ্য বনপালের অফিসও এখন জঙ্গল দূরত্বের কাছাকাছি দুর্গাপুর শহরে। তবুও হাতির হানায় মৃত্যু চলতেই থাকবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া
বাদুড়তলা
সুভাষগ্রাম স্টেশন থেকে হরিনাভী স্কুল অভিমুখী রাস্তায় আধ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই রাস্তার বাঁ দিকে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের পৈতৃক বাড়ি। তার বিপরীত দিকে চারটি বিশালাকার তেঁতুলগাছ। আদি বাসিন্দাদের মত অনুযায়ী, গাছগুলির বয়স প্রায় ১৫০ বছর। দিনের বেলা উপর দিকে তাকালেই নজরে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। পর পর চারখানা গাছে ঝুলে থাকতে দেখা যায় শয়ে শয়ে বাদুড়। অঞ্চলটির নামই হয়েছে ‘বাদুড়তলা’। বাদুড়দের বসবাস এখানে বংশ পরম্পরায়। বহু কাল ধরেই বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে বাদুড়কে অশুভ প্রতীক রূপে দেখানো হয়। ফলে জনসাধারণের মধ্যে বাদুড় সম্পর্কে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ভ্রান্তিমূলক ধারণা। বাদুড়তলার মানুষজন কোনও দিন বিরূপ মনোভাব পোষণ করেননি। বরং প্রবীণরা মনে করেন বাদুড়তলার এই বিশেষ বাসিন্দারা সমৃদ্ধির প্রতীক। এবং সেই কারণেই এলাকার প্রাচীন ওই গাছগুলি এখনও টিকে আছে। সম্প্রতি আমেরিকার ভারমন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে যে, সারা পৃথিবীতে বনাঞ্চল সৃষ্টিতে অন্য যে কোনও প্রাণীদের থেকে বাদুড়ের ভূমিকা অনেক বেশি। বলা হয়ে থাকে যে, পোকামাকড় খেয়ে বাদুড় কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করে, এবং এদের মল কৃষিজমিতে সার হিসাবে কাজ করে।
ক্ষেত্রসমীক্ষার তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, বাদুড়তলার তেঁতুলগাছগুলিতে বাদুড়দের আশ্রয় ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই। গত একশো বছরে তৈরি হয়েছে একের পর এক গগনচুম্বী বহুতল। কিন্তু চারখানা গাছ একই রকম আছে। তবে এগুলিকে আর কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে, সেই সম্পর্কে সন্দিহান এলাকাবাসী। সুভাষগ্রাম স্টেশন এবং সোনারপুর গ্রামীণ হাসপাতালের সন্নিকটে অবস্থিত ওই জমির বাজারদর আকাশছোঁয়া। খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্থানীয় প্রোমোটারদের শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে ওই জমির উপরও। শরিকি বিবাদের জন্যই ওই জমি এখনও বিক্রি হয়নি। কিন্তু মামলা-মকদ্দমার নিষ্পত্তি হয়ে গেলে, লোকালয়ের ভিতর ছোট্ট এক টুকরো এই সবুজ এবং একটি যে জলাশয় রয়েছে, তা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলেই আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
একটি তেঁতুলগাছের আয়ুষ্কাল পৌনে তিনশো থেকে তিনশো বছর। প্রশাসনের তরফ থেকে যদি পুরো জমিটির এবং গাছগুলির যথোপযুক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, তবে খুব ভাল হয়। গাছগুলি কাটা পড়লে বাদুড়দের একটি নিশ্চিন্ত আবাসস্থল শুধু নষ্ট হবে না, বিঘ্নিত হবে এলাকার বাস্তুতন্ত্রও। বিজ্ঞানীদের কথা অনুযায়ী, বাদুড়ের স্বাভাবিক বাসস্থান যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাদের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে অনেক গুণ। বাদুড় যে ক্ষতিকর জীবাণুগুলির বাহক, সেগুলি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে খুব সহজেই, যা নতুন কোনও মহামারির জন্ম দিতে পারে।
রাজীব রায় গোস্বামী, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
বকখালির আগুন
কলকাতা থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীরে বকখালি তার মনোরম পরিবেশের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সৈকতজোড়া ঝাউবনের শোভা দেখার জন্য প্রায় সারা বছর বকখালিতে ভিড় জমান পর্যটকরা। কিন্তু কিছু পর্যটক নিরাপত্তারক্ষীদের নজর এড়িয়ে ঝাউবনে ঢুকে যান, এবং নানা রকম অসামাজিক কাজকর্ম করেন। তাই ঝাউবনে আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটল (বকখালির ঝাউবনে আগুন, ১৪-২)। অনেকখানি এলাকার ঝাউবন পুরোপুরি পুড়ে শেষ হয়ে গেল। ক্ষতি হল বাস্তুতন্ত্রের। যদিও বন দফতরের সক্রিয় কর্মী, ও স্থানীয় মানুষের তৎপরতায় ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু দমকল সরাসরি ঢুকতে পারেনি বনের মধ্যে। তাই মানুষজন বালি ছুড়েও আগুন নেবানোর চেষ্টা করেন। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, ঝাউবনের অদূরে ম্যানগ্রোভের বনভূমি। যদি আগুন দ্রুত ছড়িয়ে বনে আগুন লেগে যেত, তা হলে পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।
আমার দাবি, এই আগুন লাগার তদন্ত হওয়া দরকার, এবং পর্যটন কেন্দ্রের নিরাপত্তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঝাউবনের সুরক্ষার জন্য কিছু পদক্ষেপ করা উচিত। যেমন, বন দফতর থেকে পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা স্থির করে দেওয়া দরকার। পর্যটকদের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ— এই মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা, এবং লিখিত বোর্ড টাঙানো আবশ্যক। অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মতো, মাথাপিছু টিকিট ধার্য করাও প্রয়োজন। তা হলে যখন-তখন সৈকতে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অবাঞ্ছিত লোকজন বার বার যেতে পারবেন না। এ ছাড়াও একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সৈকতভূমি থেকে সবাইকে ফিরে আসার নির্দেশ দিতে হবে। এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পর্যটকদের প্রতি ঘোষণাও জরুরি। সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে দিকেও নজর দিতে হবে। তাই নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। বন দফতর, স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের সদর্থক মানসিকতাই এই পর্যটনকেন্দ্রকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
রতন নস্কর, ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা