শিশুশ্রমিক। ফাইল চিত্র।
স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘কারখানায় কৈশোর’ (২২-৩) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে জানাই, কর্মসূত্রে রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি জেলার প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। শিশুশ্রমিকদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি প্রকল্প চলত সরকারি অর্থানুকূল্যে, যদিও প্রকল্পটি তেমন গতি পায়নি, প্রধানত ছাত্রছাত্রীদের অনিয়মিত উপস্থিতির কারণে। আমি এবং অন্য আধিকারিকরা খোঁজখবর করতে তাদের বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বিকেলের পরে (স্কুলগুলির সময় যেমন ছিল) ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর অসুবিধা কী? উত্তর পেয়েছিলাম, ডবল ডিউটি করলে পয়সা বেশি পাওয়া যায়। অর্থাৎ, অভিভাবকরা চান পড়াশোনার থেকে রোজগার অগ্রাধিকার পাক। ওই জেলাতে ইটভাটা এবং বিড়ি তৈরির কারখানা বেশি বলে শিশু ও মহিলা-শ্রমিকদের সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ, তাদের কম মজুরিতে অনেক ক্ষণ খাটানো যায়, সময়ের সীমাবদ্ধতা নেই। দক্ষিণ ভারতের বাজি বানানোর কারখানাগুলিতে শিশুশ্রমিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত্যুর কথা প্রায়শই শোনা যায়। শিশুশ্রমিকদের কল্যাণে অনেক আইনকানুন হয়েছে, বিদগ্ধ মানুষদের নিয়ে কমিটিও আছে। গোড়ায় গলদ এই যে, দারিদ্র নিরসনের পথ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। করোনা কালে পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অবস্থার হাল হকিকত বোঝা গিয়েছিল। সরকারের দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে, এই সান্ত্বনা নিয়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
লেখাপড়ার কাজ
স্কুল ছেড়ে পড়ুয়ারা কেন বেছে নিচ্ছে ভাটি, ভেড়ির দাসশ্রম, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। আশির দশকের শেষের দিকে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়ি, তৃতীয় শ্রেণিতে। লেখাপড়া না পারলে ছড়ির মার বহাল আছে। মাস্টারমশাই প্রশ্ন করছেন, ছাত্রদের কাছে পড়া না পেলে মার চলছে। এমন সময় ক্লাসের একটি ছেলের মা জানলা দিয়ে মাস্টারমশাইকে বলছেন, ছেলেকে আর মারবেন না, ও কিছু দিন পরে দর্জির কাজে যাবে। সেই সময় বন্ধু হারানোর একটা কষ্ট রেখা ফেলেছিল মনে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে, স্কুলছুটের হয়নি। এক সময়ে দারিদ্রের কারণে অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে। বর্তমানে সরকারি নানা সুযোগসুবিধা তারা পাচ্ছে, তবু স্কুলছুট আটকানো যাচ্ছে না। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য খরচ করতে আগ্রহী নন। সঙ্গে বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হয় না, সন্ধ্যা থেকে টেলিভিশনে ধারাবাহিক দেখা হয়। ছাত্রছাত্রী স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে পড়াশোনা করে না। এই ভাবে ক্রমশ উঁচু ক্লাসে গিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছে, স্কুলছুট হচ্ছে। অনেকে মাসের অধিকাংশ দিন স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে থাকছে। কেবলমাত্র সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নেওয়ার জন্য স্কুলে ভিড় করছে। এর মধ্যে নানা ধরনের কাজ খুঁজতে ব্যস্ত বাড়ির অভিভাবক। খাওয়া-পরা’সহ সপ্তাহে কিছু টাকা দিলে কাজে চলে যাচ্ছে অনেক ছেলেমেয়ে। এমনও অনেকে আছেন যাঁরা বলেন, বেশি লেখাপড়া শিখে করবে কী? এলাকায় শিক্ষিত বেকারের উদাহরণ টানেন অনেকে।
সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
রাষ্ট্রের দায়
স্বাতী ভট্টাচার্য নির্মম প্রশ্ন তুলেছেন— আমাদের স্কুলগুলো কী ভাবে ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে কারখানায় বা ইটভাটার চাইতে বেশি নিপীড়ক, নিরানন্দ হয়ে গেল। অথচ, স্কুল বয়সই তো আনন্দময়। সমাজের এই গভীর অসুখের কথা আমরা আর খবরই রাখি না। যেন এ আমাদের নয়। এই সমাজ, এই শিক্ষা, রুজি রোজগার ব্যবস্থা তো আমাদেরই তৈরি। কী হবে এই শিশুদের তবে? আগে স্কুল-ঘরে জায়গা হত না বসার। এক বেঞ্চে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসা হত। এখন জায়গা এতই যে বসার কেউ নেই। আগে স্কুলের ছাউনি ভেঙে-ফেটে গেলে তা দিয়ে আকাশের মেঘেরা উঁকি দিয়ে যেত। দেখে যেত কী পড়া হচ্ছে। স্থানীয়রা ব্যবস্থা করে ছাদ সারাতেন। স্কুলের সুবিধে-অসুবিধে তাঁরাই দেখতেন। তখন স্কুল ছিল এলাকার মানুষের প্রিয়। তার পর সরকার স্কুলগুলোকে হাতে নিলে স্কুল হয়ে গেল সরকারের। এখন আর মানুষ আসতে পারে না। দূরে থাকতে হয়। তাই ভাবনাও নেই, কী পড়ে ছেলেমেয়েরা। আদৌ পড়ে কি না। তাই কেন শিক্ষক নেই, পড়ুয়া নেই, কেউ খবর রাখে না। সরকারও তো তাই চায়। কেউ যেন না ভাবে। বছর বছর ক্লাসে উঠছে, এমনি এমনিই পাশ করে যাচ্ছে। তাতেও হচ্ছে না? পাশের হার আরও বাড়িয়ে বছর বছর লাখে লাখে ছেলেমেয়ে স্কুল পেরিয়ে যাচ্ছে। কলেজও পেরিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হল, যারা নানা রকম কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা রোজগার করতে চায়, বা করতে বাধ্য হয়, স্কুল কি তাদের জন্য নয়? দুনিয়াটাকে বোঝা, আকাশের তারা চেনা, এদের জন্যেও কি নয়? এক বার আইটিআই প্রশিক্ষণের কথা শোনা গিয়েছিল। এখনও চলছে কি সেগুলো? না চললে, কেন বন্ধ হল? সামাজিক ভাবেও গরিবের লেখাপড়ার জন্য যে সব কাজ এত কাল হয়ে আসছে, সান্ধ্য-স্কুল চালানোর মতো, সে সবও আজকের অবস্থায় উৎসাহ পায় না। শৌখিন কাজ হয়ে পড়েছে সে সব, সামাজিক দায়বদ্ধতা নয়। রাষ্ট্র সব কেড়েকুড়ে নিল নিজে করবে বলে, আসলে কাজ কিছুই করল না। হাজারে হাজারে সরকারি স্কুল তাই পাততাড়ি গোটাচ্ছে। এখনও স্কুল যা আছে তা অনেকটা নামেই। শিক্ষক নেই, পড়ুয়া নেই, শিক্ষা নেই। সরকার বলবে আমরা তো খুলে রেখেছি, পড়ুয়া কোথায় যে পড়াব। তাই তুলে দিচ্ছি। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোথায় উধাও হল পড়ুয়ারা? কেন মেছো ভেড়িতে, ইটভাটায়, ভিন রাজ্যের কারখানায় তারা আজ বাঁধা শ্রমিক? শৈশব কৈশোর সব হারিয়ে গেল ইটভাটায়, এই কি তবে উন্নয়ন! বাকি যারা পড়ে রইল স্কুল-কলেজে, তাদের জন্য রয়েছে ইউটিউবের টিউটোরিয়াল ভিডিয়ো। যার যেমন ক্ষমতা, পয়সা দিয়ে কিনে পড়ে পরীক্ষা দেবে। যার যেমন ক্ষমতা, তেমন তেমন ডিগ্রি জোটাবে। নিয়োগকর্তারাও তো তাই বলেন— কী লাভ বছর বছর কলেজে সময় খুইয়ে? চলে এসো, জলদি অনলাইন ডিপ্লোমা করে। আর ক্লাসই যখন অনলাইন, তখন দরকার কী আর স্কুলের? পিছনে পড়ে রইল শুধু ইটভাটার কৈশোর।
শিবপ্রসাদ দাস, আন্দুল মৌড়ি, হাওড়া
স্নানের ঘাট
এই গ্ৰীষ্মে শরীর জুড়োনোর সহজ পন্থা পুকুরের জলে কিছুটা সময় কাটানো। বড় গভীর একটা পুকুর, চার পাশে গাছগাছালির ঘন ছায়া, এক পাশে স্নানের ঘাট— ছেলেবেলার সেই দিনগুলোকেই স্মরণ করায়। ‘পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে, জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে’— রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন। শোনা যায়, কোনও একটা বাস স্টপের নামও স্নানের ঘাট। পুকুরের পাড়ে আজও দেখা যায় সেই ঘাট। তবে অধিকাংশই ভগ্নপ্রায়। দেখে মনে হবে বহু প্রাচীন। গঠনশৈলী ভেঙে বেরিয়ে আসা ইটগুলি প্রাচীনত্বের সময়কাল নির্দেশ করে। পুরনো সে সব স্নানের ঘাট অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি।
অনেক ঘাটে নামার আগে মাঝখানে কিছুটা অংশে চাতাল, আর দু’পাশে লম্বা কংক্রিটের হেলান দেওয়া বসার জায়গা। দু’দিকের সেই কংক্রিটের আসনে সার বেঁধে বসতে পারেন বেশ কয়েক জন। কাজেই সেই স্নানের ঘাটে স্নান পর্ব যেমন চলত, তেমনই তা এক সময় হয়ে উঠত কোলাহল-মুখর।
এক কথায় বলা যায়, খোলা বৈঠকখানা। গরমের দুপুরে বিশ্রাম চলত ঘাটের সেই চাতালে। চলত আড্ডা, আলোচনা। ঘাট ছাড়িয়ে সে সব কথা ছড়িয়ে পড়ত নানা মহলে। সময়ের সঙ্গে সেই স্নানের ঘাট বিলুপ্তপ্রায়।
সনৎ ঘোষ, বাগনান, হাওড়া