আমি সরকারি রেজিস্ট্রিকৃত ও অনুদানপ্রাপ্ত ছোট পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত এক স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে তৃষ্ণা বসাকের ‘গ্রন্থাগার, এক বিলুপ্তপ্রায় বস্তু’ (৩১-৭) প্রসঙ্গে কিছু অভিজ্ঞতা জানাতে চাই। সকলেই জানেন যে, ইদানীং যে কোনও গ্রন্থাগারের অবস্থা শোচনীয়। সরকারি গ্রন্থাগারগুলি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে যে ছোট ছোট গ্রন্থাগার স্থানীয় মানুষের আনুকূল্যে, উৎসাহে ও স্বেচ্ছাশ্রমে পুষ্ট হয়ে সমাজের বুকে সুচিন্তনের ফসল বুনেছিল— আজ তারা সকলেই ধুঁকছে। অন্যতম কারণ— লোকবল ও পর্যাপ্ত অর্থানুকূল্যের অভাব। এই দু’টির অনুসারী ফলস্বরূপ, আকস্মিক বদলে যাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজে পাঠাগারগুলি নিজেদের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হয়েছে নিঃসন্দেহে। অনেকেই পাঠাগারগুলির প্রধান শত্রু হিসেবে নির্বাচন করেন টেলিভিশন সিরিয়ালগুলিকে। কিন্তু ডিম ও মুরগির প্রাচীন ধাঁধার মতো উৎসাহী পাঠক ও পাঠাগারের মানোন্নয়ন, কোনটি আগে আসবে, এই ধন্দ থেকেই যায়।
পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন মানুষ ফোন করে পাঠাগারের বিষয়ে খোঁজ নেন। তখন আশা জাগে যে, পাঠাগার বাঁচিয়ে রাখতে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। কিন্তু প্রায় প্রতি বারই জানা যায়, বাড়িতে জঞ্জালের ন্যায় পড়ে থাকা কিছু বই পাঠাগারে অনুদান দিয়ে সামাজিক গুরুদায়িত্ব পালন করতে চান তাঁরা।
পুস্তক সংক্রান্ত সামগ্রিক খরচ যে ভাবে বেড়েছে ও গত এক দশকে সাধারণ মানুষের সক্রিয়তা যে ভাবে সমাজমাধ্যমে আটকে পড়েছে, গুটিকয়েক স্বেচ্ছাসেবক ও সামান্য পুঁজি নিয়ে পাঠাগারগুলির প্রাথমিক ও একমাত্র চ্যালেঞ্জ এখন বেঁচে থাকা। পাঠাগারগুলিতে কী কী খামতি আছে তা প্রায় সকলে জানেন, তা থেকে উত্তরণের পথও দুর্জ্ঞেয় নয়। প্রধান অভাব কর্মীর, প্রধানত উৎসাহী স্বেচ্ছাসেবকের। অর্থকরী সমস্যাও কিছুটা অতিক্রম করা যায় যা হলে। পাঠাগারের মতো যথার্থ মানুষ গড়ে তোলার এমন একটি উপকরণ সমাজ থেকে যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, এর দায় হয়তো এক দিন সকলকেই চোকাতে হবে।
প্রিয়ম মজুমদার
শ্রীরামপুর, হুগলি
মানুষের তৈরি?
রাজ্যের কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ‘ম্যান-মেড’ বা মানুষের তৈরি আখ্যা দিলেন (‘ম্যান-মেড বন্যা: মমতা’, ৫-৮)। এ ব্যাপারে বলতে চাই, বর্ষার মরসুমের চার মাস কী ভাবে বন্যার বিপর্যয়কে মোকাবিলা করা যাবে, তার জন্য রাজ্য সরকারের প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা কমিটি রয়েছে। অগ্ৰিম বন্যা নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা কী ছিল? রাজ্য সরকার গত দশ বছরে কী পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যে, প্রতি বছর অতিরিক্ত বর্ষা হলেই নিম্ন দামোদর এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যার কবলে চলে যায়?
এ বার আসা যাক জলাধারের জল ছাড়া প্রসঙ্গে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে না জানিয়ে ডিভিসি-সহ কোনও বাঁধ থেকেই জল ছাড়া হয় না। ডিভিসি-র তিনটি বাঁধ থেকে বাঁধ রক্ষা করার জন্য কতটা পরিমাণ জল ছাড়া হবে, তার জন্য ডিভিসি রিভার রেগুলেটরি কমিটি আছে। ওই কমিটির অন্যতম সদস্য পদাধিকার বলে রাজ্য সরকারের সেচ বিভাগের মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার। এই কমিটি ঠিক করে কতটা জল ছাড়া হবে। রাজ্য সরকারের যে প্রতিনিধি আছেন, তিনি সবটাই জানেন। জল ছাড়ার আগে রাজ্য প্রশাসনের সর্বস্তরে এবং জেলা প্রশাসনের কাছে অগ্ৰিম বার্তা পাঠানো হয়। কোন জলাধার থেকে কতটা পরিমাণ জল ছাড়া হবে, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, হাওড়া, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও হুগলির জেলাশাসকদের নিকট অগ্ৰিম বন্যা সতর্কতার বার্তাও দেওয়া হয়। এই বার্তা দেওয়ার ছ’ঘণ্টা পর জল ছাড়া হয়। সমস্ত নিয়মবিধি মেনে জল ছাড়তে ছাড়তে ৮-১০ ঘণ্টাও লেগে যায়। শুধুমাত্র বাঁধ কর্তৃপক্ষের উপর দোষারোপ করে সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। প্রশাসন উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছিল কি না, সেটাও বিচার্য।
রাসমোহন দত্ত
মছলন্দপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
বন্যাকবলিত
সম্প্রতি বেশ কিছু দিন অতিভারী বৃষ্টি ও ডিভিসি থেকে অনিয়ন্ত্রিত জল ছাড়ার ফলে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যাকবলিত। এই মহকুমা জুড়ে রয়েছে শিলাবতী, কংসাবতী, ঝুমি-সহ একাধিক নদী। এ ছাড়াও রয়েছে ছোট-বড় অনেক খাল। যে খাল ও নদীগুলির দীর্ঘ দিন সংস্কার হয়নি। নদীবাঁধগুলোর অবস্থাও ভগ্নপ্রায় নিয়মিত সংস্কারের অভাবে। তাই ঘাটাল মহকুমার তিন-চারটি ব্লক প্রতি বছর অতিরিক্ত বৃষ্টি হলেই বন্যার কবলে পড়ে। ফসল নষ্টের পাশাপাশি পুকুরের মাছ, বাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য— সব কিছুর প্রচুর ক্ষতি হয়।
প্রতি বছর বন্যার হাত থেকে ঘাটালবাসীকে রক্ষা করার জন্য আশির দশকে তৎকালীন বাম সরকার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের উদ্যোগ করে। তৎকালীন সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলান্যাস করেন। কিন্তু দীর্ঘ বাম আমলে এই শিলান্যাস ছাড়া মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হয়নি। ভোট আসে, ভোট যায়, নেতা-মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়, কিন্তু ঘাটালবাসীর জলযন্ত্রণা আর কাটে না। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নতুন করে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তাব পাঠানো হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের আর্থিক সাহায্যে এই বৃহত্তম প্রকল্পটি কার্যকর হবে বলে ঠিক হয়। এর জন্য ১২৩৮ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকার বাজেট ধরা হয়। শোনা যায়, ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই মাস্টার প্ল্যানের অনুমোদনও করে। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের দড়ি টানাটানি খেলায় আজও মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরু হয়নি। শুধু বন্যা হলে নিরাপত্তা নিয়ে ভুটভুটি নৌকায় নেতা মন্ত্রী, সাংসদরা বন্যাকবলিত এলাকায় ঘুরে বেড়ান, সহানুভূতি দেখান, ও একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়িয়ে যান।
রাজ্যের হাতে সেচ দফতর রয়েছে, তার মাধ্যমে আগে নদী বাঁধ এবং খালগুলো নিয়মিত সংস্কার হত। এখন সেগুলোও ঠিকমতো হয় না। তাই সামান্য জলের তোড়ে বাঁধগুলো ভেঙে যাচ্ছে। সব দল ঘাটাল মহকুমার মানুষের জলযন্ত্রণা নিয়ে রাজনীতি করতে চায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানুষ হয়তো প্রতিরোধ করতে পারবে না, কিন্তু মানুষ পারে বুদ্ধি দিয়ে বিপর্যয় জয় করতে।
চিত্তরঞ্জন মান্না
ঘাটাল, পশ্চিম মেদিনীপুর
ছাতার কথা
ভরা শ্রাবণ মাস। গত ৫ অগস্ট প্রকাশিত একটা ছবিতে সিউড়িতে ছাতার বিকিকিনি মনে করায়, বৃষ্টিতে ভরসা ছাতা। শুধু বর্ষা কেন, রোদের হাত থেকে বাঁচতেও ছাতাই ভরসা। ছাতার জন্ম তিন হাজার বছরের বেশি আগে। জন্মসূত্রে চিনা। লম্বা বাঁটওয়ালা (হাতলযুক্ত) ছাতা, যার বাঁট বাঁশ বা বেতের তৈরি। স্টিলেরও হতে পারে। বাঁটহীন ছাতা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি, যাকে আমরা চিনি ‘মাথালি’ বলে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাতাও নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। ফোল্ডিং ছাতা দুই বা তিন ফোল্ডের হতে পারে। ব্যাগের মধ্যে সহজে ঢুকে যায়। ছাতা ফ্যাশনেরও অঙ্গ। আবার, আত্মরক্ষারও অঙ্গ ছাতা। ধুতি-পাঞ্জাবি (বুশ শার্ট) পরিহিত মাস্টারমশাই, হাতে ছাতা, এক সময়ের পরিচিত দৃশ্য। আলপথে চলাফেরার সময় সাপ থেকে বাঁচতে ছাতা। ফুটবল মাঠে বিপক্ষের গোলে বল ঢোকার পর সমর্থকদের ছাতা খুলে উল্লাস ও ছাতা নিয়ে চিৎকার কালের গর্ভে। এখন বিভিন্ন হোটেল, রেস্তরাঁও বড় ছাতার তলায় বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ভরা বর্ষায় এক ছাতার নীচে, একটু আড়াল রেখে মন দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী ছাতা। এবং যে কথাটি না বললেই নয় তা হল— ছাতা হারানো। বোধ হয় এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার, যিনি জীবনে একটি বার ছাতা হারাননি।
দেবাশিস দাস
বোলপুর, বীরভূম