parliament

সম্পাদক সমীপেষু: তর্কের ঐতিহ্য

আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তগুলিই আর মানা হচ্ছে না। দলীয় লাভের প্রচেষ্টায় সংবিধান পাল্টাতে হলেও সেই কাজে পিছপা নয় মেকি গণতন্ত্রের পূজারিরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৪৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

নাম বদলে গেল সংসদ ভবনের। নতুন নাম, সংবিধান সদন। ‘কালের কপোলতলে’ (২৫-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে ভারতবর্ষের সংবিধান তথা গণতন্ত্রের রক্ষকদের তুঘলকি কর্মকাণ্ডের দিকটি যথার্থই প্রস্ফুটিত হয়েছে। ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষ, দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য প্রাণপাত করেন। সেখানে ১২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন সংসদ ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন বিলাসিতার নামান্তর মাত্র। বর্তমান ভারতে শাসক দলের সংখ্যাগুরুত্বের আস্ফালনে সংসদীয় গণতন্ত্র এখন বিপন্ন। আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তগুলিই আর মানা হচ্ছে না। দলীয় লাভের প্রচেষ্টায় সংবিধান পাল্টাতে হলেও সেই কাজে পিছপা নয় মেকি গণতন্ত্রের পূজারিরা। তাতে সংসদীয় গণতন্ত্রের টুঁটি টেপা হলেও ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁদের। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও ক্ষমতার দম্ভে মশগুল।

Advertisement

সম্পাদকীয় প্রবন্ধের প্রতিটি অনুচ্ছেদে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা-উত্তরকালে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও আচরণের প্রতি রাষ্ট্রনায়ক তথা রাজনীতিকদের আস্থার ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯২৭ সালে স্থাপিত সংসদ ভবন কলেবরে ১৭০০০ বর্গমিটার বেড়ে বর্তমানে ৬৪,৫০০ বর্গমিটার হয়েছে। ছয়টি সুসজ্জিত প্রবেশদ্বার, অত্যাধুনিক সম্পদে পরিপূর্ণ। তবে নবনির্মিত সংবিধান সদন জানে না, তার পূর্বসূরির ভান্ডারে আছে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্য, যত দিন বাঁচবে সেই অভিজ্ঞতা তার বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে থাকবে। প্রবন্ধটির আবেগঘন উপস্থাপনা নাগরিক-মনকে নাড়া দেবে, সন্দেহ নেই।

শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত বৃত্তাকার ইমারতটি অবশ্য প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলতে পারে, ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনার বিলাসিতায় তার কিছুমাত্র অভিরুচি নেই, ‘বাস্তুশাস্ত্র’ নামক হিং টিং ছট নিয়েও সে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। তার সভাকক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম দেশটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুশীলন করেছেন। বিশ্ব তার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সাক্ষী থেকেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মুক্ত, প্রশ্নময়, বিতর্কসমৃদ্ধ স্বরূপটি গোড়া থেকেই সংবিধান সদনের অজানা হয়ে থাকবে।

Advertisement

প্রবীর কুমার সরখেল, পশ্চিম মেদিনীপুর

বিজ্ঞানের পথ

চিন্ময় গুহর প্রবন্ধ ‘কলকাতার হাসপাতালে পেয়েছিলেন ডিএসসি ডিগ্রি’ (রবিবাসরীয়, ২৩-৭) সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ। কার্ল গুস্তভ ইয়ুং বিশ্ববন্দিত মনোবিজ্ঞানী। মানব মন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের যে পর্যবেক্ষণ, ইয়ুং-এর তত্ত্বের আলোচনায় তাকে তুলে ধরলে মনের স্বরূপ প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু সত্য জানা যায়। বিশ্বপরিচয় বইটির উপসংহারে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “পৃথিবীতে সৃষ্টির ইতিহাসে এদের (প্রাণ ও মনের) আবির্ভাব অভাবনীয়। কিন্তু সকল কিছুর সঙ্গে সম্বন্ধহীন একান্ত আকস্মিক কোন অভ্যুৎপাতকে আমাদের বুদ্ধি মানতে চায় না... অনেক কাল পরে বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে আপাত দৃষ্টিতে যে সকল স্থূল পদার্থ জ্যোতিহীন তাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন আকারে নিত্যই জ্যোতির ক্রিয়া। এই মহাজ্যোতিরই সূক্ষ্ম বিকাশ প্রাণে আরও সূক্ষ্মতর বিকাশ চৈতন্যে ও মনে। বিশ্বসৃষ্টির আদিতে মহাজ্যোতি ছাড়া আর কিছুই যখন পাওয়া যায় না, তখন চৈতন্যে তার প্রকাশ। জড় থেকে জীবে একে একে পর্দা উঠে মানুষের মধ্যে এই মহাচৈতন্যের আবরণ ঘোচাবার সাধনা চলেছে।”

মাইক্রোফিজ়িক্স ও অবচেতন মনের স্বরূপ সমান্তরাল ভাবে দেখলে মনে হয়, আলো যেমন কখনও কণা কখনও তরঙ্গ, কখনও একটা ঝোঁক কণা বা তরঙ্গ হওয়ার, তেমন মানুষের মনেও রয়েছে কতকগুলো আদি ঝোঁক— আবেগের ও প্রবৃত্তির ঝোঁক, বিচার-বিবেচনা করায় ঝোঁক। আদি মানব মনের কতকগুলো ক্রিয়া-স্বরূপের ছাঁদকেই (আর্কেটাইপ) মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক সম্ভাবনা বলে ধরা যায়।

ইয়ুং-এর সামূহিক মগ্নচৈতন্য (কালেকটিভ আনকনশাস) আর বিটাইপ-এর আবিষ্কার, অবচেতন মনের অনেক গভীর সত্যকে উন্মোচিত করেছে। অবচেতনের গভীর প্রদেশ বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার কেবল যে মনোবিজ্ঞানের চিন্তাধারাকেই প্রভাবিত করেছিল তা নয়, শিল্প সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক, ইতিহাস-পুরাণের বিশ্লেষণের পদ্ধতির উপরেও তার প্রভাব স্বীকৃত হয়েছে। এই কারণেই ইয়ুং কিংবদন্তি মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু স্বপ্ন ও অবচেতন মন বিষয়ে ফ্রয়েডের মৌলিক গবেষণার প্রভাবও মনোবিজ্ঞানে কম নয়। ১৯০০ সালে ফ্রয়েডের ইন্টারপ্রিটেশন অব ড্রিমস বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর মনোবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। ইয়ুং এই বইটি পড়ে ফ্রয়েডের প্রতি আকৃষ্ট হন। রবীন্দ্রনাথ ফ্রয়েডের অবচেতন মনের তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ফ্রয়েড সম্পর্কে তাঁর অভিমত কবি অমিয় চক্রবর্তীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব প্রচার হওয়ার পর পাশ্চাত্য জগতে অবচেতনের যেন একটা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সাহিত্যে এর বেগ আর রোধ করা যায় না” (চিঠিপত্র, একাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী ১৯৭৪)।

প্রবন্ধকার ইঙ্গিত করেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান স্বনামধন্য অধ্যাপক ও গবেষক গিরীন্দ্রশেখর বসু ও বিশিষ্ট অধ্যাপক সুহৃৎচন্দ্র মিত্র ইয়ুং-এর সম্পর্কে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এ কথা কতটা গ্রহণযোগ্য? পরাধীন ভারতবর্ষে প্রথম মনোবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৬ সালে। উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও দর্শন বিভাগের প্রধান স্বনামধন্য অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের উদ্যোগে, এবং হার্ভার্ড-প্রশিক্ষিত নগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসে মনোবিজ্ঞান প্রথম একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯২৩ সালে। ১৯২৯ সালে গিরীন্দ্রশেখর বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে যোগ দেন। তিনি ফ্রয়েডের অবচেতন মন, অবদমন বা রিগ্রেশন ও হিন্দু সংস্কার-এর উপর কাজ করে ডিএসসি উপাধিতে ভূষিত হন। অধ্যাপক সুহৃৎচন্দ্র মিত্রও তাঁর গবেষণা ও অধ্যাপনার গুণপনায়, পরবর্তী কালের বিভাগীয় প্রধান হিসাবে মনোবিজ্ঞান বিভাগকে সমৃদ্ধ করেন। এঁদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে ‘ফ্রয়েডপন্থী’ বলে। বিজ্ঞানে এ ভাবে কাউকে চিহ্নিত করা যায় কি? পদার্থবিজ্ঞানে কি নিউটনপন্থী বা অণুবিজ্ঞানী নিলস বোরপন্থী বলে কাউকে চিহ্নিত করা যায়?

বিজ্ঞান সদা প্রবহমান। পূর্বসূরিদের আবিষ্কারকে আরও উন্নত ও সারগর্ভ করাই উত্তরসূরিদের কাজ। ফ্রয়েডের অবচেতন মনের আবিষ্কার না হলে স্বপ্ন ও অবচেতন মনের ক্রিয়াকাণ্ড বিজ্ঞানসিদ্ধ পদ্ধতিতে বোঝা যেত না। ইয়ুং-ও আরও গভীরে গিয়ে নতুন তথ্য পৌঁছে দিতে পারতেন না। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের আলোচনায় বিভেদ ও বিভাজনের কোনও স্থান নেই।

জগদিন্দ্র মণ্ডল, গড়িয়া, কলকাতা

টেক্কা

‘ইতিহাস এবং তাস’ (২২-৯) সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, মহিলা সংরক্ষণ বিলে দু’টি শর্ত লেজুড় হিসাবে রাখা হয়েছে। এই আইন কার্যকর হবে না, যত ক্ষণ না ভারতের জনগণনা সম্পন্ন হচ্ছে। ওই জনগণনা সম্পন্ন হওয়ার পর তারই ভিত্তিতে লোকসভা নির্বাচনী কেন্দ্রগুলির ডিলিমিটেশন করা হবে, এবং মহিলা প্রার্থীদের নির্বাচনী কেন্দ্রগুলিকে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত করা হবে। পরের বছর লোকসভা নির্বাচন বলে কাজটি করার কথা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের।‌ যদি পরবর্তী সরকারও জনগণনা সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তা হলে আরও অপেক্ষা করতে হতে পারে। সমস্যা হল, এই বিলটি একটা মন্দ উদাহরণ হিসাবে থেকে যাবে। ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলি লেজুড়ওয়ালা বিল আনতে অনুপ্রাণিত হবে, যা ভবিষ্যতের হিমঘরে তুলে রাখা যায়।

সুজিত দে, কলকাতা-১১০

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement