‘নয়া অভিষেক বাবুল সুপ্রিয়র’ শীর্ষক খবরের (১৯-৯) পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। আমাদের দেশের সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী আইনে যে সব নীতিকথা বলা আছে, জনপ্রতিনিধিদের নৈতিকতা ও বিবেক বোধের অভাবে তার বেশির ভাগই কার্যকর হয় না। রাজনীতির কূটকৌশলে জনপ্রতিনিধিত্বের নামে আখের গোছানোর প্রবণতা বাংলা তথা ভারতের রাজনীতিতে একটা ভয়ঙ্কর, নেতিবাচক ধারা চিহ্নিত করে, যার দায় রাজনৈতিক নেতারা এড়িয়ে যেতে পারেন না। রাজনীতিবিদদের দল বদলের স্বাধীনতা থাকতে পারে, কিন্তু মানুষকে ঠকানোর অধিকার নেই। একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীকে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়ের পর পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অন্য একটি দলের খেলোয়াড় হওয়ার অর্থ, আগের দলের সমর্থকদের অপমান করা।
দেশে দলত্যাগবিরোধী আইন থাকলেও সেই আইনের উপযুক্ত প্রয়োগের ক্ষেত্রে সব দলেরই প্রবল অনীহা। কারণ একটাই, বিধায়ক বা সাংসদ পদ হারিয়ে বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ’২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের যে সব মন্ত্রী-বিধায়কের ঢল নেমেছিল বিজেপিতে যোগদানের, তাঁদের ঘরমুখী উল্টো স্রোত এখন দেখা যাচ্ছে। বিজেপি যদি রাজ্যের ক্ষমতায় আসত, তা হলেও কি তাঁরা পুরনো দলে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন? ফলপ্রকাশের এক মাসের মধ্যে মুকুল রায় তৃণমূলে ফিরলেন। মন্ত্রিত্ব হারিয়ে বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে নতুন কাজের ‘অপ্রত্যাশিত সুযোগ’ পেয়ে রাজনৈতিক সন্ন্যাস ছেড়ে আবার রাজনীতিতেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অবলীলায় দল বদলের ফলে গণতন্ত্র আজ প্রহসনে পরিণত। এখনকার শাসনতন্ত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা যখন চতুর ও ধূর্ত জনপ্রতিনিধিদের হাতে, তখন সাধারণ জনগণের মনে সুবিধাবাদী নেতাদের দলত্যাগের কারণ হিসাবে যে কোনও অজুহাত সম্বন্ধেই সন্দেহ দানা বাঁধা স্বাভাবিক।
গণতন্ত্রের অবমাননা রুখতে হলে বর্তমান আইনের সংশোধন দরকার। দলত্যাগবিরোধী আইন বলবৎ করতে স্পিকারের হাতে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হোক। অথবা, কোনও জনপ্রতিনিধি যদি দল বদল করতে চান, তা হলে তাঁকে পাঁচ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ করতেই হবে, এমন আইন করা হোক। ওই সময়ের মধ্যে কোনও ভোটে তিনি যাতে দাঁড়াতে না পারেন, সে ব্যবস্থা করা উচিত। আসলে আদর্শ গণতন্ত্রের জন্য চাই কিছু আদর্শবাদী নেতা, যাঁরা সাময়িক সুবিধার লোভে সমঝোতার পথে পা বাড়াবেন না। যে রাজ্যে নির্বাচন প্রার্থীদের প্রধান অংশই আদর্শহীন, সেখানে কে কোন দলে, কিসের আকর্ষণে গেলেন, তা ভাবা বাতুলতা।
অরুণকুমার চক্রবর্তী, কলকাতা-৬৩
ডিগবাজি খায়
হয়তো কাকতালীয়, তবু সত্যি। সে দিন আমি আর ছেলে পড়ছিলাম যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি। ‘ঋষিমশাই বসেন পূজায়/ ৯-কার যেন ডিগবাজি খায়’— অংশে এসে থমকাতে হল। ছেলে ডিগবাজি জানে, বিছানায় তার প্র্যাকটিসও চলে, কিন্তু সে ৯-কার জানে না। কেন বাংলা থেকে ৯-কার বাদ গেল? কে বাদ দিল? প্রশ্নে আমি যখন জেরবার, ঠিক তখনই টিভির পর্দায় ‘এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খবর’— পদ্মফুলের টিকিটে জেতা এক সাংসদ আচম্বিতে ঘাসফুলে যোগ দিচ্ছেন। হাসিখুসি বন্ধ হল, পরিণত বয়সের পাকা মাথার লোকের ডিগবাজি দেখতে লাগলাম। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ-হেন ডিগবাজি আমাদের গা-সওয়া হয়ে পড়েছে। গত বিধানসভার নির্বাচনে ওই দুই প্রতিপক্ষ প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেতেছিলেন। তার বেশির ভাগটাই ছিল পারস্পরিক কুৎসা ও কদর্য কথা ছোড়াছুড়ি। ভোটের আগে ঘাসফুল থেকে দলে দলে যোগদান করলেন পদ্মফুলে। সবার এক সমস্যা— তাঁরা ভীষণ কর্মচঞ্চল, কিন্তু ঘাসফুলে কাজ করার সুযোগ নেই। তাই পদ্মফুলে পাড়ি দিচ্ছেন। আয়োজন হল যোগদান মেলার, স্বতন্ত্র একটি শব্দ তৈরি হল, ‘দলবদলু’। আগে নেতারা শুধুমাত্র নিজের আখের গোছানোর জন্য অন্য দলে চলে যেতেন না, ওইটুকু লজ্জাশরম ছিল। এখন তো রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে, ছেড়ে আসা দলে তাঁর ‘দমবন্ধ হয়ে আসার’ সাফাই গেয়ে, নতুন দলের স্তুতি-বন্দনা করে সহাস্যে নতুন পতাকাটি তুলে নিচ্ছেন। খেলোয়াড়রা ক্লাব বদলান, যাত্রা জগতে নটনটীদের অপেরা বদলও দেখা যেত। বিধায়ক-সাংসদ নির্বাচিত প্রতিনিধি, বিনোদন তাঁদের বৈশিষ্ট্য না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
গত বিধানসভা নির্বাচনে যে-ই আশানুরূপ ফল ফলল না পদ্মফুলে, অমনি আবার ঘাসফুলের দিকে দলে দলে ঢলে পড়া শুরু হল। অনেকে দল বদলের পরেও পূর্বতন দলের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ফেলছেন, কেউ আবার অভ্যাসবশত ফেলে-আসা দলকে জিতিয়ে আনার দাবি তুলছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিধায়ক বা সাংসদ এক দলের টিকিটে জিতে, কোনও রকম জনাদেশ ছাড়াই সে দল ছেড়ে অন্য দলে আসছেন নিজের আখের গোছাতে বা ক্ষমতা ভোগ করতে, এবং কী আশ্চর্য, বিধায়ক বা সাংসদ পদটি আঁকড়ে থাকছেন! গণতন্ত্রের কী অপরূপ মর্যাদা!
আজকাল ‘পেশাদার রাজনীতিবিদ’ বলে একটা কথা শোনা যাচ্ছে। এই দরদহীন পেশাদারি মনোভাব জন্ম দিচ্ছে সুবিধাবাদী রাজনীতির। কোনও রকম নীতি-আদর্শ থাকছে না, থাকছে না কোনও শৃঙ্খলা। ফলে, রাজনীতির ময়দানে ভিড় বাড়ছে অশুভ বুদ্ধিসম্পন্ন, সুবিধাভোগীদের। আগামী দিনে যার সম্ভাবনা আরও প্রবল হচ্ছে। বাংলা ভাষায় ৯-কারের ব্যবহার না থাক, বাংলায় ডিগবাজি-প্রবণ নেতানেত্রীরা রাজনীতির অপব্যবহার করে চলেছেন। তাই রাজনীতির আরোগ্য কামনায়, এই ডিগবাজি ব্যাধির নিরাময় প্রয়োজন।
আবীর কর, রঘুনাথপুর, ঝাড়গ্ৰাম
সম্মানের উত্তরে
রাজনীতিবিদদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। অতুল্য ঘোষ, বিধান রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতাদের দিন প্রায় শেষ। এখন বহুমতে বিশ্বাসী, ধান্দাবাজ নেতাদের কাল এসেছে। ভারতীয় জনতা পার্টি মুকুল রায়কে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদ দিয়েছিল। এত বড় পদ অন্য দল ছেড়ে-আসা এক নেতাকে দিয়েছিল। যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিল। মুকুল রায় সব ছেড়ে দিয়ে তৃণমূলে ভিড়ে গেলেন। বাবুল সুপ্রিয়ের কথাও বলা চাই। ২০১৪ সালে সাধারণ নির্বাচন। নরেন্দ্র মোদী আসানসোলে নির্বাচনী সভা করছিলেন। প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়। প্রথম বারের সভা জনসমাগম কম। মোদীজি ফের এলেন। এ বার বিপুল জনতা দেখে মোদী খুশি। বাবুলকে ডেকে জেতার আশ্বাস দিলেন। বাবুল জেতার পরে আনকোরা এক জনকে মন্ত্রী বানালেন। বাবুল মোদীজিকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে সম্বোধন করতেন। সব পিছনে পড়ে রইল, ‘মানুষের জন্য কাজ’ করার অজুহাতে।
সঞ্জয় চৌধুরী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
একটিই ধারা
‘একটি ছবির জন্য’
(২২-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে একটি ব্যঙ্গচিত্রের জন্য আমার বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৯ মাস ধরে চলা রাজ্য সরকারের দায়ের করা ফৌজদারি মামলার কথা বলা হয়েছে। এক জায়গায় বলা হয়েছে, “পুলিশ চার্জশিটে অনেকগুলি ধারার ভিত্তিতে অভিযোগ করিয়াছিল...।” এই তথ্য ঠিক নয়। পুলিশ আমাকে এবং সুব্রত সেনগুপ্তকে (বর্তমানে প্রয়াত) লক আপে ঢোকানোর আগে অ্যারেস্ট মেমোতে চারটি ধারায় অভিযোগ করেছিল, কিন্তু আদালতে পেশ করা চার্জশিটে কেবল একটি ধারার ভিত্তিতে অভিযোগ করেছিল, যা আলিপুর পুলিশ আদালত ১ জুন, ২০১৩, চূড়ান্ত রূপে গ্রহণ করেছিল। ওই ধারাটি হল তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬-ক, যা সুপ্রিম কোর্ট ২৪ মার্চ, ২০১৫ অসাংবিধানিক বলে বাতিল করে। ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সেই ধারায় অভিযোগ থেকে আলিপুর পুলিশ আদালত অব্যাহতি দিয়েছে।
অম্বিকেশ মহাপাত্র, কলকাতা-৯৪