সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ অসময়ে চলে যাওয়ায় আমরা সকলেই ভারাক্রান্ত। কিছু দিন আগেই অভিনেতা অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুও সকলকেই নাড়া দিয়েছিল। মৃত্যুকে বিধির বিধান বা নিয়তি বলে মেনে নিলেও, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অমিল হলে সেই মৃত্যুকে ঘিরে শোক, দুঃখ, অভিমান ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই। এই প্রসঙ্গে কতকগুলি জরুরি কথা মনে করা প্রয়োজন। ‘সিপিআর’ ট্রেনিং, অর্থাৎ বন্ধ হৃৎপিণ্ড ফের চালু করার শিক্ষা বিদেশে স্কুলশিক্ষার অন্তর্গত। প্রাথমিক স্কুল থেকেই অ্যাম্বুল্যান্স, দমকলের নম্বর মুখস্থ করানো হয়। কেউ অসুস্থ বোধ করলে, তাঁকে অসুস্থ দেখালে, বাড়ি বা হোটেলে ফেরানো নয়, তাঁর চিকিৎসার চটজলদি আয়োজন করার শিক্ষাই দেওয়া হয়। কেকে-র ক্ষেত্রে অবাক হতে হয় আয়োজকদের শিল্পীকে হোটেলে ফেরাতে দেখে, যদিও যাওয়ার পথে চিকিৎসার জায়গার অমিল ছিল না। তাঁদের কি ন্যূনতম ধারণা নেই, কোথায় কখন কী করা উচিত! অনেকটা একই ঘটনা দেখা গিয়েছে, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। সেটে শরীর খারাপ লাগছে, তাই বাড়িতে ফোন করলেও সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা কেন মাথায় আসেনি?
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের একটি ব্যস্ত সুপার মার্কেটে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার পরিচয় জানার আগেই, আশপাশের মানুষজন (বেশির ভাগের খুবই অল্প বয়স), মুহূর্তের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে, এতটুকু বিলম্ব না করে আমাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়, প্যারামেডিকরা ইসিজি, রক্তচাপ মাপার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের অ্যাক্সিডেন্ট ইমার্জেন্সিতে খবর দিয়ে হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞের আয়োজন করেন। জানি না, কলকাতার কোনও শপিং মলে আমার এমনটা হলে এই ব্যবস্থা পেতাম কি না, বা আজ আমি এই চিঠি লিখতে পারতাম কি না। আমি লজ্জিত আমার কলকাতার ব্যবহারে। শুধু কল্লোলিনী হওয়ার অহঙ্কার নিয়েই কি সে চলবে?
চৈতালী তরফদার, সিঙ্গাপুর
বেলাগাম ভিড়
কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসে বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কেকে-র অকালপ্রয়াণে শোককে ছাপিয়ে উঠছে আক্ষেপ এবং উষ্মা। যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে তাঁকে শেষ বারের মতো ‘পারফর্ম’ করতে হয়েছে, তার সবিস্তার ছবি, ভিডিয়ো সকলেই দেখেছেন। কেকে আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন, হৃদ্রোগ যখন খুশি হতে পারে— এই সব কিছুকে মাথায় রেখেও কয়েকটি প্রশ্ন বিনীত ভাবে রাখতে চাই।
এক, কলকাতার মহানাগরিক স্বয়ং জানিয়েছেন, অনুষ্ঠানের দিনে নজরুল মঞ্চের ধারণক্ষমতার চাইতে তিন গুণ বেশি ভিড় হয়েছিল। কেকে-র মতো জনপ্রিয় শিল্পী এলে ভিড় হবে— সেটাই স্বাভাবিক। নজরুল মঞ্চ কলকাতা পুরসভা ও কেএমডিএ-র অধীনে। অর্থাৎ, তার নিজস্ব পরিচালন ব্যবস্থা আছে, বা থাকা উচিত। সেই পরিচালকরা সে দিন কোথায় ছিলেন? তাঁরা ভিড় ঠেকাতে কোনও ব্যবস্থা করলেন না কেন? কেন দর্শক ঢুকে পড়লেন তিন গুণ বেশি?
দুই, উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই ছিলেন বৈধ টিকিটধারী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে, ২৮০০ আসনের প্রেক্ষাগৃহে টিকিটের ‘ক্রমিক সংখ্যা’ চার-পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই টিকিট কারা ছাপাল? কেএমডিএ এটা আটকাতে কোনও ব্যবস্থা করল না কেন?
তিন, পুলিশ কী করছিল? কলকাতা পুলিশের ভিড় সামলানোর দক্ষতা সত্যিই গর্ব করার মতো। সারা বছর ব্রিগেড থেকে দুর্গাপুজো, বড়দিন থেকে ইডেনের খেলা— কলকাতা পুলিশ দুর্দান্ত দক্ষতায় ভিড় সামলানোর দায়িত্ব পালন করে। অথচ, অনুষ্ঠানের দিনের প্রায় কোনও ফুটেজেই পুলিশের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। যদি ধরে নিই যে, ফুটেজে দেখা না গেলেও পুলিশ ছিল, তা হলে ওই জনসমুদ্র যখন প্রায় ‘গেট ক্র্যাশ’ করে মঞ্চে ঢুকে পড়ল, তখন পুলিশ তাদের আটকাল না কেন? শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কাজ করছে না, নাজেহাল করে দেওয়া গরম, শিল্পী নিজে বার বার অস্বস্তি প্রকাশ করছেন— এই রকম পরিস্থিতিতে পুলিশ অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল না কেন? কলকাতা পুলিশ চাইলে ইডেনের খেলা দর্শকশূন্য করে দিতে পারে, দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নিয়ম ভাঙলে বা বেলাগাম ভিড় হলে বন্ধ করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা কলেজের ‘ফেস্ট’ বন্ধ করা গেল না?
সর্বোপরি, কলেজের ছাত্রদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, এ কী করে সম্ভব?
সৌরদীপ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৫
শিক্ষা হয়নি
‘মৃত্যুগ্ৰাস’ (৪-৬) সম্পাদকীয়তে রাজ্যের ফস্কা গেরো ও উদাসীন পুলিশ-প্রশাসনের বিষয়টি যথাযথ ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কলকাতার নজরুল মঞ্চে গান গাইতে এসে, গান শেষ করে তিনি শুধু নজরুল মঞ্চই ছাড়লেন না, ছেড়ে গেলেন এ পৃথিবী। দুর্ভাগ্যজনক হল, নজরুল মঞ্চ কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। যে অনুষ্ঠানকে ঘিরে এত প্রচার ও উন্মাদনা, সেই অনুষ্ঠান সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হবে, এটাই সকলের কাম্য। কিন্তু সেটা হল না। মনে হয়, দিনে দিনে মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। কয়েক বছর আগে এমনটিই ঘটেছিল দেশপ্রিয় পার্কের সর্বোচ্চ দুর্গা প্রতিমা দর্শন নিয়ে। এই ঘটনা থেকে পুলিশ-প্রশাসন কোনও শিক্ষাই নেয়নি। নজরুল মঞ্চের ঘটনা আরও এক বার প্রমাণ করে দিল, কলকাতা আছে কলকাতাতেই। সম্পাদকের বক্তব্যের রেশ ধরে বলতে চাই, ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে কোথাও প্রতিবাদ দেখলেই ক্ষতিপূরণ, চাকরি, দলের টিকিট, গান স্যালুট দিয়ে প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার রাজনীতি এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।
হারান চন্দ্র মণ্ডল, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
আইনের হাত
কলকাতার মেয়র তথা কেএমডিএ চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম জানিয়েছেন, তিনি নতুন স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর (এসওপি) প্রকাশ করতে চান বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে (‘শহরের প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে সতর্কতা’, ৪-৬)। রাজ্য সরকারের আইন ‘বেঙ্গল অ্যামিউজ়মেন্ট ট্যাক্স ১৯২২’ এমন অনুষ্ঠানের লাগাম ধরতে জারি ছিল ২০১৫-১৬ পর্যন্ত। ওখানেই বলা আছে বেশ কিছু শর্ত। প্রথমত, প্রেক্ষাগৃহের অনুমতিপত্র, দ্বিতীয়ত, পুরসভার ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স, তৃতীয়ত, পুলিশ পারমিশন, চতুর্থত, টিকিট ছাপার হিসাব সম্বলিত ছাপাখানার শংসাপত্র প্রয়োজন। এই সব কাগজ ও টিকিটের সিরিয়াল নম্বর ও নির্ধারিত প্রবেশমূল্য সম্বলিত টিকিট বা কার্ডের নমুনা দিয়ে অনুমোদন নিতে হত। দায়িত্বে ছিল কৃষি আয়কর দফতর, নব মহাকরণ (ত্রয়োদশ তল)। বিনোদন করের গন্ধ পেলে বা প্রোগ্রামের চাহিদা অনুযায়ী ভিড়ের আশঙ্কা থাকলে সব ছাপানো টিকিট এই অফিস থেকে স্ট্যাম্প দিয়ে ‘অথেন্টিকেট’ করে দিয়ে নজর রাখা হত বিভিন্ন জায়গার হোর্ডিং বা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যক্তিগত কলমে। ইডেন উদ্যানে হওয়া সমস্ত ক্রিকেট খেলার লক্ষ লক্ষ টিকিট স্ট্যাম্প করা হত দফতর অধিকর্তার বিশেষ অনুমতিসাপেক্ষে। কোনও অনুষ্ঠানকে প্রশাসনিক নজরদারির বাইরে হতে দেওয়া হত না। কার্ডে দাম না ছেপেও লক্ষ লক্ষ টাকার মুনাফা লুটত আয়োজকরা অনুদানের নাম করে। দফতরের তীক্ষ্ণ নজরদারির ফলে বহু বার ধরা পড়ে আয়োজকরা সন্ত্রস্ত থাকতেন, তেমন মনে হলে ‘সিকিয়োরিটি ডিপোজ়িট’ নিয়ে রাখা হত। ওটা ফেরত পাওয়ার আশায় আয়োজকদের বেগড়বাই করতে তেমন দেখিনি এই দফতরে ২৮ বছর কাজ করার সময়ে। নিয়ন্ত্রণ জারি রাখায় সরকারি রাজস্বও (বিনোদন কর) কম আদায় হয়নি এ সব অনুষ্ঠান থেকে।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।