Durand Cup 2023

জিতল পেশাদারিত্ব

গোলের পর মোহনবাগান খেলোয়াড়দের বাঁধনছাড়া দৌড় ও উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে গেল প্রাদেশিকতার বন্ধনকে আর ছুঁয়ে ফেলল ফুটবলের বিশ্বজনীনতাকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:১৮
Share:

—ফাইল চিত্র।

সদ্যসমাপ্ত ডার্বি আর ডুরান্ড কাপ ফাইনাল ম্যাচটি অনেক ভাবনা ও ধারণার জন্ম দিল। অনেকেই হাহুতাশ করেন যে, কলকাতার ফুটবলে বাঙালিরা নেই কেন? অবশ‍্য সর্বভারতীয় মানচিত্রে অন‍্য সব খেলা থেকে ব‍্যবসা বাণিজ্যে বাঙালিরা বহু কাল পিছিয়ে পড়েছে। সেই একই ধারায় ফুটবলও আর একচেটিয়া বাঙালিদের নেই। অন‍্য প্রদেশের ছেলেরা অনেক দিন ধরে শারীরিক সক্ষমতা এবং স্কিলে বাঙালিদের টক্কর দিয়ে ছাপিয়ে গিয়েছে। বাস্তবে প্রতিভার জয় হয় সর্বত্র। তাকে অস্বীকার বা অমান‍্য করা গান্ধারীর মতো চোখ বেঁধে রাখার শামিল।

Advertisement

কিন্তু অবাঙালিরা ফুটবলে সংখ্যাগুরু হওয়ায় ক্ষতির চেয়ে লাভই হয়েছে, যা দেখিয়ে দিল আজকের মোহনবাগান। সত্তর দশকের শেষ ভাগ থেকে দেখেছি, বড় ম্যাচের টেনশনের ফলে অনেক ভাল বাঙালি ফুটবলার নিজেদের খেলা ঠিকমতো মেলে ধরতে পারেননি। আবহমান কাল ধরে পরিবার-পাড়া-বন্ধু’সহ খেলোয়াড়-সমর্থকদের প্রত্যাশার চাপে তাঁরা মুক্তমনে খেলতে পারেননি। ঐতিহ‍্য রক্ষার চাপ আর অপেশাদার মানসিকতার কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ বার বার তাঁদের চেতন, মনন ও শরীরে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু আজকের কর্পোরেট ও পেশাদার ঢঙে পরিচালিত ফুটবল ক্লাবে কোচ, ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট ও সাপোর্ট স্টাফ সবাই অবাঙালি। তাই আজকের খেলোয়াড়রা অনেক খোলামেলা ভাবে, অকুতোভয় হয়ে মন দিয়ে ফুটবল খেলতে পারছেন। এই মোহনবাগান দলের খেলাতেও সেই মানসিকতাই ফুটে উঠল। না হলে ৬১ মিনিটে দশ জন হয়ে যাওয়া একটা দল গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরে এতটা পরিণত ফুটবল খেলতে পারত না। খোলসে ঢুকে বশ‍্যতা স্বীকার করে ফেলত। এইটাই মিথের মৃত্যু ও নতুনের আবাহন।

এখানে কোচ জুয়ান ফেরান্দোর ঠান্ডা মাথায় এক সঙ্গে তিনটে পরিবর্তন (কামিংস, লিস্টন ও গ্লেন মার্টিন্সকে আনা) দলের ভারসাম‍্য, ঐক‍্য ও উদ‍্যমকে চরম রূপ দেয়। মাঝমাঠে বড় চেহারার খেলোয়াড়দের উপস্থিতির কারণে ইস্টবেঙ্গলকে বোতলবন্দি করে ফেলে জ়োনাল ফুটবলে আধিপত‍্য বিস্তার করা মোহনবাগান। এবং যোগ‍্য সঙ্গত করে সতর্ক ডিফেন্ডার বিশাল কাইথের আত্মবিশ্বাস ও দক্ষতা।

Advertisement

নায়ক দিমিত্রি পেত্রাতোস-এর ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখ্য। ছিলাছেঁড়া ধনুকের মতো এক অসাধারণ একাকী রানে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে ক্লিনিক্যাল গ্রাউন্ড শটে দুরন্ত লক্ষ্যভেদ করে দলকে শীর্ষে তুললেন তিনি। গোলের পর মোহনবাগান খেলোয়াড়দের বাঁধনছাড়া দৌড় ও উচ্ছ্বাস ছাপিয়ে গেল প্রাদেশিকতার বন্ধনকে আর ছুঁয়ে ফেলল ফুটবলের বিশ্বজনীনতাকে। শেষ পর্যন্ত জিতল ফুটবল পেশাদারিত্ব।

তাপস দে, কলকাতা-৬১

আদৌ সচেষ্ট?

১৩২তম ডুরান্ড ফাইনাল সম্পন্ন হল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান ম্যাচের মধ্যে দিয়ে। ২০০৪ সালে শেষ বার ডুরান্ড ফাইনালে এই দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল। এত দিন পর এ রকম একটা ফাইনাল খেলায় এই দুই দল মুখোমুখি হবে আর টিকিটের চাহিদা থাকবে না, তা আবার হয় নাকি? একটা টিকিট পাওয়ার আশায় দূর-দূরান্ত থেকে রোদ-জল-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাঝরাত থেকে সমর্থকরা যেখানে ময়দানে লাইন দিয়েছিলেন, সেখানে খেলার দু’দিন আগে জানানো হল, সব আসন নাকি ভর্তি হয়ে গিয়েছে। অথচ, ম্যাচের দিন দেখা গেল মাঠের দর্শকাসনের অনেক জায়গা ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়েছে। খবরে প্রকাশ, যুবভারতীর ৬৫,০০০ আসনের মধ্যে সমর্থকদের জন্যে ৩০ থেকে ৩৫ হাজারের মতো নাকি টিকিট বিক্রি করা হয়েছিল! এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে যদি এই পরিস্থিতি হয়, তা হলে সন্দেহ জাগে দেশের কর্তাব্যক্তিরা ফুটবলের প্রসারের জন্য কতটা সচেষ্ট।

আত্রেয় শেঠ, কলকাতা-২

সিংহ-হৃদয়

ছোট থেকে যে সব চরিত্রের টানে মাঠে যাওয়া, তাঁদের অন্যতম মহম্মদ হাবিব, ‘বড়ে মিয়া’। খেলায় সে ভাবে শিল্পের সুষমা না থাকলেও নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়া নাছোড়বান্দা খেলোয়াড় হিসাবে গোটা দেশ কুর্নিশ করত মহম্মদ হাবিবকে। যখন যেখানে খেলেছেন, সেখানকার জার্সিকে অত্যন্ত সম্মান করেছেন।

হাবিব যখন যে ক্লাবে খেলেছেন, তখন সেই ক্লাবের মেসে থাকাকালীন তাঁর কঠোর অভিভাবকত্বে কোনও খেলোয়াড়ের সাহস হত না কোনও রকম অনিয়ম করার। নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া, অনুশীলন, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা এবং অনুশাসনের প্রয়োজন নিজে যেমন বুঝতেন, সতীর্থ খেলোয়াড়দেরও নিজের জীবনযাত্রা দিয়ে বুঝিয়ে বাধ্য করতেন সেই পথে যেতে। কিংবদন্তি ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁর কলমে একাধিক বার এই কথা লিখেছেন যে, তিনিও সানন্দে মেনে নিয়েছিলেন হাবিবের ভালবাসা মেশানো শাসন। সুব্রত আরও জানিয়েছেন যে, কসমসের সঙ্গে খেলার আগে সবাই পেলের সঙ্গে ছবি তোলাতে ছুটলেও ‘বড়ে মিয়া’ যাননি। বরং তিরস্কার করেছিলেন সহ-খেলোয়াড়দের। খেলার আগে ছবি তোলার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠা তাঁদের আত্মমর্যাদার অভাব দেখে।

মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দাপিয়ে খেললেও এই দুই ক্লাবের অধিনায়কত্ব তিনি কখনও পাননি। বরং দুই দফায় মোট যে দু’বছর মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন সেই দু’বছর ওই ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন। বড় ম্যাচের সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় হাবিব ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মোহনবাগানের জালে দশ বার বল ঢোকালেও মোহনবাগানের হয়ে ইস্টবেঙ্গলকে একটা গোলও দিতে পারেননি। এই অপ্রাপ্তি যেমন তাঁর ছিল, তেমনই ছিল মোহনবাগান সমর্থকদের মধ্যেও। গোটা বাংলার ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে তিনি থেকে যাবেন সিংহ-হৃদয় ‘বড়ে মিয়া’ হিসাবেই।

পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি

ক্লান্তিহীন যোদ্ধা

৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের দিন কলকাতা ফুটবল ময়দানের প্রাক্তন ফুটবলার ‘বড়ে মিয়া’ মহম্মদ হাবিবের জীবনদীপ নিবে গেল। তিনি যত দিন কলকাতায় খেলেছেন, কখনও চাকরি করেননি। তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন, “কলকাতায় আমি ফুটবল খেলতে এসেছি। চাকরি করতে নয়।” তাঁর কাছে চাকরির চেয়েও বড় ছিল ফুটবল। ছোটখাটো চেহারার মহম্মদ হাবিব খেলার মাঠে অত্যন্ত লড়াকু খেলোয়াড় ছিলেন। সে জন্যই তিনি ১৯৭৭ সালে পেলে কসমসের বিরুদ্ধে ম্যাচে সতীর্থদের বলেছিলেন, “পেলের সঙ্গে হাত নিশ্চয়ই মেলাব। কিন্তু ম্যাচের আগে নয়। ম্যাচের আগে ওঁরাও ফুটবলার, আমরাও ফুটবলার। এক ইঞ্চি জমি ছাড়া যাবে না।” তাঁর কাছে খেলার মাঠ ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। তাই তিনি সহজেই নিজের ভাই আকবরকে বলতেন, “তুই আমার ভাই না। আবার ভাই বলব ৭০ মিনিট পরে।” ফুটবলের প্রতি অসম্ভব ভালবাসা না থাকলে আপন ভাইকে এমন কথা বলা যায় না।

এত বড় মাপের খেলোয়াড় হয়েও মহম্মদ হাবিব অর্জুন পুরস্কার ছাড়া আর কোনও পুরস্কার পাননি। তবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ভারত গৌরব এবং মহমেডান তাঁকে আজীবন স্বীকৃতি দেয়। ‘বড়ে মিয়া’ মহম্মদ হাবিব আর না থাকলেও, কলকাতা ফুটবল ময়দান তাঁকে আজীবন লড়াকু, শৃঙ্খলাপরায়ণ, জেদি, ক্লান্তিহীন ১০ নম্বর জার্সির যোদ্ধা ফুটবলার হিসাবে মনে রাখবে।

অপূর্বলাল নস্কর, ভান্ডারদহ, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement