Kitchen

রান্নাঘরের স্বাস্থ্য

আমাদের গ্ৰামাঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িতেই রান্না হয় কোনও একটি ছোট জায়গাতে, যেখানে ভাল করে আলো-বাতাস খেলতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩ ০৪:৩২
Share:

বাড়ির মহিলাদের কষ্টের প্রতি আর একটু সংবেদনশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। —ফাইল চিত্র।

সুজিষ্ণু মাহাতোর ‘রান্নাঘরে উঁকি দিয়েছিস?’ (১৩-৬) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্রের অবতারণা। প্রবন্ধকার এক জন পুরুষ হয়েও যে ভাবে নারীদের রান্নাঘরের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন, তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যিই আমাদের গ্ৰামাঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িতেই রান্না হয় কোনও একটি ছোট জায়গাতে, যেখানে ভাল করে আলো-বাতাস খেলতে পারে না। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, আমাদের মৌলিক তিনটি চাহিদার একটি, অর্থাৎ খাদ্যকে সুন্দর ও সুরক্ষিত ভাবে বাড়ির মহিলারা ঘর্মাক্ত অবস্থাতেও রান্না করে পরিবেশন করার দায়িত্বে থাকেন। কখনও কখনও গরমে ক্লান্ত হয়ে একটু আলুথালু বেশে অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গাতে বসে পড়লে শাশুড়িমা কিংবা পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই বিদ্রুপ উড়ে আসতে শোনা যায়। শুধু বিয়ের পরেই নয়, তার আগেও নিজের মায়ের কোনও শারীরিক অসুস্থতা থাকলে অনেক সময়ই তাঁকে পার্টটাইম রাঁধুনির কাজ করতে হয়। আর বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এলে তো ওই স্বল্প সময়ের কাজটিই পূর্ণ সময়ের হয়ে যায়। অথচ, কোনও অভিযোগ না করেই তাঁরা নিজেদের এই ভাবেই আশ্বস্ত করে বলেন— “পিতার ঘরে পালিত হয়ে, স্বামীর ঘরে যেতে হয়। আমাদের জীবন তো এ রকমই, যেখানে রান্নাঘরকে আপন করতে হয়।”

Advertisement

আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের একটু জায়গা দিতে যদি আমাদের জায়গা ছাড়তে হয়, তা হলে নিজেদের বাড়ির রান্নাঘরটিকে আর একটু স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে গড়ে তোলা এবং বাড়ির মহিলাদের কষ্টের প্রতি আর একটু সংবেদনশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর

Advertisement

ব্যতিক্রম

সুজিষ্ণু মাহাতো তাঁর প্রবন্ধে মহিলাদের গৃহশ্রমের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু উপেক্ষিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেখক একটি মালয়ালম সিনেমার কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে শ্বশুরমশাই গরম ধোসা খেতে চাওয়ামাত্র নববধূ প্রায় ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকেধোসা বানিয়ে আনছেন বা সেই পরিবারের লোকেরা প্রেশার কুকারের ভাতের স্বাদ পছন্দ করেন না বলে কাঠের উনুনে হাঁড়িতে ভাত রান্না করতে বলছেন। বাস্তবটা আসলে আরও অনেক কঠিন। সংসারে স্বামী সন্তান তাদের নির্দিষ্ট কাজ করে বিশ্রামের অনেকটা সময় পায়। কিন্তু ঘরের মহিলার নিজের সময় বলে কিছু থাকে না, তা তিনি যতই শিক্ষিতা বা চাকরিরতা হোন বা না হোন। সন্ধ্যাবেলায় সবাই যখন বিশ্রাম করে, টিভি দেখে বা নিজেদের মতো করে সময় কাটায়, তিনি তখন সবার জন্য জলখাবার বানান, চা করেন। তাঁর এই শ্রমকে খুব স্বাভাবিক ধরা হয়, যেন এই কষ্টটা কোনও কষ্টই নয়।

২০১৯-২০ সালের কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সময় ব্যবহার সমীক্ষা’-তেও বলা হচ্ছে, এক জন ভারতীয় পুরুষ এক জন নারীর থেকে অনেক বেশি সময় পান ব্যক্তিগত কাজ, পরিচিতদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, ঘুমানো ও খাওয়ার জন্য। অধিকাংশ রান্নাঘর যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর নয়, বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকে না, কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহরের ফ্ল্যাটবাড়ির ঘুপচি রান্নাঘরের অবস্থা তো আরও সঙ্গিন। এই তাপপ্রবাহের সময় যখন মানুষকে ভিতরে থাকতে বলা হচ্ছে, তখনও কিন্তু ওই বদ্ধ ভিতরে সকাল-সন্ধে রান্নাঘরে যাঁরা আগুনের সামনে রয়েছেন, তাঁদের কথা ভাবার মতো কেউ নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। মধ্যবিত্ত বাড়িতে শুধু রাতে বা হয়তো সন্ধে থেকে এসি চলে। কিন্তু বাড়ির মহিলারা সে সুখ বা বিশ্রামটুকুও পান না। লেখক সঠিক ভাবেই বলেছেন মৃণাল সেনের চালচিত্র ছবিতে উনুনের ধোঁয়াতে বিরক্ত ছেলেকে মা বলেন— কোনও দিন রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছিস?

নিম্নবিত্ত ঘরে অবস্থা আরও কাহিল। সেখানে জ্বালানিও মহিলাদের সংগ্রহ করতে হয়। আমার গৃহসহায়িকা মফস্‌সল এলাকার বাগান থেকে শুকনো কাঠকুটো সংগ্রহ করে পাঁজা করে লোকাল ট্রেনে বাড়িতে নিয়ে যান রান্নার জন্য। মধ্যবিত্তের রান্নাঘরে ব্যতিক্রম কয়েক জন স্বামী, যাঁরা স্ত্রীর সঙ্গে রান্নার কাজে থাকেন। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে দু’জনেরই অফিস, ছেলের স্কুল, পরে কলেজ ইত্যাদি থাকায় ও অন্য কারও হাতের রান্না পছন্দ না হওয়ায় আমরা কর্তা-গিন্নি মিলে রান্না করতাম এবং অবসরের পরেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। প্রথম প্রথম প্রতিবেশী মহিলারাও হাসাহাসি করতেন।

ওই যে বদ্ধমূল ধারণা, রান্নার কাজ শুধু মেয়েরাই করবে, ওটা কোনও পরিশ্রমই নয়!

শিখা সেনগুপ্ত, বিরাটি, উত্তর ২৪ পরগনা

মাতৃসুলভ

সুজিষ্ণু মাহাতো তাঁর প্রবন্ধে গার্হস্থ শ্রমবিভাজনে লিঙ্গবৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন। উদাহরণ হিসাবে দেখিয়েছেন, কোনও এক চলচ্চিত্রে প্রেশার কুকারের ভাত পরিবারের পছন্দ না হওয়ায় কাঠের উনুনে ভাত রাঁধতে হয়েছে নববধূকে! অর্থাৎ, ঘরের মধ্যেই পরিবারের মহিলা সদস্যটি বাকি সকলের হুকুম তামিল করে চলেন। কিন্তু সত্যি কি শুধুই লিঙ্গবৈষম্য? শুধুই শোষণ? তা বোধ হয় নয়, আমাদের ভারতীয় মেয়েরা জন্মগত ভাবে মাতৃসুলভ। বাড়িতে যখনই অতিথি আসুক, তাকে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না ভারতীয় নারী এবং এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি। ভারতীয় মেয়েরা পরিবারের সবাইকে খাইয়ে একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, শুধু হুকুম মেনে চললে বোধ হয় এটা হত না। আগেকার দিনে ওই রান্নাঘরই ছিল মেয়েদের মনের রসদ জোগানোর স্থান। পরস্পরের সঙ্গে গল্প, হাসি, ঠাট্টা, নতুন রন্ধনপ্রণালী আবিষ্কার— এ সব নিয়েই ছিল তাঁদের জগৎ এবং সেখানে কেউ নিজেকে বঞ্চিত বা শোষিত বলে মনে করতেন না। তবে অবশ্যই মেয়েদের রান্নাঘর যাতে আরামদায়ক হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া

বঞ্চনা

বিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে মিড-ডে মিল এক অপরিহার্য বিষয়। সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী পুষ্টির বিকাশের জন্যই মিড-ডে মিল বরাদ্দ হয়। খালি পেটে শিক্ষা লাভ সম্ভব নয় জেনেই শিক্ষার পাশাপাশি পুষ্টির বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের এই ব্যবস্থা। মিড-ডে মিল কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের আর্থিক বরাদ্দে চলে। অতিমারি পর্বে প্রায় দু’বছর বিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন অভিভাবকদের হাতে মিড-ডে মিল বাবদ চাল, ডাল, আলু, ছোলা ইত্যাদি উপকরণ তুলে দেওয়া হয়েছিল, যাতে শিক্ষার্থী খাদ্য এবং উপযুক্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত না হয়। তবে তীব্র দাবদাহের কারণে এ রাজ্যে দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ওই ক’দিনের মিড-ডে মিল থেকে ছাত্ররা বঞ্চিত হল। মিড-ডে মিল কর্মীরাও প্রায় ওই এক মাসের বেতন থেকে বঞ্চিত হলেন।

সারা দেশের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল কর্মীদের বেতন খুবই কম। বিদ্যালয়ের ছুটি থাকাকালীন ছাত্রদের পুষ্টির বিকাশ এবং কর্মীদের পেট চালানোর দায়িত্ব কোনওটাই শিক্ষা দফতর নেয়নি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া প্রতি মিড-ডে মিলে বরাদ্দ ৫ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া প্রতি ৮ টাকা ১৭ পয়সা। রাজ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় এক কোটি পড়ুয়া রয়েছে, অর্থাৎ গড়ে ৬ টাকা করে ধরলে এক দিনে প্রায় ৬ কোটি এবং মাসে ১৮০ কোটি সাশ্রয়। এই সাশ্রয় হওয়া অর্থ কোন খাতে খরচ হবে, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। অতিমারির পর স্কুলছুটের সংখ্যা যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে মিড-ডে মিল ছাত্রকে স্কুলমুখী করতে এক আকর্ষণীয় বিষয়। সেখানে এই বঞ্চনা শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে। যদিও জঙ্গলমহল, চা বলয় (ডুয়ার্স) এবং সুন্দরবনের পড়ুয়াদের পুষ্টিপূরণের অতিরিক্ত উদ্যোগ করবে রাজ্য শিক্ষা দফতর। তবে সারা রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন এই বঞ্চনা?

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, শিলিগুড়ি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement