—প্রতীকী ছবি।
সম্প্রতি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ আইবিএ, ন’টি ইউনিয়নের যুক্ত মঞ্চ ইউএফবিইউ, অন্যান্য ইউনিয়ন এবং অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ব্যাঙ্কের স্থায়ী কর্মী এবং অফিসারদের বেতন সংক্রান্ত দ্বাদশ দ্বিপাক্ষিক চুক্তির প্রাক্কালে এই সংক্রান্ত সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি কার্যকর হবে ২০২২ সালের নভেম্বর মাস থেকে ৫ বছরের জন্য। চুক্তির বয়ান অনুযায়ী, বেতন এবং ভাতা নিয়ে বাৎসরিক বৃদ্ধি হবে ১৭ শতাংশ। এই বৃদ্ধি আপাতত কাজ চলার মতো একটা ব্যবস্থাপনা। এর পিছনে কোনও সুসমন্বিত নীতি আছে বলে মনে হয় না। এর মধ্যে ব্যাঙ্ক কত দিতে রাজি তার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্মীদের কত পাওয়া উচিত— তা এখানে অনুপস্থিত। এখানে ব্যাঙ্ক বলছে, ২০২১-২২ অর্থবর্ষের হিসাব অনুযায়ী, তাদের এই খাতে এসবিআই-সহ অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির জন্য বছরে খরচ হবে ১২,৪৪৯ কোটি টাকা। অথচ, যে কোনও বেতন সংশোধিত হয়ে বর্তমানে কী হবে, তার একটা বিজ্ঞানসম্মত রাস্তা আছে যা ভারতের পঞ্চদশ সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল। পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনের সুপারিশ অনুযায়ী, ন্যূনতম মজুরি, সুষ্ঠু ভাবে জীবনযাত্রা পরিচালনার জন্য মজুরি ইত্যাদি গণনা করতে হবে এক জন শ্রমিকের জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসের বর্তমান বাজার-মূল্য বিবেচনায় রেখে, যাতে তিনি তাঁর পরিবারকে নিয়ে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে কোনও রকম অসুবিধায় না পড়েন। অথচ, এ ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা হল— পুরাতন বেতনের সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা যোগ করে যে পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে, সে পরিমাণকে সামান্য বৃদ্ধি করে নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ।
এ বারের এই সমঝোতা চুক্তির আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল— অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মীদের দীর্ঘ দিনের দাবি পেনশনের আপডেশন— এখানে উপেক্ষিত হল। এর পরিবর্তে ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নগুলির সঙ্গে চুক্তি করেছে যাতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা ‘এক্সগ্রাশিয়া’ হিসাবে পান। এই টাকার পরিমাণ নির্ধারিত হবে পরে। তবে এই টাকার উপর কোনও ভাতা বা অন্য কোনও কিছুই যুক্ত হবে না। কিন্তু এ ভাবে দেওয়া কেন? কেন আপডেশন-এর দাবি উপেক্ষিত হল? এক্সগ্রাশিয়া দেওয়ার দাবি তো অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মীদের পক্ষ থেকে ছিল না। এটা কি কর্তৃপক্ষের দয়ার দান হিসাবে বিবেচিত হওয়া উচিত? যাঁরা ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবনের অমূল্য সময় ব্যাঙ্ক-গ্রাহক পরিষেবায় ব্যয় করলেন, তাঁদের কি এ ভাবে উপেক্ষা করা যুক্তিসঙ্গত?
গৌরীশঙ্কর দাস, সম্পাদক, অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় ইউনিটি ফোরাম, কলকাতা
খয়রাতি নীতি
‘সুরক্ষা না কি খয়রাতি, সতর্ক করলেন রাজন’ (১৭-১২) প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণকে অনুদান দেওয়ার বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে বলেছেন— কিন্তু এই প্রকল্প যখন নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণির কল্যাণে হয় না এবং কে বেশি দিতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়, সমস্যা তখনই। সেখান থেকে সরকারের আর্থিক সমস্যার সূচনা হয়। আমাদের দেশের বর্তমান উন্নয়নের ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সতর্কবাণী বাস্তবোচিত এবং সময়োচিত, সন্দেহ নেই। কারণ, তামিলনাড়ুতে এক সময় জয়ললিতা জনগণের জন্য যে অনুদান প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন, এখন রাজ্যে রাজ্যে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে দিল্লির আপ সরকার, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার-সহ বিভিন্ন রাজ্য একাধিক অনুদানের প্রকল্প ঘোষণা করে তার রূপায়ণ করেছে। গত মে মাসে কর্নাটক বিধানসভা এবং সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অনুদান প্রকল্পের প্রতিযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী মাত্রাহীন অনুদান ঘোষণাকে ‘রেউড়ি রাজনীতি’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার ভেঙে পড়া অর্থনীতির উদাহরণ টেনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাঁর দল বিজেপিও শেষ পর্যন্ত অনুদানের রাজনীতির প্রতিযোগিতায় নেমে একাধিক রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরেছে, কোথাও বা ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। এর ফলে মানুষের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। কারণ অনুদান যখন দরিদ্র শ্রেণির জন্য ঘোষিত না হয়ে সকলের জন্য ঘোষিত হয়, তখন তা আর অনুদান থাকে না, হয়ে দাঁড়ায় ভোটের তাগিদে খয়রাতি।
পশ্চিমবঙ্গেও কন্যাশ্রী, কৃষকবন্ধু, লক্ষ্মীর ভান্ডার, সবুজ সাথী, ট্যাব প্রদান ইত্যাদি প্রকল্প ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য চালু করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, আর্থিক ভাবে সম্পন্ন গৃহস্থের একমাত্র কন্যা কন্যাশ্রীর এককালীন অর্থ পেয়ে বাবা-মাকে মোবাইল ফোন উপহার দিচ্ছে। কৃষকবন্ধু-র টাকায় সেভিংস সার্টিফিকেট কিনছেন। লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর টাকা জমিয়ে শাশুড়ি-বৌমা সোনার দোকানে যাচ্ছেন। নিজের সাইকেল থাকা সত্ত্বেও সাইকেল পেয়ে নিজেরটা বা সবুজ সাথীর সাইকেল বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ট্যাব না কিনে বিল জমা দিয়ে ট্যাবের অর্থ হস্তগত করা হচ্ছে। এই সংখ্যা খুব কম নয়। এগুলো তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সমতুল। তাতে সরকারের কোষাগার থেকে অহেতুক অনেক বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ফলে বছর শেষে আর্থিক সঙ্কট বাড়ছে। সামাল দিতে ঋণ করতে হচ্ছে। বাড়ছে ঋণের বোঝা।
রাজন পুরনো পেনশন প্রথায় ফিরে যাওয়ারও যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতে, ‘পুরনো পেনশন প্রথায় ফিরে গিয়ে সরকারকে দেউলিয়া হওয়ার পথে নিয়ে যাওয়ার কী প্রয়োজন?’ বর্তমানে দেশে যেখানে ধনী গরিবের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সিংহভাগ চলে যাচ্ছে ধনী এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্তের দখলে, তখন শুধুমাত্র দরিদ্র শ্রেণির উন্নতি ঘটাতে কিছু অনুদান প্রকল্প ঘোষণা এবং তার সফল রূপায়ণ দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থে খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ক্ষমতা অতি বিষম বস্তু। ‘সবার উপরে ক্ষমতা সত্য তাহার উপরে নাই’— এই আপ্তবাক্যে সকলে বিশ্বাসী। তাই যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতার দখল নিতে এখন সব রাজনৈতিক দলই তৎপর। ফলে চটজলদি অনুদান দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার এমন নীতিহীন প্রয়াস। তাতে দেশ বা রাজ্য অধিক ঋণগ্রস্ত হলেও ক্ষতি নেই।
এই কঠিন সময়ে সামাজিক প্রকল্প আর খয়রাতির মধ্যে বিভাজন রেখা টানতে সুপ্রিম কোর্টের সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পরামর্শ অন্ধকারে কিছুটা হলেও আলোর রেখা, সন্দেহ নেই।
প্রদ্যোৎ পালুই, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
উপেক্ষিত জনগণ
‘ট্রেনের টিকিট বিমান ভাড়া ছুঁলেও দাম কমানো নিয়ে অনীহা মন্ত্রীর’ (১৮-১২) সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে জানাই, ট্রেন ভাড়া কমানো দূর অস্ত্, কী ভাবে আরও বাড়ানো যায়, সেই প্রচেষ্টাই প্রচ্ছন্ন ভাবে চলছে। রাজধানী, দুরন্ত, শতাব্দী— সব মর্যাদাপূর্ণ ট্রেন। কিন্তু এদের অনেককেই এখন বিলোপ করার প্রচেষ্টা চলছে। একই রুটে আরও বিলাসবহুল ট্রেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেস অতি দ্রুততার সঙ্গে চালু করা হচ্ছে। এদের ভাড়া নেহাত কম নয়। সাধারণ দরিদ্র যাত্রীদের প্রতি কোনও নজর নেই সরকারের। জেনারেল কামরা, যাতে দরিদ্র যাত্রীরা বিনা সংরক্ষণে দুঃসহ যাত্রা করেন, তা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টিকিট বাতিলের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাত্রী নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। গত বছর করমণ্ডল এক্সপ্রেস-এর ভয়াবহ দুর্ঘটনাই যার প্রমাণ। সে ক্ষেত্রে ট্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলা কি অস্বাভাবিক? প্রবীণ নাগরিকরা আগে যে ছাড় পেতেন, তা কোভিডের সময় থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, যা এখনও বহাল আছে। এর পরে কি ট্রেনে যাত্রাও ছেড়ে দিতে হবে?
শান্তনু সেনগুপ্ত, কলকাতা-৮৪