Society

সম্পাদক সমীপেষু: ঋণের বোঝা

এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অগুনতি পরিবারে। সেই সঙ্গে, কোনও ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা মারা গেলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সেই ঋণ শোধ করতে হয় না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৬
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

এক সময়ে বাড়িতে মহিলারা সংসারে হাল ধরতেন প্রধানত শ্রমের মাধ্যমে। খুব সকালে ঘুম ভেঙে ওঠার পর থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত তাঁদের কাজের উপর কাজ করা। দু’বেলার রান্না থেকে আরম্ভ করে চাষের জমিতে গিয়ে কাজ, সেই সঙ্গে বাড়িতে গৃহপালিত পশুর দেখাশোনা, সবই করতেন তাঁরা। পরবর্তী সময়ে মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার উপর জোর দেওয়া হল। মহিলাদের জন্য ঋণ সহজ হয়ে গেল। এর কারণ, অধিকাংশ মহিলা ঋণ পরিশোধ করতে আগ্রহী। স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘ক্ষুদ্র ঋণের দুর্বহ ভার’ (১১-১২) শীর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত হয়ে বলতে চাই, মহিলাদের হাতে ক্ষুদ্র ঋণ সহজে আসার পরে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল পরিবারে। মহিলাদের ঋণ নিতে বাধ্য করল বাড়ির পুরুষেরা। ঋণের টাকা পুরুষ সম্পূর্ণ ভাবে নিজের করায়ত্ত রাখল, পরিশোধ করার জন্য মহিলাদের উপর চাপ তৈরি করল। “বিয়ের সময় তেমন কিছু দেয়নি, ঋণের টাকা বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে শোধ করতে হবে,” এমন মনোভাব দেখা গেল।

Advertisement

এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অগুনতি পরিবারে। সেই সঙ্গে, কোনও ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা মারা গেলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সেই ঋণ শোধ করতে হয় না। এই কারণে বয়স্ক নারীদের লোন দিতে চায় না কোনও সংস্থা।

অপর দিকে, মহিলাদের স্থাবর সম্পত্তি প্রায় নেই বললেই চলে। বাধ্য হয়েই তাঁরা একটা ঋণ শোধ করার জন্য অন্য একটি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কেবলমাত্র ঋণ নেওয়ার জন্য অগুনতি ব্যাঙ্কের বই খোলেন। আসল উদ্দেশ্য কোনও ভাবেই সাধিত হয় না। খুব কমই স্বনির্ভর গোষ্ঠী রয়েছে, যার সদস্যরা শেষপর্যন্ত স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাংলার অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে এই দৃশ্যই চোখে পড়বে। ঋণের চক্করে পড়ে অধিকাংশ মহিলা সর্বহারা হচ্ছেন প্রতিনিয়ত, পরিবারের সদস্যদের চাপে। এখন সময় হয়েছে ভাবার, মহিলারা কতটা পিছিয়ে পড়েছেন ঋণের খপ্পরে পড়ে।

Advertisement

সৈয়দ সাদিক ইকবাল, সিমলা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

ঋণের জালে

রাজ্যের গ্রাম ও শহরের দরিদ্র মহিলারা কী ভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছেন, স্বাতী ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে সেই বিষয়ে বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেছেন। রাজ্য সরকারের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ায় ব্যাঙ্কের দীর্ঘসূত্রতার জন্যই মহিলারা বাধ্য হয়ে বেসরকারি ‘মাইক্রোফিন্যান্স’ সংস্থাগুলো থেকে চড়া সুদের ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ঋণ মাসে মাসে নয়, সপ্তাহে সপ্তাহে পরিশোধ করতে হয় সুদ-আসল মিলিয়ে, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে। কোনও কারণে একটা বা দুটো কিস্তি সময়মতো দিতে না পারলে ভয়ঙ্কর চাপের মুখে পড়তে হয় এই মহিলাদের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সব ঋণ ব্যক্তিগত প্রয়োজন, যেমন চিকিৎসা, ছেলেমেয়ের বিয়ে, পুরনো ঋণ শোধ প্রভৃতি কারণে নিতে বাধ্য হন এই মহিলারা। এই ঋণের টাকা যে-হেতু কোনও ব্যবসায় বিনিয়োগ হয় না, সেই কারণে এর থেকে কোনও মুনাফাও আসে না। ফলে ঋণ শোধ করতে গিয়ে আবার ঋণ করতে হয়। এই ভাবেই মেয়েরা ক্রমশ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েন। দুঃখের হলেও সত্য, লক্ষ্মীর ভান্ডারের সামান্য টাকাটাও বেশ কিছু মহিলাদের এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে চলে যাচ্ছে। প্রবন্ধে সঠিক ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ, বিশেষত চড়া সুদে বেসরকারি সংস্থার ঋণ দরিদ্র মহিলাদের কতটা শক্তি জোগাচ্ছে আর কতটা বিপন্ন করছে, সেই বিষয়ে সমীক্ষা প্রয়োজন। সমীক্ষার প্রয়োজন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কতটা ব্যবসার লাভ থেকে করা হচ্ছে, আর কতটা সংসারের ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে।

আবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বল্প সুদে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে অনেক মহিলা সফল ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং, বেসরকারি সংস্থা থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া অসহায় মহিলাদের বাঁচানোর জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে এই মহিলাদের যুক্ত করে, ছোটখাটো ব্যবসার জন্য স্বল্প সুদে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি

অধরা লক্ষ্য

‘ক্ষুদ্র ঋণের দুর্বহ ভার’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে নিজের কর্মজীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। স্বনির্ভর গোষ্ঠী-সংক্রান্ত প্রকল্প রূপায়ণের ভারপ্রাপ্ত জেলা আধিকারিক থাকার সুবাদে জানি, গত আশির দশকের শেষ দিক থেকেই গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার লক্ষ্যটি যোজনা কমিশনের অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কেবলমাত্র কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীলতা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে পারে না। চাষের জন্য ঢালাও ঋণের ব্যবস্থাও ফলপ্রসূ হয়নি, কারণ ঋণগ্রহীতা উপযুক্ত কি না, তা বিচার না করেই বিডিও অফিসগুলি থেকে ঋণ প্রদানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। সেই ঋণের অপব্যবহার এবং অনাদায়ি বিপুল পরিমাণ ঋণের সাক্ষ্য বহন করছে এখনও জেলার ‘লোন রেজিস্টার’গুলি।

এই একই কারণে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির মাধ্যমে সমবায় কৃষক উন্নয়ন সমিতিতে কৃষিঋণ প্রদান তেমন সাফল্য পায়নি। পরবর্তী কালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে মহিলাদের নিয়ে গ্রুপ-ভিত্তিক রোজগারের প্রকল্পের পরিকল্পনা তুলনায় সফল হয়েছিল। যে কাজগুলি সম্পর্কে গ্রামের মহিলারা ওয়াকিবহাল, সেগুলিতেই তাঁদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রকল্প রূপায়ণে সহায়তা করা হত। প্রকল্পের ব্যয় নিরূপণের জন্য অভিজ্ঞ আধিকারিক এবং ব্যাঙ্ককর্তাদের নিয়ে কমিটিও ছিল। পঞ্চায়েত, প্রশাসন, ব্যাঙ্ক নিয়ে ব্লক থেকে জেলা স্তরের কমিটির মাধ্যমে প্রকল্পগুলির অগ্রগতি বিষয়ে নিরন্তর সমন্বয় সাধন করা হত। সরকারি ক্যান্টিন, হাসপাতালের টুকিটাকি জিনিস সরবরাহে অগ্রাধিকার পেত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি। বিপণনের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর সবলা মেলা আজও সংগঠিত হয়।

প্রধানত তিনটি কারণে ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্পটি গতিহারা হয়েছে। এক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবারের কর্তার দ্বারা প্রকল্প ব্যয়ের মূলধনের অপব্যবহার। দুই, ব্যাঙ্কের ঋণ দেওয়ার অনীহা। তিন, পঞ্চায়েতের অগ্রাধিকার তালিকায় মেয়েদের প্রকল্প গুরুত্ব না পাওয়া। আমার অভিজ্ঞতা, মহিলারা সাধারণত মিতব্যয়ী হয়ে থাকেন, প্রকল্পের মূলধন অপব্যবহার করার বিপক্ষেই তাঁদের অবস্থান। হাওড়ার জরিশিল্প, নদিয়ার তাঁত, মুর্শিদাবাদের সিল্ক, এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পেও মেয়েদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি প্রশংসনীয় কাজ করেছে, এবং ব্যাঙ্ক ঋণ পরিশোধও করেছে। কিন্তু সুসংহত গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প (আইআরডিপি), যা এক সময় খরস্রোতা ছিল, তা কী ভাবে ক্ষীণকায়া হল? সেই সমীক্ষার আশু প্রয়োজন। অন্যথায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো সহজ নয়। তার বিরূপ প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর পড়তে বাধ্য।

সুবীর ভদ্র, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

আস্থার সঙ্কট

‘মুছেছে ১৪.৫ লক্ষ কোটির ঋণ, তোপ জহরের’ (৭-১২) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, হিসাবের খাতা থেকে খেলাপি ঋণ মুছে দিলেও গ্রাহকের মন থেকে সেই ঋণ মুছে ফেলা যায় না! আমানত সুরক্ষিত রাখতে গ্রাহক বেছে নেন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন-যোজনার মধ্য থেকে ‘সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’। কিন্তু গচ্ছিত আমানত যদি কর্পোরেট সংস্থার হাতে চলে যায় এবং ব্যাঙ্ক যদি সেই টাকা পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ হয়, তা হলে গ্রাহকদের দশা কী হবে? সংবাদে প্রকাশ, মোদী জমানায় গত ৯ বছরে ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুছে ফেলা হয়েছে।

এই বিপুল খেলাপি ঋণে ব্যাঙ্কগুলোর নাভিশ্বাস উঠছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ‘ডিপোজ়িট ইনশিয়োরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন’ ঘোষণা করেছে, ব্যাঙ্ক বন্ধ হলেও গ্রাহক সর্বাধিক ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। কিন্তু যে সব প্রবীণ নাগরিক সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যাঙ্কে রেখেছেন, তাঁদের দশা কী হবে?

অমরেশ পাল, ব্যান্ডেল, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement