farm bill 2020

সম্পাদক সমীপেষু: খতিয়ান ক্ষতির

এই সব রাজ্যে আখ চাষিরা চিনিকলের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেন, কিন্তু বছরের পর বছর চাষিরা মালিকদের কাছ থেকে ফসলের দাম পাচ্ছেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২১ ০৪:৫৪
Share:

স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি’ (২২-২) এবং ‘বন্দুকটা কেবল চাষির ঘাড়েই’ (২৩-২) শীর্ষক চুক্তি চাষ সম্পর্কিত প্রবন্ধ দু’টি প্রসঙ্গে এই চিঠি। নয়া কৃষি বিল ২০২০ পড়ে আমার কখনও মনে হয়নি যে, এই বিল মেনে যে চুক্তি চাষ হবে, তাতে চাষিরা লাভবান হবেন। গরিব চাষিরা বৃহৎ পুঁজিপতি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন। চুক্তিতে ঠিক হবে চাষি কোম্পানির কাছে কতটা এবং কী দামে ফসল বিক্রি করবেন। আইনে আরও বলা হয়েছে যে, চাষিরা ফসলের দাম পাবেন তার গুণমান অনুযায়ী, এবং তা চুক্তির সময়েই ঠিক হবে। এর অর্থ হল— পণ্যের গুণমান বা ‘গ্রেড’-এর ভিত্তিতেই তার দাম ঠিক হবে। এই গ্রেড ঠিক করবে কোম্পানি। কোম্পানি যদি উন্নত গ্রেডের ফসল নিয়ে মন্দ গ্রেডের দাম দেয়, কী করবেন চাষি? আইনি লড়াই করতে পারবেন? এটা একটা ভয়ঙ্কর অসম চুক্তি, যা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

Advertisement

এ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চুক্তি চাষের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। যেমন— মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ। এই সব রাজ্যে আখ চাষিরা চিনিকলের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেন, কিন্তু বছরের পর বছর চাষিরা মালিকদের কাছ থেকে ফসলের দাম পাচ্ছেন না। চুক্তি চাষে কর্নাটকের ফুল চাষিরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, বি টি কটনের চুক্তি চাষে মহারাষ্ট্রের তুলো চাষিরা আত্মহত্যা করছেন। অন্যান্য দেশেও চুক্তি চাষের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষকরা চুক্তি চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ল্যাটিন আমেরিকার আমাজ়ন অঞ্চলে আমেরিকা ও ফ্রান্সের কলা কোম্পানিগুলো চাষিদের দিয়ে চুক্তি চাষ করায়। এর ফলে কলা কোম্পানিগুলো লাভবান হলেও চাষিরা হননি। এহেন চুক্তি চাষ আমাদের দেশেও চালু করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এতে পুঁজিপতিরা লাভবান হবেন, চাষি সর্বস্বান্ত হবেন।

শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান

Advertisement

শর্ত পরিবেশও

চুক্তি চাষ চাষিদের কাছে নতুন নয়। তা হলে কর্পোরেট কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি চুক্তি চাষের যে মডেলটি এসেছে, সেটা নিয়ে ভুরু কুঁচকানোর মানে কী? কেবল দলগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন? না কি এই মডেলটি পরিবেশ ও খাদ্য-সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকর বলে মনে হচ্ছে ? চুক্তি চাষের পক্ষে স্বাতী ভট্টাচার্য যুক্তি দিয়েছেন, এতে দামে স্বচ্ছতা এবং পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। বীজ ও কীটনাশক কেনার খরচ দিতে হয় না চাষিকে, দিতে হয় সেচ, সার ও শ্রমের খরচ। চাষ মার খেলে লোকসান বহন করেন ভেন্ডাররা। বহুজাতিক সংস্থার কর্মচারীরা নিজের স্বার্থেই জলবায়ুর আগাম খবর দেন, প্রতিষেধক ও রোগের ওষুধ বলে দেন। হিমঘরে রাখার ঝামেলা থেকে চাষি মুক্তি পান, এবং হার্ভেস্টার ইত্যাদি যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। অতএব, ফসল ফলানোর দায়টুকু নেওয়া ছাড়া কৃষকের আর কোনও মাথাব্যথা থাকে না।

লেখক প্রশ্ন যেখানে রেখেছেন, সেটা হল নীতির। চুক্তি চাষের মধ্যে চাষিকে ঠকানো যাতে না যায়, তা সুনিশ্চিত করার ব্যবস্থা বর্তমান চুক্তি চাষের মডেলটিতে নেই। কোনও একটা কি দুটো কোম্পানির হাতে যাতে অধিকাংশ কৃষিসামগ্রীর মৌরসিপাট্টা চলে না যায়, এবং কোম্পানি যাতে প্রাপ্য মেটানোর প্রশ্নে চাষিকে হেনস্থা করতে না পারে, মূলত এই দু’টি নিশ্চিত করতে পারলেই কৃষি আইনের মডেলটিতে (অন্তত বাংলার চাষিদের জন্য) বিশেষ খুঁত থাকবে না।

কেবলমাত্র চাষির হাতে কত টাকা এল, সেটা দিয়ে চুক্তি চাষের মডেলটি বিচার করলে তা আর এক ধরনের অপরিণামদর্শিতার জন্ম দেবে। সুস্থ অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশনীতি, সরকারি কৃষি বিভাগের কার্যনীতি এবং সুরক্ষিত খাদ্যনীতিকে এক করে দেখা দরকার। প্রথমে দেখা চাই, পরিবেশকেন্দ্রিক কৃষি নীতি বনাম অর্থ বা মুনাফা-ভিত্তিক কৃষি নীতির প্রশ্নটি।

ন্যায়ের দৃষ্টিতে বীজের নিয়ন্ত্রক হতে হবে চাষিকেই, যাতে কৃষক কৃষিবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। এটাই তো নীতি হওয়া উচিত। চুক্তি চাষে বীজ আসে কোম্পানির ঘর থেকে, স্বত্ব কোম্পানির। ল্যাবরেটরির ঘেরাটোপে যে বীজের জন্ম, তার দরকার বেশি জল, বেশি সার, বেশি কীটনাশক। তাতে মাটির উর্বরতা আর দেশি বীজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। সেচের খরচ, সারের খরচ বাড়ে। এর কোনওটারই নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কৃষকের হাতে থাকে না। তা নিয়ে নীতি কোনও কথা বলে না। গুজরাতে ন’জন কৃষক আর পেপসিকো-র মামলার কথাই ধরা যাক। কোম্পানি এই কৃষকদের কাছ থেকে কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চায় এই মর্মে যে, তাঁরা কোম্পানির প্রজাতির আলু আলাদা করে চাষ করে মান্ডিতে বেচেছেন। ২০১৯ সালে মামলার রায় কৃষকদের পক্ষে গেলেও, ভবিষ্যতের জন্য এই বার্তা রেখে গিয়েছে যে, কোম্পানি অধিকৃত বীজের নিয়ন্ত্রণের উপর কৃষকদের স্বাভাবিক অধিকারটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়।

আবার, কেবল মাত্র অর্থনৈতিক লাভের কথা মাথায় রাখতে গিয়ে, এক প্রকার ফলন এবং তার অভিঘাতে অঞ্চলের জীব ও খাদ্য-বৈচিত্র বিনষ্ট হয়। খাবারের পাত থেকে এবং রোজকার জীবন থেকে খাদ্য-বৈচিত্র বেমালুম হারিয়ে যায়। হারিয়ে যায় বহুমাত্রিক চাষের সুরক্ষা ও পরিবেশ। চাষের খরচ এবং খাবার কেনার খরচের সঙ্গে অপুষ্টির খরচ যোগ দেয়।

নীতির প্রসঙ্গই যদি আসে, তবে লাভজনক শব্দটিকে শুধুমাত্র টাকার মূল্যের চশমা দিয়ে দেখলেই কি সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না কি সমাজ, অর্থনীতি ও পরিবেশের আন্তর্জালিক, বহুমাত্রিক ও বহুস্তরীয় সম্পর্ককে দেখার জন্য অন্য কোনও চশমা দরকার?

সুদেষ্ণা দত্ত, কলকাতা-১৩৭

বিপন্নতা

চুক্তি চাষ প্রসঙ্গে স্বাতী ভট্টাচার্যের দু’টি প্রবন্ধের প্রসঙ্গে বলি, প্রান্তিক চাষিদের দুরবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক দিকে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্য দিকে বাজারব্যবস্থার অনিয়ন্ত্রিত শোষণ তাঁদের চরম অনটনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাঁরা পড়ছেন উভয়সঙ্কটে। ক্ষুদ্র চাষি হয়েও গৃহস্থের সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকা, জমিটুকু বুকে ধরে রেখে সংসারের ঘানি টানা। তিনি ‘জমির মালিক’, এই চিন্তার মায়া ত্যাগ করে খেতমজুর, দিনমজুরদের দলে ভিড়তে দোটানায় পড়ছেন। পরবর্তী প্রজন্ম পরিযায়ী শ্রমিকদের দলে নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছেন। চাষির কী অপরাধ যে তিনি ন্যায্য মূল্য পাবেন না? তাঁদের উৎপাদিত ফসলের উপর ভোগবাদী সমাজ গা ভাসাবে, আর কৃষকসমাজ দুর্ভোগ পোহাবে, এটা কত দিন চলবে? চুক্তিতে চাষি লাভবান হচ্ছেন ঠিকই, তবে চুক্তির বিপদও আছে। তাই সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

মহম্মদ নূরেন্নবী, ময়ূরেশ্বর, বীরভূম

দূরত্ব

স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘নজর চাষির আয় বৃদ্ধি ও বিমায়, ফড়ে রইলই’, (১৭-২) প্রতিবেদনে রাজ্যের কৃষি ক্ষেত্রের চিত্রটি উঠে এসেছে। দেখা যাচ্ছে, রাজ্য সরকার ২২টি জেলায় (কলকাতা বাদ দিয়ে) যে ১৮৬টি কৃষক বাজার তৈরি করেছে, সেগুলি কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য আদৌ কোনও কাজে লাগছে না। এর কারণ অবশ্যই কৃষক বাজারগুলি ব্লক, গঞ্জ বা মফস্সল থেকে প্রায় ৫-১০ কিলোমিটার দূরে তৈরি হয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা গাড়ি ভাড়া করে কিসান বাজারে ফসল বিক্রি করতে যেতে আদৌ আগ্রহী নন। অধিকাংশ কিসান বাজারগুলি কার্যত ফাঁকাই পড়ে রয়েছে।

কিসান বাজারগুলিতে ফসল বিক্রির ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হলে প্রত্যেক কৃষককে ফসল পৌঁছে দেওয়ার জন্য কুইন্টাল প্রতি ৫০-১০০ টাকা গাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া জরুরি। কিসান বাজার তৈরির অভিপ্রায় কার্যত বিফলেই গিয়েছে বলে কৃষকরা মনে করছেন।

তুষার ভট্টাচার্য, কাশিমবাজার, মুর্শিদাবাদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement