Opposition Alliance

জটিল জোট-অঙ্ক

আসন ভাগাভাগি মসৃণ না হলে ‘ইন্ডিয়া’ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আসন ঠিকঠাক ভাগাভাগি হলে তবেই যে কোনও রাজনৈতিক জোট সফল হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৩ ০৪:২৮
Share:

বিরোধী জোটের মূল লক্ষ্য— বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা। —ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধ ‘যোগ-ভাগের অঙ্ক’ (২৭-৭)-এ ইন্ডিয়া জোটের পশ্চিমবঙ্গ-ভিত্তিক সমস্যার যে সব কথা বলেছেন, তা অমূলক নয়। কিন্তু কিছু জায়গায় তিনি ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন। যেমন, রাজ্য স্তরে জোট না হলে তৃণমূলের কোনও মুশকিল নেই, মুশকিল হবে কংগ্রেস এবং সিপিএমের। তৃণমূল নেত্রী আগে থেকেই বলে রেখেছেন যে, মেঘালয়ে দু’টি আসনের বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে তিনি দু’টি আসন ছাড়তে পারেন। সিপিএম-কে এ রাজ্যে কোনও আসন ছাড়ার কথা এখনও পর্যন্ত বলেননি তিনি।

Advertisement

আসন ভাগাভাগি মসৃণ না হলে ‘ইন্ডিয়া’ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আসন ঠিকঠাক ভাগাভাগি হলে তবেই যে কোনও রাজনৈতিক জোট সফল হয়। এখানে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই বলে কিছু হয় না। রাজ্যে জোটের আসন ভাগাভাগি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে কংগ্রেস, তৃণমূল এবং সিপিএমের মধ্যে, প্রবন্ধকার শুধু তার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু, অন্যান্য রাজ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, তার কোনও উল্লেখ করেননি।

প্রসঙ্গত, জোটের মূল লক্ষ্য— বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকা। সেটা কয়েকটি রাজ্যে সম্ভব না হওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল। যেমন, পঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, কেরল, মেঘালয় ইত্যাদি। যে সব রাজ্যে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই, সেখানে জোটের কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু যে সব রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি নিজের জোরেই জিততে পারে, সেখানে তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলকে আসন ছাড়বে কেন? যেমন, পশ্চিমবঙ্গে সনিয়া গান্ধীর অনুরোধে তৃণমূল কংগ্রেসকে দু’-একটা আসন ছাড়লেও, সিপিএমকে ছাড়বে কেন? তেমনই, পঞ্জাব এবং দিল্লিতে আপ কংগ্রেসকে কোনও আসন ছাড়বে না। মহারাষ্ট্রে এনসিপি এবং শিবসেনা ভাগ হয়ে যাওয়াতে দুটো দলই দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেখানে কংগ্রেস এই দু’টি দলকে বেশি আসন ছাড়বে না। তখন এই তিনটি দলের মধ্যে আবার একটা মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে পারে। বিহারে তেজস্বী যাদব যতই নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী করে সরকার গঠন করুক না কেন, লোকসভায় কিন্তু নীতীশ কুমারকে তেজস্বী যাদব বেশি আসন ছাড়বেন না। কারণ, বিহারে জেডিইউ দলের সেই জনভিত্তি নেই।

Advertisement

এমনকি এ রাজ্যে কংগ্রেস ভাগও হয়ে যেতে পারে। রাহুল-সনিয়া গান্ধী যদি দুটো আসনের বিনিময়ে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেন, তা হলে অধীর চৌধুরী তা মেনে নেবেন না। ১৯৬৭ সালে অজয় মুখোপাধ্যায় যেমন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে ‘বাংলা কংগ্রেস’ নামে একটি দল করেছিলেন এবং যুক্তফ্রন্টে শামিল হয়েছিলেন, তেমন ভাবেই অধীর চৌধুরীও কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা দল গঠন করে সিপিএমের সঙ্গে শামিল হতে পারেন।

অতএব, এই ‘ইন্ডিয়া’ সর্বাত্মক জোট নয়, হবেও না। এই জোট কার্যত অংশিক জোটে পরিণত হবে। ভারতে জোট সরকারের যে ইতিহাস আছে, তা খুব একটা সুখকর নয়। একমাত্র নরসিংহ রাও এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী ছাড়া কেউ পূর্ণাঙ্গ সময়ের জোট সরকার চালাতে পারেননি।

কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০

লাভ জোটেরই

দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। পটনার পর বেঙ্গালুরু, ২৬টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের জোট আইএনডিআইএ (ইন্ডিয়া) যত এগোচ্ছে, শাসক দল বিজেপির তত অস্বস্তি বাড়ছে। কারণ, ওরা জানে গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একক ভাবে ৩০৩টি আসন পেলেও ভোট প্রাপ্তি ছিল ৩৭.৭৬ শতাংশ। সুতরাং, আগামী লোকসভা নির্বাচনে যদি কোনও ভাবে বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে পারেন, তা হলে বিজেপিকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিরোধীদের যে যেখানে শক্তিশালী, সেই আসনগুলোকে চিহ্নিত করে যদি ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াই করা যায়, তবেই ২০২৪ সালে কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন সম্ভব।

এখন বড় প্রশ্ন বিরোধী ঐক্য কি আদৌ সম্ভব? বেশির ভাগ রাজ্যেই বিরোধীরা বহুধাবিভক্ত। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও জোটের জট খুব জটিল। প্রবন্ধকার সঠিক ভাবেই উল্লেখ করেছেন, জোট সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল আসন সমঝোতা, যা কিনা আমাদের রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সর্বভারতীয় স্তরে দুই শরিক তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেসের মধ্যে প্রায় অসম্ভব। তবে এ রাজ্যের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের প্রতিপক্ষ বিজেপির অবস্থা মোটেই ভাল নয়। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, সবেতেই বিজেপির ভোট কমেছে। অপর দিকে, সামান্য হলেও বাম-কংগ্রেসের ভোট বাড়তে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের সামনে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ তৈরি হয়েছে— এক দিকে বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে পাঠিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করা, অপর দিকে তৃণমূলের থেকে কিছু আসন ছিনিয়ে নিয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটা দখল করা। এতে আখেরে সর্বভারতীয় স্তরে লাভ কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ জোটেরই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি সম্ভব? ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, সম্ভব। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল সিপিআইএম-এর সঙ্গে কংগ্রেসের। নির্বাচনের পরবর্তী কালে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে সমস্ত রাজনৈতিক তিক্ততাকে দূরে সরিয়ে রেখে বামপন্থীরা সমর্থন করেছিলেন প্রথম ইউপিএ সরকারকে, যার নেতৃত্বে ছিলেন মনমোহন সিংহ।

সুতরাং, আমাদের রাজ্যে যদি এ বারের লোকসভা নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের দুই শরিকের মধ্যে সরাসরি লড়াই হয়, তবে রাজ্য ও দেশ— দুইয়ের পক্ষে তা খুব একটা ক্ষতিকর হবে না।

শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি

শক্তিশালী হোক

দেবাশিস ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা গত দু’টি লোকসভা নির্বাচনের আগেও হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব‍্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ বারও এই জোট কত দূর এগোতে পারবে, সেটা সময়ই বলবে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক বাধ‍্যবাধকতা কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে বাধ‍্য করছে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে। কিন্তু সদ‍্যসমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখেছে, কী ভাবে সন্ত্রাস চালিয়ে শাসক দল অন্যান্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের শুধু মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়নি, কংগ্রেস, সিপিএম-সহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদের নির্মম ভাবে হত্যাও করেছে। সুতরাং, পটনা বা বেঙ্গালুরুতে এসি ঘরে বসে কংগ্রেস হাই কমান্ড-এর পক্ষ থেকে যদি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকে নিঃশর্ত সমর্থনের কথা ঘোষণা করা হয়, তবে তা নিচুতলার কংগ্রেসকর্মীরা কতটুকু মানবেন, সন্দেহ আছে। একই কথা সিপিএম কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য। তৃতীয়ত, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ‍্যগুলিতেও কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা এ ধরনের সমঝোতার পুরোপুরি বিরোধী। চতুর্থত, সংখ্যালঘু ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যে আইএসএফ-এর নেতা নওসাদ সিদ্দিকী-র উত্থান একটা বড় ঘটনা। আগামী লোকসভা নির্বাচনে আইএসএফ-ও সামান‍্য হলেও ভোটবাক্সকে প্রভাবিত করবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, কর্নাটকে বিজেপি পরাজয়ের পিছনে ছিল বোম্মাই সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষও গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্তমান তৃণমূল সরকারের একাধিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করছেন। সুতরাং, কংগ্রেসের পক্ষে নিজেকে শক্তিশালী না করে প্রথমেই দুর্নীতিগ্রস্ত দলগুলির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় আসার চেষ্টা করার অর্থ দাঁড়ায়, পচা শামুকের খোলে পা কেটে নিজেরই যাত্রা ভঙ্গ করা।

অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement