বাবা এবং মা, উভয়ের সমান অধিকার যেন সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় প্রতীকী ছবি।
সোনালী দত্ত তাঁর ‘মা সন্তানের অভিভাবক নন?’ (২০-১২) শীর্ষক প্রবন্ধে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। আমি প্রবীণ নাগরিক। মনে পড়ে, সালটা ছিল ১৯৭৬। বরাহনগরের একটি সুপরিচিত স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে প্রায় ৭০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে সম্ভবত ৬০ জন ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছিল, যার মধ্যে আমার ভাগ্নে ছিল। ভর্তির সময় ফর্মে অভিভাবক হিসেবে ওর বাবা, অর্থাৎ আমার ভগিনীপতির স্বাক্ষরের প্রয়োজন ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে, তিনি তখন বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজিতে রোগাক্রান্ত হয়ে ভর্তি ছিলেন। পাঁচ বছরের ভাগ্নেকে নিয়ে ভর্তি করাতে গেলাম। অফিস থেকে বলা হল, ছাত্রের বাবাকে উপস্থিত হয়ে অভিভাবকের জায়গায় স্বাক্ষর করতে হবে, না হলে ভর্তি নেওয়া যাবে না। আমরা সব কিছু খুলে বললাম। এমনকি হাসপাতালের কাগজপত্রও দেখালাম। কিন্তু ওঁরা বললেন, আইন নেই। অবশেষে স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফে এক জন সব শুনে অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে বললেন জায়গাটা ফাঁকা রেখে দিতে, বাবা সুস্থ হয়ে এসে সই করে দেবেন। আমার বোনকে সই করতে হয়েছিল কি না, মনে করতে পারছি না। অবশেষে আমার ভাগ্নে ভর্তি হয়েছিল এবং সে আজ প্রতিষ্ঠিত। উপরোক্ত প্রবন্ধে লেখা ‘হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৬’ আইনের উল্লিখিত তথ্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে কিছু ক্ষেত্রে পিতা-মাতা দু’জনেই অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃত হলেও, প্রাধান্য থাকে আইনত পিতারই। এর পিছনেও হয়তো অনেক যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে, যেগুলি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তবে সেই কারণগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সমাজ সংস্কারক, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, জনপ্রতিনিধি এবং আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যালোচনা করে এই আইনের সংশোধন করা প্রয়োজন। অভিভাবক বলতেই কেবলমাত্র পিতাকেই যেন একতরফা না বোঝানো হয়, এবং উভয়ের সমান অধিকার যেন সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা ও তা কার্যকর করার সময় এসেছে বলে আমিও মনে করি।
মুকুল বাগচী, ডানকুনি, হুগলি
প্রথম অভিভাবক
‘মা সন্তানের অভিভাবক নন?’ প্রবন্ধে একটি জরুরি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এখন স্কুলে মা ও বাবা দু’জনের নামই অভিভাবক হিসেবে থাকে। কিন্তু সাধারণ ভাবে দেখা যায়, যে কোনও প্রয়োজনে অভিভাবক হিসেবে বাবাকেই ডাকা হয়। অথচ আমরা জানি, সন্তানের লালনপালন, ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী পড়া তৈরি করিয়ে দেওয়ার কাজের অনেকটাই মা করেন। সে ক্ষেত্রে মাকে ডাকলে সন্তানের বেশি উপকার হবে। স্কুলে ভর্তির মতো, পাসপোর্টেও মায়ের নাম দিতে হয়। এখন ব্যাঙ্কে কেওয়াইসি ফর্ম পূরণ করতে হলে, বা অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে মায়ের নাম পরিচয় লিখতে হয়। কিন্তু ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডে অভিভাবক হিসেবে মায়ের নাম লিখতে হয় না, যেটি করা অত্যাবশ্যক ছিল। মা তো শুধু জন্মদাত্রী নন, পালন-পোষণ, দায়িত্ব গ্রহণ, সব ব্যাপারে সন্তানের সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকেন। তাই অভিভাবক হিসেবে তাঁরই নাম প্রথমে থাকা উচিত। যতই আমরা, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ বলি, অভিভাবক হিসেবে তাঁকে সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার স্বতঃস্ফূর্ত চেষ্টা দেখা যায় না। কয়েক বছর আগে ক্রিকেটাররা নিজেদের নামের সঙ্গে মায়ের নাম, পদবি জার্সির পিছনে লিখে একটা প্রচার করেছিলেন, তা দৃষ্টান্তমূলক।
লেখক অনেক মামলার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, বিচারপতিরা প্রায় সব পরিস্থিতিতে অভিভাবক হিসেবে মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার রায় দিয়েছেন। কিন্তু সামাজিক ভাবে সে অবস্থান পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়নি আজও। সমাজের ‘জ্যেষ্ঠতাত’-এর ছড়ি ঘোরানো চলছেই। লেখকের কথায়, “সমাজের বটতলার ‘অভিভাবকত্ব’ এবং ‘পৌরুষ’ আজও একই হুঁকোর নল নিয়ে টানাটানি করছে।” এই অবস্থার আশু পরিবর্তন দরকার। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং শিক্ষা বা কর্মজীবনে যেখানেই দরকার, মায়ের নাম অভিভাবক হিসেবে প্রথমেই রাখতে হবে।
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
সংযোগহীন
‘মুঠোফোনে মগ্ন, একা’ (২৩-১২) প্রবন্ধে মুঠোফোনের দাপটে আমাদের অসহায়তার গভীরতা সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন শ্রীদীপ। সোনার কেল্লা সিনেমায় ‘সাত নম্বর যতীন দাস লেন’ খোঁজার সংলাপটি হয়তো বাদ যেত, যদি ছবিটি মোবাইল-উত্তর এই যুগে তৈরি হত। ‘মুঠোফোন-মনা’ আমরা অ্যাপ মারফত জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করতে গিয়ে বাড়ির বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা ভুলতে বসেছি। এটি যে কত ভয়ানক প্রবণতা, তার প্রমাণ পাওয়া গেল কয়েক মাস আগে, বাঁকুড়ার বিহারীনাথ পাহাড় থেকে ফেরার সময়ে। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে গাড়ির ড্রাইভার দাদা গুগল ম্যাপ দেখতে দেখতে স্বল্প দূরত্বের পথ অনুসরণ করে দুর্গাপুর পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পথে সেতুবিহীন দামোদর নদের কথা গুগল ম্যাপ জানায়নি। ফলে দীর্ঘ পথ পুনরায় পাড়ি দিতে হল।
কেবল প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে জীবন একটা পর্যায় পর্যন্ত চলতে পারে। আমরা দুনিয়ার মানব সমাজ ও প্রকৃতিকে মুঠোবন্দি করে নিয়ত পথ চলি। অথচ, পাশের ঘরের নিকটজনের খবর নিই না। বাস্তব জীবনকে নিয়ত এড়িয়ে ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’ নির্ভর করায় এক স্পর্শহীন অতিবাস্তবে বাস করছি আমরা। কিন্তু নিকটজন ও প্রতিবেশীদের আন্তরিকতার ঘাটতি যে থেকেই যায়। সেই কারণেই ন্যূনতম মনান্তর হলেই নির্দ্বিধায় ‘আনফ্রেন্ড’, ‘আনফলো’, ‘ব্লক’ করার বন্যা বইছে।
তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
একাকিত্ব
‘মুঠোফোনে মগ্ন, একা’ প্রবন্ধটি মন ছুঁয়ে গেল। মোবাইল মগ্নতায় অধিকাংশ মানুষই আজ যেন এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। শারীরিক ভাবে যে কোনও জায়গায় অবস্থান করা সত্ত্বেও, মোবাইলে আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় যে কোনও সময় মানুষ প্রবেশ করছে তার নিজস্ব ভার্চুয়াল জগতে। সম্মুখে, সাক্ষাতে উপলব্ধ ব্যক্তিদের পারস্পরিক অভিব্যক্তি ও অনুভূতি প্রকাশের মতো সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সেই ভার্চুয়াল সমাজে অনুপস্থিত। সেই দুনিয়ার আদান-প্রদান থেকে পরে রোমন্থনের জন্য সঞ্চয় করে রাখার মতো স্মৃতি তৈরিই হয় না। এক্সপ্রেস ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা আপাত-চলমান দৃশ্যের দ্রুত পট পরিবর্তনের মতো, চিত্তচঞ্চল মানুষের ব্যস্ত আঙুল দৌড়ে বেড়ায় মোবাইলের অ্যাপ থেকে অ্যাপে। সমাজমাধ্যমে নিজেকে জাহির করার সময় নিজের সীমিত জ্ঞান ভান্ডারকে উজাড় করতে গিয়ে সমালোচিত হলেই একমাত্র ছিন্ন হয় ভার্চুয়াল সম্পর্ক।
আজকাল মণ্ডপের অভ্যন্তরে প্রতিমা দর্শনের সময়, বহমান জনস্রোতের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মোবাইল ক্যামেরায়। ফ্রিজ় শট, সেলফি কিংবা লাইভের বহর দেখে অন্তর্যামীও হয়তো পুলকিত হন। সমাজমাধ্যমে আপলোড করা সে সব ছবির লাইকের সংখ্যাই যেন ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি। মুঠোফোনে ভার্চুয়াল আড্ডায় অভ্যস্ত মানুষ, বড় একা। কারণ, সেখানে অডিয়ো, ভিডিয়ো, ছবি, লেখা ইত্যাদি শেয়ার করা গেলেও হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, রাগ-অভিমানের মতো মানবিক অনুভূতিগুলো শেয়ার করার জায়গা নেই। ভার্চুয়াল জগতে বিশাল ক্লাউড স্টোরেজ আছে বটে, কিন্তু বার্তাবাহক মেঘদূতের মতো হৃদয় নেই। মোবাইল মগ্নতায় সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে এ ভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে একাকিত্বের অসুখ। আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া মুক্তির উপায় আপাতত অসম্ভব।
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা