ছবি: সংগৃহীত
মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখার ব্যাপারে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পরীক্ষকদের জন্য যে নয়া ফরমান জারি করেছে, তা মেনে, এত অল্প সময়ে খাতা দেখা কী ভাবে সম্ভব, সেই চিন্তায় পরীক্ষকদের মধ্যে চূড়ান্ত বিভ্রান্তি এবং উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পুরো নম্বর না দিলে পরীক্ষার খাতায় প্রতি প্রশ্নের পাশে তার কারণ লিখতে হবে। বানান ভুল হলে নম্বর কাটা যাবে না। আবার, প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরের পাশে পাশে অংশগুলোর প্রাপ্ত নম্বর ছক কেটে দেখাতে হবে এবং এতগুলো ছক স্কেল পেনসিল দিয়ে পরীক্ষককেই কেটে নিতে হবে। ভূভারতে কোথাও এই ভাবে এক এক জন পরীক্ষকের পক্ষে সারা দিন স্কুল করে, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ইনভিজিলেশন দিয়ে, তার পর ১৫ দিনে ১৫০টি করে খাতা দেখা সম্ভব কি না, তা বিশেষজ্ঞ কর্তাব্যক্তিরাই জানেন। অর্থাৎ, পর্ষদ কর্তৃপক্ষ মনে করছেন যে, পরীক্ষকেরা অকারণে পরীক্ষার্থীদের কম নম্বর দিচ্ছেন এবং প্রশ্নের বিভিন্ন অংশ ভাল ভাবে দেখছেন না। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের উত্তরপত্র মূল্যায়নের যোগ্যতা সম্পর্কে পর্ষদ কর্তৃপক্ষেরই যে আস্থা নেই— সেটা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের সামনে স্পষ্ট করে দিলেন।
এটাই প্রথম নয়। এই ধরনের অবাস্তব এবং শিক্ষকদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা একটার পর একটা সরকারি ফরমান দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই স্কুলে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। যেমন, গত বছরই সব শিক্ষককে একটা করে ডায়েরি দেওয়া হল। তাতে প্রতি দিন কোন পিরিয়ডে কী পড়াচ্ছেন, সে সম্পর্কে দুর্বোধ্য শিরোনামওয়ালা নোট লিখতে হবে। ডায়েরিটির ছক আবার ভুল। প্রতি পাতায় একটিই ক্লাস এবং বিষয়ের নাম লেখা যাবে, অথচ পিরিয়ড আটটি। যেন এক শিক্ষক আট পিরিয়ড ধরে একই ক্লাসে একই বিষয় পড়িয়ে যাবেন। অনুরূপ একটি করে ডায়েরি সব ছাত্রকেও দেওয়া হয়েছিল, যাতে তারা কোন শিক্ষক কোন ক্লাসে কী পড়ালেন তা নোট করবে এবং ক্লাস শেষে শিক্ষক সেটা সই করবেন। ক্লাস শেষে শিক্ষক যদি ৭০টি ছাত্রের ডায়েরি সই করতে থাকেন, তা হলে পরের পিরিয়ড কী করে শুরু হবে, শিক্ষকই বা অন্য ক্লাসে কখন যাবেন, এ সব প্রশ্ন সুকুমার রায় বর্ণিত টাকচুড়ো নগরের ফুটো গামলায় সাগর পাড়ি দেওয়া পণ্ডিতদের মতো, কেউ ভাবেনি। শুধু তা-ই নয়, এত জন ছাত্র শিক্ষকের ডায়েরি আবার প্রতি দিন প্রধান শিক্ষককে সই করতে হবে। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের চরিত্র ‘মেজদা’র ওই ‘থুতুফেলা’, ‘তেষ্টা পাওয়া’ টিকিট খাতায় এঁটে তাতে সময়ের নোট লিখে রাখার ব্যাপারটাই বোধ হয় এঁদের প্রেরণা।
এ ছাড়া কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের একটার পর একটা ফরমানে বৃক্ষরোপণ, জঞ্জাল সাফাই, ডেঙ্গি প্রতিরোধ, করোনাভাইরাস নিয়ে গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ, হেলমেটহীন বাইকবাজকে গোলাপ দেওয়া ইত্যাদি— পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী এবং তাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদেরই প্রাথমিক দায়িত্ব— এমন একটা মনোভাব এ দেশের কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলোর কী ভাবে গড়ে উঠল, এটাও চিন্তার বিষয়। এত সব কাণ্ডের ফলে একটার পর একটা স্কুল ছাত্রশূন্য হয়ে যাচ্ছে এবং এই দায় আবার শিক্ষকদের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে। সরকারের নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপর্ষদ যখন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে প্রতিনিয়ত এই মনোভাব ব্যক্ত করছে যে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা পরিকল্পনামাফিক নিয়মমতো পাঠদান করেন না, পরীক্ষার খাতা ঠিকমতো দেখেন না, অকারণে নম্বর কম দেন, তখন অভিভাবকেরা সামর্থ্য থাকলে কেনই বা সরকারি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করবেন? বেসরকারি স্কুলগুলোর হাজার হাজার টাকার দাবিতে সম্পন্ন অভিভাবকেরও নাভিশ্বাস উঠছে, সেই সব স্কুলে গড় ছাত্রছাত্রী আহামরি কিছু তৈরি হচ্ছে তা-ও নয়, তবুও যে হেতু ‘দাম বেশি এবং ঝাঁ চকচকে দোকানে বিক্রি হচ্ছে মানেই জিনিস ভাল’ এমন একটা ধারণা চালু আছে, তাই বেশি বেশি করে অভিভাবকেরা বেসরকারি স্কুলের দিকে ঝুঁকছেন। স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল অবস্থার দায় সুকৌশলে শিক্ষকসমাজের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সরকার হাত ধুয়ে ফেলছে ঠিকই, কিন্তু তারই সঙ্গে জেনে বা না-জেনে, সরকারি স্কুলগুলো তুলে দেওয়ার পথ পরিষ্কার করছে।
পার্থ ভট্টাচার্য
ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।