Corruption

সম্পাদক সমীপেষু: জনগণই শেষ কথা

সন্ত্রাসের রূপ বদলেছে, মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রভাবশালীদের নৈকট্য অর্জন করা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৫০
Share:

—প্রতীকী ছবি।

‘সবাই করছে, তাই আমিও...’ (৫-১২) শীর্ষক পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর সময়োপযোগী ও মূল্যবান প্রবন্ধটি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক সময় যে সকল বিদ্বজ্জন গর্জে উঠতেন, তাঁদের প্রতিবাদের কলম এখন বন্ধ। যে কোনও গঠনমূলক সমালোচনাও শাসক সহ্য করতে পারে না। শাসনকাঠামোর নীচ থেকে উপর পর্যন্ত যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভয়াবহ অনৈতিক, অন্যায় কাজে, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন প্রবল ভাবে সমাজের সর্বত্র বিরাজ করে সন্ত্রাসের পরিবেশ। বাম আমলে এই সন্ত্রাস প্রকাশ পেত এক দল লাঠিয়াল বা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর দ্বারা প্রতিবাদী মানুষটিকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে। এখন সন্ত্রাস প্রকাশ পায় প্রতিবাদীকে মিথ্যা মামলা করে ফাঁসিয়ে জেলে ভরে অথবা চাকরিজীবী হলে দূরদূরান্তে বদলি করার মধ্য দিয়ে।

Advertisement

সন্ত্রাসের রূপ বদলেছে, মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, দুর্নীতিগ্ৰস্ত ও দুর্নীতিবাজদের সংখ্যাধিক্য এবং প্রভাবশালীদের নৈকট্য অর্জন করা। প্রভাবশালী নেতাদের কাছের লোক তাঁরাই, অচ্ছুত প্রতিবাদীরা। দুর্নীতিগ্ৰস্তরা এক দিকে যেমন স্থানীয় প্রশাসন ও নেতাদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে, আবার দুর্নীতির অর্থের কিছুটা অংশ জনস্বার্থে দান করেও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন চিট ফান্ড যেমন অতীতে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে কোটি কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে তুলতে সমর্থ হয়েছিল, নিয়োগ দুর্নীতির নেটওয়ার্কও তেমনই সর্বগ্ৰাসী। কে নেই এই নেটওয়ার্কের মধ্যে, ছোট বড় কর্মী, নেতা থেকে অনেক শিক্ষক পর্যন্ত।

আর দুর্নীতি বিষয়ে লজ্জাবোধ? জামাইবাবাজি অফিসে যা বেতন পায়, তার চেয়ে উপরি অনেক বেশি পায়— এই গল্প শ্বশুরমশাই বাজারে সকলের কাছে গর্বের সঙ্গে বলছেন, এমন নজির এখন প্রচুর। আসলে মাছের যখন মাথায় পচন ধরে, তখন তার লেজটা আর ভাল থাকতে পারে না। তাই দুর্নীতি যখন সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর মাথায় চড়ে, তখন সাধারণ ভাল মানুষরা এই বৃত্তের বাইরে ভাল থাকতে পারেন না। ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হতে হবে— এই ভেবে ভাল মানুষেরা এখন বোবা ও একক মানুষে পরিণত হয়েছেন। অন্য দিকে দুর্নীতিগ্ৰস্তরা সংগঠিত হয়েছে নানা ভাবে।

Advertisement

ব্যক্তি বা সমষ্টি সকলের ক্ষেত্রেই একটা আদর্শগত অবস্থান শক্তপোক্ত না হলে দুর্নীতির শিকার হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও যদি দলের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখা না হয়, তা হলে কর্মী-নেতাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা রোধ করা যায় না। পূর্বে বাম দলগুলির মধ্যে বহু ত্যাগী ও সৎ নেতা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতিগ্ৰস্তরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়ে কেবল দলের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধিকরণের দুর্বলতার জন্য। ফলে, একটা চরমপর্বে জনগণের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ প্রকাশিত হয় ভোটবাক্সে। এই ইতিহাস থেকে বর্তমান শাসক দল যদি শিক্ষা না নেয়, এর অবধারিত ফল পতনের মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হবে। ক্ষমতার দম্ভে বিবেক, বিচারবোধ সব হারিয়ে প্রতিশোধের অস্ত্রকে যত শাণিত করবে, জনগণের অন্তরে ততই ঘৃণা বৃদ্ধি পাবে। গণতন্ত্রে কিন্তু জনগণই শেষ কথা বলে, দেওয়ালের লিখন আপনি আমি পড়তে পারি, আর না-ই পারি।

সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি

দুর্নীতি রোগ

প্রিজ়মের উপর সাদা আলো পড়লে যে ভাবে সাত রঙে ভাগ হয়ে যায়, ঠিক তেমন ভাবে ‘সবাই করছে, তাই আমিও’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার আমাদের সমাজজীবনে দুর্নীতি রোগ কী ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তার বিশ্লেষণ করেছেন। সর্বকালেই দুর্নীতির শীর্ষে বাস করেন হাতে-গোনা মানুষ। আর নীচের বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগী মানুষগুলোর মাধ্যমে দুর্নীতির মধ্য দিয়ে আহরিত সামগ্রী (অর্থ) পৌঁছে যায় শীর্ষে। অনেকটা উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘অ্যাসেন্ট অব স্যাপ’ পদ্ধতির মতো, যেখানে উপরের টানে মাটির নীচ থেকে জল ও দ্রবীভূত খনিজ লবণ উপরের দিকে উঠে যায়।

যদিও অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ নিজের জ্ঞাতসারেই হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে, দুর্নীতির গোড়ায় জলসিঞ্চন করে থাকেন। ধরা যাক, বহু উপভোক্তা রেশন দোকান থেকে নিজেদের প্রাপ্য সামগ্রী না নিয়ে, বিনিময় মূল্যবাবদ অর্থ গ্রহণ করেন। তাঁরা হয়তো অজ্ঞাতসারে কোনও এক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আবার বহু মানুষ সন্তানকে কিন্ডারগার্টেনে পড়ান। কিন্তু সমান্তরাল ভাবে স্থানীয় (সরকারি বা সরকার পোষিত) প্রাথমিক স্কুলে সন্তানদের নাম নথিভুক্ত করিয়ে জ্ঞাতসারে এক প্রকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন (কারণ, নথিভুক্ত ওই ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য প্রতি দিন মিড-ডে মিল এবং সরকারি বই-খাতা, জুতো, পোশাক ইত্যাদি বরাদ্দ হয়)। এ ছাড়া সরকারি ও অসরকারি ক্ষেত্রসমূহে ঝামেলা-মুক্ত ভাবে বিবিধ পরিষেবা পাওয়ার জন্য ‘টেবিল খরচ’ নামক বাড়তি অর্থ প্রদান করেও আমরা এই দুর্নীতির লালন করি এবং কিছু ক্ষেত্রে তার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করি।

বর্তমান সমাজজীবনের প্রতিটি বাঁকে দৃশ্যমান দুর্নীতিগুলোর সঙ্গে সহবাস করতে করতে, প্রতি দিনই সেগুলো আমাদের কাছে ‘নিউ নরম্যাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে কি মানুষের নীতিপরায়ণ মনোভাব, সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ, নিজেদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রক্ষার প্রয়াস— এই ধরনের মানবিক গুণগুলো ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিপথগামী হয় না?

অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

অন্ধকার

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর প্রবন্ধটিতে হতাশা আর নৈরাশ্যবাদ বড় হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকারের দুর্নীতির দীর্ঘ তালিকা যেমন ধারাবাহিক ভাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, তেমনই সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রায় সবাই সেই পাকচক্রে ঘূর্ণায়মান, তা বিশ্লেষণ করেছেন। ‘প্রায় সবাই’— এমন ভাবনা সঠিক নয়। হ্যাঁ, দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে। আর এর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের জালও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশে প্রশাসনের চোখ বুজে থাকা এখন রেওয়াজ। কিন্তু প্রবন্ধকারের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি এর অন্যতম কারণ। কারণটি হল, সাময়িক কর্মী নিয়োগ। ‘সম কাজে সম বেতন’— বাম আমল বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে চাইলেও তারা শেষরক্ষা করতে পারেনি। প্যারাটিচার নিয়োগ সেই আমলেরই ফসল। এই সমস্ত শিক্ষক সব কাজ করলেও এমনকি একাদশ-দ্বাদশে পড়ালেও মূল্য দেওয়া হয়নি।

চলমান সময়ে সমস্ত অফিসে অনেক কর্মী নিয়োগ হয়েছে নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশে। নামমাত্র বেতনে নিয়োগ হয়েছে সিভিক পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়াররাও। অফিসের অন্যান্য কর্মী তাঁদের সহকর্মীর মর্যাদা দেন না। সরকারের দেয় অর্থে এঁদের সংসার না চলায় এঁদেরকে হাতিয়ার করেছেন দুর্নীতিবাজরা। আর তাতে দুর্নীতির সার্বিক ব্যবস্থা পাকা হয়েছে। প্রবন্ধকার ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ আর ‘দুর্নীতিবাজ’ শব্দ দু’টির মধ্যে ফারাক খুঁজেছেন। তাঁর মতে, যাঁরা ইতিমধ্যেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত; যাঁরা জড়িয়েছেন অথবা এখনও জড়াননি, কিন্তু জড়াতে কোনও নৈতিক আপত্তি নেই, বরং আসক্তি আছে, তাঁদেরকে বলতে পারি দুর্নীতিবাজ। ‘দুর্নীতিবাজ’ বিশেষণটি সেঁটে দেওয়া হল যাঁরা দুর্নীতি করেননি, অথবা করতে পারেন তাঁদের উপর। এটা কেমন ব্যাখ্যা! আজও আমাদের বিশ্বাস, লজ্জা, অপরাধবোধ, কলঙ্কের ভয়, মানসিক টানাপড়েন আমাদের দুর্নীতির পথে যেতে বাধা দেয়। দুর্নীতি তাই কখনও ছোঁয়াচে রোগ হতে পারে না। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, “এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে...”। কিন্তু আলো নেই, তা তো নয়। আসলে সমাজে বিদ্বজ্জনেরা পরিবর্তন আনেন। কিন্তু সেই বিদ্বজ্জনদের একাংশ যদি শীতঘুমে চলে যান, আর অন্য অংশটি সরকারের সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে তো ঘন অন্ধকার নামবেই।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement