শিক্ষার উন্নয়নে সদর্থক কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। নিজস্ব চিত্র।
‘দুয়ারে অশিক্ষা’ (১২-১১) সম্পাদকীয় প্রবন্ধটি খুবই যথাযথ। শিক্ষাকে বর্তমান সরকার যে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না, তার একাধিক উদাহরণ করোনার সময় থেকে লক্ষ করা গিয়েছে। অন্য অনেক রাজ্যে করোনার প্রভাব কমলে মাঝেমধ্যে কিছু দিনের জন্য স্কুল খুললেও এ রাজ্যে প্রায় একটানা দু’বছর স্কুল-কলেজ খোলেনি। অনলাইন শিক্ষা থেকেও বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত ছিল। করোনা কমে যাওয়ার পর এক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা গিয়েছিল ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের। তার পর স্কুল খুললেও গরমের অজুহাতে টানা দেড় মাস ছুটি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ প্রায় বন্ধ। ফলে বিভিন্ন স্কুলে অসংখ্য শিক্ষকের পদ শূন্য। এমনকি এই জন্য উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে অনেক স্কুল এ বছর ছাত্র ভর্তি নিতে পারেনি। অনেক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ক্লাস নিচ্ছেন— এমন সংবাদও উঠে এসেছে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সভা এবং স্থানীয় অনুষ্ঠানের জন্য স্কুল ক্যাম্পাস ব্যবহার করা এ রাজ্যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সে জন্য স্কুল পূর্ণদিবস বা অর্ধদিবস ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। এখন আবার দুয়ারে সরকার কর্মসূচিতে শিক্ষকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, দুয়ারে সরকার ক্যাম্প চলার জন্য বিভিন্ন স্কুলে এক বা একাধিক দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এ ছাড়া সময় মতো বইপত্র, স্কুল ড্রেস ইত্যাদি সরবরাহ না করা, মিড-ডে মিলে ঘাটতি— এ সব তো প্রাত্যহিক ঘটনা। সম্প্রতি বি এড কোর্সের দ্বিতীয় সিমেস্টার অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিভিন্ন বি এড কলেজে। এক পরীক্ষার্থীর থেকে জানা গেল, প্রাইভেট বি এড কলেজগুলোতে পরীক্ষার নামে প্রহসন হয়েছে। হোম সেন্টারের অনুমোদন তো দেওয়া হয়েছেই, পাশাপাশি মাইক্রো জ়েরক্স নিয়ে পরীক্ষা দিলে ইনভিজিলেটর দেখেও উপেক্ষা করেছেন পাশের হার ঠিক রাখার জন্য। সুতরাং, এ রাজ্যে শিক্ষার দৈন্যদশা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। শিক্ষার মূল্যায়ন হচ্ছে শুধুমাত্র পাশের হারে। সেই হার ঠিক রাখতে যা করণীয় তা-ই করা যাবে, এমনই মনোভাব। শিক্ষার উন্নয়নে সদর্থক কোনও পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এ ভাবে চললে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার আরও অবনমন ঘটবে, সন্দেহ নেই।
প্রদ্যোৎ পালুই, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া
ভোটে প্রয়োজন
‘দুয়ারে অশিক্ষা’ সম্পাদকীয়তে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস না নিয়ে,বার্ষিক পরীক্ষার কাজ ফেলে শিক্ষকরা কেন ছুটবেন সরকারি ভাতা অনুদানের কাজে মানুষকে পরিষেবা দিতে? যথার্থই। সমাজ গড়ার কারিগরদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনও কাজে যুক্ত করা হলে তা শিক্ষা জগতের অপূরণীয় ক্ষতিও বটে। কিন্তু ভোটের তালিকা তৈরি, কিংবা ভোটগ্রহণের মতো কাজে শিক্ষকদের যুক্ত করার কাজেরও বিরোধিতা করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে। এই বিষয়ে বলতে হয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটগ্রহণ কিংবা ভোটের সঙ্গে যুক্ত কাজকে অপরিসীম গুরুত্বের চোখে দেখা হয়, যা বিরাট স্বচ্ছতার দ্বারা ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন করেন ওই কাজে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। উক্ত কাজে তাঁদের ছাড়া অন্যদের যুক্ত করা হলে তাতে ভুলত্রুটির সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। আধার ও রেশন কার্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পাহাড়-প্রমাণ ভুল তাই প্রমাণ করে। সে দিক দিয়ে ভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষকদের দায়িত্ব বণ্টনে অন্যায়ের কিছু নেই।
সেক ইমরান, গোলকুঁয়াচক, পশ্চিম মেদিনীপুর
চূড়ান্ত অবহেলা
‘দুয়ারে অশিক্ষা’ সময়োচিত। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা দ্রুত অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে চলেছে। নির্বাচনী কাজ পরিচালনা থেকে শুরু করে সরকারের নানা ধরনের কাজ করতে শিক্ষকদের বাধ্য করা হচ্ছে। আর আছে শিক্ষকদের রকমারি ট্রেনিং, মিড-ডে মিলের বাজার করা ইত্যাদি। হাজার হাজার শিক্ষক পদ শূন্য। বহু স্কুলে এক জন মাত্র শিক্ষক। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের পরিসংখ্যান আর বাস্তবের ফারাকটা ভুক্তভোগীরাই জানেন। এই চূড়ান্ত অবহেলা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখে মনে হয় যেন সরকার শিক্ষাব্যবস্থাটির থেকে দ্রুত হাত গুটিয়ে নিতে চাইছে।
শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অথচ, জনমানসে শিক্ষকরাই আসামীর কাঠগড়ায়। তাঁদের কোনও দায়িত্ব বা দায়বদ্ধতা নেই— এ কথা ঠিক নয়। কিন্তু সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশকে যেখানে দাঁড় করানো হয়েছে, তা যে শিক্ষাদান ও গ্রহণে উত্তরোত্তর অমনোযোগী করে তুলবে, এ সত্য কি অস্বীকার করা যাবে? জাতি গঠনে শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্ব আমরা ভুলতে বসেছি। শিক্ষা যেন আর পাঁচটা সাধারণ বিষয়ের মতো একটি।
এ দেশে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় সংগ্রামের কথা মনে পড়ে। পরবর্তী কালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে আচার্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির বিকল্প জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কী অপরিসীম প্রচেষ্টা। আজকের শাসকবর্গ কি তার খোঁজ রাখেন? শিক্ষকদের তরফেই বা সরকারি কাজ করতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ কই? শিক্ষক সমিতিগুলি যদি একত্রে প্রতিবাদে নামে, তা হলে হয়তো সরকারের কানে ঢুকবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্রুত রসাতলে পাঠানোর যে বিরাট আয়োজন চলছে, তার থেকে অন্তত এই প্রশ্নে কিছুটা উপশম হতে পারে।
মদন ঘটক, সিউড়ি, বীরভূম
কাজের ক্ষতি
দুয়ারে রেশন, দুয়ারে মদ, দুয়ারে অশিক্ষা, দুয়ারে অপসংস্কৃতি, পাড়ায় সমাধান, আর কত শুনতে হবে, দেখতে হবে। কাজের কাজ কী হচ্ছে, সেটাই প্রশ্ন। সরকার যদি শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা দিত, তা হলে শিক্ষার উপর এত আক্রমণ হানত না। শিক্ষক সমাজকে যেমন খুশি কাজে লাগাতে পারত না। এক জন শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে কত রকমের কাজ করতে হয়, তার ফিরিস্তি দিতে চাই না। পাঠদানের জন্য কতটা সময় দিচ্ছেন, সেটা জরুরি বিষয়। সরকারি নানা কাজে শিক্ষকদের জড়িয়ে দিলে মূল কাজ ব্যাহত হবেই।
বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া
রাজার ভুল
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘চুপ! সরকার চলছে’ (৩-১১) দেশের বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেছে। সরকারের কাজের সমালোচনা করলেই তা হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। স্বাধীনতার আগে যেমন ব্রিটিশ সরকার ‘নেটিভ’দের কোনও রকম মন্তব্যও সহ্য করত না, ভাবত ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, বর্তমানের অবস্থাও খুব একটা পাল্টায়নি। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থায় কী রকম ভাবে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার গলা টিপে দেওয়া হয়েছিল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে কুলদীপ নায়ারের দ্য জাস্টিস বইটিতে। ব্রিটেনে একটা কথা খুব প্রচলিত, ‘কিং ক্যান ডু নো রং’, অর্থাৎ রাজা কখনও ভুল করেন না। আমাদের দেশের সরকারও সেটাই মনে করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতে সব সময় নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা রয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানও বাক্স্বাধীনতা-কে একটি মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। তা হলে কেনই বা নাগরিক সরকারের কাজের সমালোচনা করতে পারবে না, ভুল-ত্রুটি ধরতে পারবে না? বরং সরকারের কাজের সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে দেশ শাসনে সাহায্য করা নাগরিকের দায়িত্ব। এবং রাষ্ট্র সেখানে সহনশীল মনোভাব দেখাবে, এটাই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের লক্ষণ।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া