Global Warming

সম্পাদক সমীপেষু: কেন এত গরম?

বিপদ যে সত্যিই দোরগোড়ায়, হাড়ে হাড়ে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। মাঝ এপ্রিলেই কলকাতার তাপমাত্রা রাজস্থানের জয়সলমেরকে টেক্কা দিয়েছে। সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরুতে এতটাই জলাভাব, শৌচকর্মের জন্য কেনা পানীয় জলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৪ ০৬:৩৮
Share:

রাজ‍্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি কল্যাণ রুদ্রের ‘বিপদ ঘরের দোরগোড়ায়’ (১৯-৪) শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রণিধানযোগ্য। বিপদ যে সত্যিই দোরগোড়ায়, হাড়ে হাড়ে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। মাঝ এপ্রিলেই কলকাতার তাপমাত্রা রাজস্থানের জয়সলমেরকে টেক্কা দিয়েছে। সিলিকন ভ্যালি বেঙ্গালুরুতে এতটাই জলাভাব, শৌচকর্মের জন্য কেনা পানীয় জলের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন‍্য দিকে, মরুশহর বলে পরিচিত দুবাই কিছু দিন আগেই বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের জীবনযাত্রা ও বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

Advertisement

দেশের সুরক্ষাব‍্যবস্থা মজবুত করতে অরুণাচল প্রদেশের প্রায় চোদ্দো হাজার ফুট উচ্চতায় সেলা পাসের পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গপথ নির্মাণে যৌক্তিকতা থাকলেও, চারধাম যুক্ত করার জন্য উত্তরাখণ্ডে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ কিছু কাল ধরে প্রত‍্যক্ষ করা গেল, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। ভূতত্ত্ববিদ-সহ পরিবেশবিদরা নবীন ভঙ্গিল পর্বত বলে পরিচিত হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা শহরে যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন, তা কার্বন ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ থেকে কম বিপজ্জনক নয়। গাছপালা কেটে, জলাশয় বুজিয়ে নির্মাণ কাজ, অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য গগনচুম্বী অট্টালিকা, অতি ধনীদের ব‍্যক্তিগত শখ পূরণের জন্য বিলাসবহুল বাসগৃহ বা শো-রুমের মতো গ্যারাজে অসংখ্য গাড়ির উপস্থিতি— সবই প্রত‍্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে গ্ৰিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণ।

বাদাবনের প্রাচীর মজবুত করার জন্য সুন্দরবনে নতুন করে ম্যানগ্ৰোভ অরণ্যের সৃষ্টির উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু উপকূলের নিয়ম লঙ্ঘন করে সুন্দরবন বা মন্দারমণিতে হোটেল বা রিসর্ট নির্মাণে গ্ৰিন বেঞ্চের হস্তক্ষেপ ওই মহতী প্রচেষ্টায় কি জল ঢেলে দেয় না? মানুষের অপরিসীম লালসা এবং আগ্ৰাসী মনোভাব থেকে শান্তিনিকেতনের কোপাই, ডুয়ার্সের বনাঞ্চলও নিরাপদ নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে যত্রতত্র অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করা কার্যত অসম্ভব।

Advertisement

ধীরেন্দ্র মোহন সাহা, কলকাতা-১০৭

বারাসতের দশা

‘বিপদ ঘরের দোরগোড়ায়’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই। ২০১১-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উত্তর বারাসত পুরসভা ৩৪.৫০ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপ্ত একটি অঞ্চল। গত কুড়ি বছরে বারাসতের বিভিন্ন পাড়ায় একের পর এক পুরনো বাড়ি ভেঙে অসংখ্য বহুতল তৈরি করা হয়েছে। বহু চাষের জমিতে বিশাল আবাসন গড়ে উঠেছে। একাধিক আম, পেয়ারা, লিচু, কাঁঠাল বাগান, আখ খেত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বহু নিচু জমি, বড় জলাশয় বোজানো হয়ে গেছে। বারাসতের এক পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুটি নদী আজ নর্দমায় পরিণত হয়ে কাজিপাড়া স্কুলের কাছে এসে আবর্জনার ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার গতিপথ বুজিয়ে অসংখ্য বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। বারাসতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নোয়াই খাল এখন বিষাক্ত, পিচকালো জলস্রোত। গলি, রাস্তা সব কংক্রিটে মোড়া, বৃক্ষহীন।

জাতীয় সড়ক ১২ প্রসারিত করতে রাস্তার দু’পাশে সবুজ ছাদ বা চাঁদোয়া দেওয়া গাছগুলো কেটে দেওয়া হয়েছে। যশোর রোড ও ব্যারাকপুর রোডের কিছু গাছ এখনও আছে। সেগুলোকেও মেরে ফেলার চেষ্টা চলছে। টাকি রোডের পাশেও গাছপালা নেই বললেই চলে। এ কেমন উন্নয়ন! এখন এখানে কয়েকটি মাত্র জলাশয় বা পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণ হয়, বাকি ডোবা, পুকুর ও ফাঁকা স্থানগুলি আবর্জনা ফেলার জায়গায় পরিণত হয়েছে। অসংখ্য পাখি, পোকা, কীটপতঙ্গ আজ বাস্তুহারা! জলাশয়শূন্য, সবুজহীন কংক্রিট আজ বারাসতের মতো আরও অনেক শহর ও গ্রামকে ক্রমশ উত্তপ্ত করে চলেছে।

অসীম বসাক, বারাসত, উত্তর ২৪ পরগনা

সবুজের দাবি

সম্পাদকীয় ‘অধিকারহীন’ (১১-৪) প্রসঙ্গে কিছু কথা। গত ৬ এপ্রিল ভারতের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি এক পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারতের পরিবেশ ও প্রকৃতিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তা থেকে সুরক্ষা এ দেশের নাগরিকদের এক মৌলিক ও মানবিক অধিকার। সম্প্রতি একটি লেখা থেকে জানতে পারলাম, সুইডেনের বিশিষ্ট পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পরিবেশ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়ে পত্র লিখেছেন। আমাদের দেশে যাঁরা সংসদে যান, তাঁরা কত জনই বা পরিবেশ বিপর্যয় বিষয়ে সচেতন? তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে সংসদে উত্থিত হওয়া ১,৩২,৬০৬টি প্রশ্নের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশ্ন ছিল মাত্র ১২ শতাংশের মতো। এর মধ্যে ২০১৯ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে দূষণ সম্পর্কিত প্রশ্নের সংখ্যা ছিল ১২১টি, অরণ্য বিষয়ক ৬৪টি, কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্নের সংখ্যা ছিল ৫৬টি, প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে মাত্র ৭টি আর খনি সম্প্রসারণের পরিবেশগত অভিঘাত নিয়ে ছিল মাত্র ৪টি। নির্বাচনে এখনও অন্যতম বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি পরিবেশ। তবে মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গের ১৬০০ ছেলেমেয়ের উপর করা এক সমীক্ষায় প্রকাশ, প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়া ভোটারদের অধিকাংশই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা দেখে ভোট দিতে আগ্রহী।

আমার অভিজ্ঞতা বলছে, আমরা যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত করছি, তারাও পরিবেশ নিয়ে একপ্রকার নিষ্পৃহ থাকাই স্বাভাবিক মনে করেছি। তাই, চোখের সামনে সরস্বতী নদী বদ্ধ অবস্থায় দেখেও ক্ষোভ জাগে না, চন্দননগর শহরে একটার পর একটা পুকুরে ফাঁদিজাল পেতে রাখি যাতে পুকুর থেকে পাখিরা মাছ খেতে না পারে, নিয়ন্ত্রণহীন টোটো বৃদ্ধির কারণে যানজট ও দূষণ বৃদ্ধি পেলেও ‘যেমন চলছে তেমন চলুক’ বলে আমরা মেনে নিচ্ছি। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আর এরই প্রতিফলন দেখি পেশা হিসেবে রাজনীতিকে বেছে নেওয়া জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে।

প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি

বদলের পদধ্বনি

কল্যাণ রুদ্র তাঁর প্রবন্ধে পশ্চিমঙ্গের চিত্রটা আলাদা করে তুলে ধরেছেন। বিপদ আমাদের কাছে নতুন নয়। গত বছর এবং এ বছরে এপ্রিল মাস জুড়ে চলা প্রবল দাবদাহ এতটাই সহ্যসীমা অতিক্রান্ত ছিল যে, আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে। হাঁসফাঁস গরমে বৃদ্ধ ও অসুস্থদের অসুবিধা হয়েছে, জল ও বিদ্যুতের সঙ্কট দেখা দিয়েছে, স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে হয়েছে। এর কারণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং তার ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন। ২০১৯ সালে ১ জুন থেকে ১২ অগস্ট (নির্ধারিত বর্ষার সময়) যখন দক্ষিণবঙ্গের কৃষকরা প্রায় ৩০-৩৪% বৃষ্টিপাতের ঘাটতি নিয়ে ধান সময়মতো রোপণ করতে পারছেন না, তখন এই রাজ্যেই উত্তরবঙ্গে অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এটাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা বর্তমানে আলোচনার টেবিল ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী গণ আন্দোলনের চেহারা নিচ্ছে। প্রবন্ধে উল্লিখিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো ও জীবনশৈলীর পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন অভিযোজন কলাকৌশল, যেমন— ফসলের অবশিষ্টাংশ বা নাড়া না পুড়িয়ে জমিতে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে সৌরশক্তি বা বায়ুশক্তির মতো বিকল্প শক্তির ব্যবহার বাড়ানো, জৈব কৃষি, কৃষিভিত্তিক বনসৃজন, ফসল বিমা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে পরিপূর্ণতা দেবে।

এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি। আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্যকে উল্লেখ করে বলতে পারি, আমরাই সেই প্রজন্ম, যারা এই সমস্যা মোকাবিলার শেষ সুযোগ পাচ্ছি।

অর্কপ্রভ ঘোষ, বর্ধমান, পূর্ব বর্ধমান

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement