বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মহাপ্রভু হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং ভারতবর্ষ’ (রবিবাসরীয়, ২৮-৩) খুবই আনন্দ দিল। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ আন্দোলন ইসলাম ধর্মান্তকরণের প্রগতি ব্যাহত করতে সাহায্য করে, এবং সেই কারণে ভারতের অনেক অঞ্চল তাঁর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। লেখাটিতে উনি মলুটি গ্রাম প্রসঙ্গে তুহিন মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি বইয়ের উল্লেখ করে বলেছেন, ষড়ভুজ কৃষ্ণমূর্তি মলুটি ছাড়া আর কোথাও নেই। এ কথা ঠিক নয়। বাংলার বেশ কয়েকটি অঞ্চলের মন্দিরে এমন মূর্তির দর্শন মেলে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, তুহিন মুখোপাধ্যায়ের বইটির নাম মন্দিরময় মলুটী: ইতিহাস লোকাচার ও বামাখ্যাপা।
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, কিষানগড়ের রাধা বিষয়ে শিল্পী নীরদ মজুমদারের একটি প্রবন্ধ আছে। মনে হয়, তিনি পরিতোষ সেনের সঙ্গে লেখকের নামটি গুলিয়ে ফেলেছেন। তিনটি বিখ্যাত চিত্রের নেপথ্য কাহিনি নিয়ে পরিতোষ সেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছিলেন। আলেখ্যমঞ্জরী নামে বইতে নিবন্ধ তিনটি সঙ্কলিত হয়। সেই লেখা পড়েই জেনেছিলাম, কিষানগড়ের রাজা সাবন্ত সিংহ তাঁর রাজমহলের এক ক্রীতদাসীর প্রেমে পড়েন। তাঁকে শ্রীরাধিকা সম্বোধনে পত্র লেখেন, এবং বয়সকালে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনে কাটান। তাঁর সেই প্রেমিকার ছবিই রাজ্যের মুসাব্বির বা চিত্রকর, নিহালচাঁদকে দিয়ে আঁকিয়েছিলেন। ক্রীতদাসীর আসল নাম বানি-থানি। তিনি বাঙালি ছিলেন বলে শুনিনি।
মীরাবাই প্রসঙ্গে বিনায়ক লিখেছেন, তাঁর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের দেখা না হলেও চৈতন্যের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত। প্রভাবিত তো বটেই। মীরা তাঁর নিজের রাজ্য রাজস্থানের মেড়তা ছেড়ে ব্রজভূমি বৃন্দাবনে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন মহাপ্রভুর সেবক জীবস্বামীর বাস। তাঁর সঙ্গে মীরার সাক্ষাৎ হয়। সেই কারণেই মীরার উপর চৈতন্যের প্রভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল। মীরার পদের প্রসঙ্গে অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাসের অনুবাদের কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে বলি, ব্রজনন্দন সিংহ ১৯৫৮ সালে মীরা: জীবনী ও পদসঞ্চয়ন নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এর ভূমিকায় কালিদাস রায় লেখেন, “মীরার ভণিতায় বহুপদ প্রচলিত আছে। যে পদগুলি নিঃসংশয়রূপে মীরার বলিয়া বিদগ্ধ জনগণ স্বীকার করিয়া লইয়াছেন, এই গ্রন্থে লেখক সেই পদগুলিই সংকলন করিয়াছেন এবং সেগুলির বঙ্গানুবাদ দিয়াছেন।”
মীরার পদ সঙ্কলন নিয়ে বেশ কয়েকটি বই আছে। তার মধ্যে সবই যে তাঁর সৃষ্টি, তেমন নয়। মীরার পদাবলি কিছু রাজস্থানি ভাষায়, কিছু ব্রজভাষায় রচিত। পদেরও কিছু পাঠভেদ পাওয়া যায়। বিনায়ক যে পদটির উল্লেখ করে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব দেখিয়েছেন, গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধানে সেই একই পদের ভিন্ন পাঠ দেখা যায়। অন্য বইতে দু’টি লাইন হচ্ছে: “মাতু জশোধা মাখন কাজে বান্ধ্যো যাকো দাস।/শ্যাম কিশোরা ভয়ো নবগোরা চৈতন যাকো নাম।”
অর্থাৎ, মাখন তোলায় নিযুক্ত মা যশোদা যাকে বেঁধে রেখেছিলেন, সেই শ্যামকিশোর হলেন নবগোরা, চৈতন্য তাঁর নাম। বিনায়কের উল্লিখিত শেষ লাইনটিও ভিন্ন।
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি
কৃষ্ণ-উপদেশ
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মহাপ্রভু হয়ে উঠেছিলেন স্বয়ং ভারতবর্ষ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে এ পত্র। লেখক বলেছেন “ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস বা ইসকন নিয়ে ভাল-মন্দ যা খুশি ধারণা থাকতে পারে কিন্তু তার বিপুল সর্বদেশীয় ভক্তমণ্ডলী বিস্ময়ের উদ্রেক করবেই।” বিনায়কবাবু ‘ভাল-মন্দ’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, পরিষ্কার হল না। অনেকে মনে করেন, ‘ইসকন’ একটি বিদেশি সংস্থা। মনে রাখতে হবে, ইসকন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার প্রতিষ্ঠাতা এক জন বাঙালি। উত্তর কলকাতার অভয়চরণ দে। তিনি প্রভুপাদ নামে বেশি পরিচিত। জন্ম ১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক সুবর্ণবণিক পরিবারে। পিতা গৌরমোহন দে ছিলেন এক বস্ত্র ব্যবসায়ী এবং মায়ের নাম রজনী দেবী। অভয় স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন। ইসকন কী ভাবে পরিচালিত হবে, তার রূপরেখা প্রভুপাদ স্বয়ং দিয়ে গিয়েছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যা বলেছেন, তিনি হুবহু সেই কথা প্রচার করেছেন। কোনও যোগও করেননি, বিয়োগও করেননি। তিনি বিশ্ববাসীকে নির্বিশেষবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কৃষ্ণনাম প্রচার হল একটি আন্দোলন। ইসকন কোনও ব্যক্তি মালিকানা ও বংশানুক্রমিক আচার্যদের সংস্থা নয়। ইসকনকে পরিচালনার জন্য প্রভুপাদ ‘গভর্নিং বডি কমিশন’ গঠন করেছেন।
আমরা আজও প্রভুপাদকে তেমন ভাবে জানি না। অভয়চরণের গুরুদেব বৈষ্ণব শিরোমণি শ্রীল ভক্তিবেদান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাঁকে পাশ্চাত্যে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞান প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে প্রায় ৭০ বছর বয়সে তিনি কপর্দকহীন অবস্থায় খিদিরপুর ডক থেকে এক মালবাহী জাহাজে আমেরিকার নিউ ইয়র্কে পৌঁছন। সেখানে ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকন প্রতিষ্ঠা করেন। এক দশকের মধ্যে গড়ে তোলেন বিশ্বব্যাপী শতাধিক আশ্রম, ১০৮টি শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণের মন্দির, বিদ্যালয় ও পল্লি-আশ্রম। প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা ‘ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট’। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন “যারে দেখ তারে কহ কৃষ্ণ-উপদেশ।” প্রভুপাদ ভগবদ্গীতা-র বাণী ইংরেজিতে অনুবাদ ও তাৎপর্য রচনা করেন, যা একশোর অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পাশাপাশি কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত তিনি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় করে তোলেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম/ সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম।” আজ শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে শ্রীচৈতন্যের দর্শন প্রচারিত হচ্ছে। সাহিত্যিক শংকর বলেছেন, “ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের কৃতিত্ব এখনও অসাধারণ।... মাপের দিক থেকে বলতে গেলে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যা করে গিয়েছেন তা অন্য প্রচারকদের থেকে বেশি। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দও এই বিপুল সাফল্য ও স্বীকৃতি বিদেশে অর্জন করেননি।” (মানবসাগরতীরে)।
বিপদতারণ ধীবর
বেলিয়াতোড়, বাঁকুড়া
ষড়ভুজ
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে মলুটির ষড়ভুজ কৃষ্ণমূর্তির কথা জানলাম। প্রসঙ্গত, মেদিনীপুর (পূর্ব) জেলার পাঁচরোল গ্রামে চারটি বিশাল মন্দির আছে, তার মধ্যে একটি ষড়ভুজের মন্দির। এক সময় এখানে রাস, দোল, ঝুলন হত। কিন্তু আজ অবহেলায় পড়ে আছে। তবে এই ষড়ভুজ শিঙাধারী নয়, মনে হয় ষড়ভুজ চৈতন্যদেব। চৈতন্যচরিতামৃত-এ ষড়ভুজ চৈতন্যের উল্লেখ আছে। গ্রামে একটি চৈতন্য মঠও আছে। দেশে রাধাকৃষ্ণের মন্দির পর্যাপ্ত থাকলেও, ষড়ভুজের মন্দির অতি অল্প, তার মধ্যে একটি এই গ্রামে। অথচ, কোনও যত্ন নেই। প্রচারও নেই।
চতুর্ভুজ দাস
রঘুদেববাটি, হাওড়া
ওড়াকান্দি নয়
‘মমতা জিতছেন কি, প্রশ্ন ঢাকাতেও’ (২৬-৩) শীর্ষক সংবাদে লেখা হয়েছে, “ওড়াকান্দিতেই জন্ম মতুয়া ধর্মমতের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের।” কিন্তু প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের আত্মচরিত বা পূর্বস্মৃতি (প্রকাশক: কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, ১৯৯৫) গ্রন্থটি থেকে জানতে পারি, হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার সাফলিডাঙায়। এই সাফলিডাঙা ত্যাগ করেই হরিচাঁদের ওড়াকান্দি আগমন। এ সব বিবরণ গ্রন্থটির পঞ্চম অধ্যায়ে (‘আমার পূর্বপুরুষগণ’, পৃ ৭৪-৯৬) আছে। এই প্রমথরঞ্জন ঠাকুর হলেন শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের প্রপৌত্র।
অমিতকুমার বিশ্বাস
বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা