Central Government

সম্পাদক সমীপেষু: সর্বনেশে নীতি

ভারতীয় সংবিধান ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে ‘এক দেশ এক ভাষা’র নীতিকে খারিজ করেছে। এক দিকে ভারত ত্রি-ভাষা সূত্র গ্রহণ করে দেশের ঐক্যকে মজবুত করেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:৫৩
Share:

—প্রতীকী ছবি।

প্রণব বর্ধন তাঁর ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন অতীত’ (১০-১০) শীর্ষক প্রবন্ধে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় শাসকদের যে মন্ত্র ‘এক দেশ এক সব কিছু’, দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের ঐক্যের ক্ষতি করবে। এই সব এক-এক মন্ত্র, যেমন বিরোধীমুক্ত ‘এক দেশ এক দল’ বা ‘এক দেশ এক নেতা’ আসলে স্বৈরাচারের দুর্গন্ধে ভরা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এগুলো আমাদের মতো বৈচিত্রময়, যুক্তরাষ্ট্রীয়, গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে একেবারেই অচল এবং ভয়ঙ্কর।

Advertisement

এক দেশ এক নির্বাচন‌— এই নীতির পক্ষে যুক্তি দেখানো হচ্ছে, এতে নাকি খরচ কমবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এতে খরচ আরও অনেক বেড়ে যাবে। প্রথমত গায়ের জোরে‌ লোকসভা আর‌ সমস্ত বিধানসভার নির্বাচন যদি এক সঙ্গে করাতে হয়, তা হলে বেশ‌ কিছু আইন‌সভাকে তাদের আয়ু থাকা সত্ত্বেও শেষ করে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংসদীয় গণতন্ত্রে এ কথা হলফ করে বলা যায় না যে, একই সময়ে নির্বাচিত সব আইনসভাই পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ‌ করতে পারবে। সুতরাং এক সঙ্গে নির্বাচন হলেও, সবার যে মেয়াদ একই সঙ্গে শেষ হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

ভারতীয় সংবিধান ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে ‘এক দেশ এক ভাষা’র নীতিকে খারিজ করেছে। এক দিকে ভারত ত্রি-ভাষা সূত্র গ্রহণ করে দেশের ঐক্যকে মজবুত করেছে। অপর দিকে পাকিস্তান এক ভাষার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দু’টুকরো হয়ে গেছে। আর এক সর্বনেশে এক-এক নীতি হল ‘এক দেশ এক ধর্ম’-এর মৌলবাদী নীতি। ওই নীতি বর্জন‌ করে ভারত যে ধর্মনিরপেক্ষতার উদার, আধুনিক আর প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করেছে, তা ভারতের ঐক্য যথেষ্ট মজবুত থাকার আরও একটি কারণ।

Advertisement

কখনও কখনও রাস্তার‌ ধারের কোনও গাছকে খুব খারাপ ভাবে ছাঁটা হয়। দেখে মনে হয় যেন‌ এক গাছ একটিই শাখা। এ ধরনের গাছ দ্রুত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, আর একটু ঝড় হলেই মুখ থুবড়ে পড়ে ভয়ঙ্কর বিপদ‌ ঘটায়। প্রকৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে গাছের তুলনা করা যায়। যদি গাছটি স্বাধীনতার রোদ পায়, খোলা হাওয়া পায়, বিতর্ক, আলাপ-আলোচনার জল ঠিকমতো পায়, আর সংবিধানের দৃঢ় জমি পায়, তা হলে ওই গাছ একাধিক শাখা নিয়ে অনায়াসে ঝড় সামলাতে পারবে। তবে সংবিধানের জমিতে যদি একটু-একটু করে বিষ ঢালা হতে থাকে, তা হলে শুকিয়ে যাওয়া গাছটা শুধু নামেই একটা গাছ বা গণতন্ত্রের পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

একনায়কতন্ত্র সব সময় যে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে, এমন নয়। অনেক সময় তা গণতন্ত্রের আঙিনাতেই ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের প্রধান, গণতান্ত্রিক সংস্থাগুলিকে দাবিয়ে, ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, দেশে এক দেশ এক নেতার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, ইতিহাস এমন অনেক উদাহরণের সাক্ষী।

সুজিত দে, কলকাতা-১১০

মিছে খেলা

প্রতি বছর বিজয়া দশমীর সময় সিঁদুর খেলা নিয়ে নানা মনোজ্ঞ রচনা পাঠের সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। এখনকার আধুনিকা নারী, যাঁরা বেশির ভাগ সময়ে দৈনন্দিন যাপনে বিবাহিত হলেও শাঁখা, পলা, সিঁদুর পরায় বিশ্বাসী নন, যার একমাত্র কারণ হিসাবে দেখানো হয় পুরুষতান্ত্রিকতার প্রাধান্য ধ্বংস করা, সিঁদুর খেলার দিনে তা হলে তাতে যোগদান করার আগ্রহ এতটা বেড়ে যায় কেন? যে বস্তু বর্জনীয়, তাকে তো সম্পূর্ণ বর্জন করাই শ্রেয়। তা হলে কেন সময়ে-অসময়ে শুধুমাত্র ‘বাঙালি বধূ’র তকমা লাগিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় এই সমস্ত সাজকেই?

প্রতি বার প্রতিমা ভাসানের আগে সিঁদুর খেলা নিয়ে যে প্রতিবেদনগুলি প্রকাশিত হয়, সেখানে সাধারণত সধবা-বিধবা বিষয়বস্তুই প্রাধান্য পায়। কিন্তু যার বিরুদ্ধে আধুনিকা নারীরা আজকাল গলা তুলছেন এবং দৈনন্দিন যাপনে এই সব বিবাহিত জীবনের চিহ্নগুলি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার পথে হাঁটছেন, সেখানে কি ‘সিঁদুর খেলা’ বিষয়টি সত্যিই তেমন গুরুত্ব পাওয়া উচিত?

অথচ দেখা যায়, আমরা সকলেই কমবেশি এই আচারে যোগদান করি। শুধুমাত্র সে দিনের জন্য লাল পাড় সাদা শাড়ি, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, মোটা শাঁখা, পলা, লোহা সব কিছু পরে হাসিমুখে শামিল হচ্ছি এই আচার-অনুষ্ঠানে। তখন কিন্তু এক বারও মনে হয় না যেগুলিকে আমরা বর্জন করেছি দৈনন্দিন যাপন থেকে, শুধু এক দিনের জন্য কেন অল্প সময়ের জন্য হলেও তাকে আবার নিজের যাপনে ফিরিয়ে আনব? এ তো আরও বেশি কুরুচিপূর্ণ। নিজেরই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা। নিজেই যুক্তিকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী একটু এ দিক-ও দিক করে নেওয়া।

জানি না, এ প্রশ্নের কোনও উত্তর আদৌ হয় কি না! কারণ, উত্তর প্রত্যেকটি নারীর মননে চিন্তনে তৈরি হওয়া প্রয়োজন। কোনও হুজুগের বশে নয়, প্রতিবাদ যদি করতে হয়, কোনও প্রথার বিরোধিতা যদি করতে হয়, তবে তা সর্বক্ষেত্রে একই যুক্তিতে করা প্রয়োজন। কোনও নিয়ম-কানুন আচার-অনুষ্ঠানেও যেন তার ব্যতিক্রম না ঘটে।

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়, বারাসত, কলকাতা

বিপর্যয়

ভারতের একটি ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য সিকিম। তার সৌন্দর্য অপরিসীম। তাই তো বার বার লাখ লাখ মানুষ ছুটে যান সেই শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতিকে উপভোগ করতে। মানুষের বাড়তি চাহিদা মেটাতে গিয়ে সড়কপথকে করতে হয়েছে আরও প্রশস্ত। যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে। বড় বড় অট্টালিকা বা হোটেল বানাতে হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়াই। ইকোটুরিজ়্ম-এর নাম করে পাহাড়ময় ছড়িয়ে গিয়েছে হোমস্টে নামক এক জগাখিচুড়ি পর্যটনশিল্প।

নির্বিচারে বৃক্ষ ছেদন করে তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক অ্যামিউজ়মেন্ট পার্ক ও বহুতল বাড়ি, হোটেল, লজ ইত্যাদি। সম্প্রতি গোটা রাজ্যকে রেলপথে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনায় পাহাড় কেটে বসানো হচ্ছে সেবক-রংপো রেলওয়ে লাইন। তিস্তা নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এক জায়গার জল অপর জায়গায় নিয়ে ফেলা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার সূত্র অস্বীকার করে। প্রাকৃতিক নিয়মনীতি না মেনে যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে সেতু। সিকিম পাহাড়ের উপরে আছে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক জলাধার বা লেক। এমনিতেই পূর্ব হিমালয়ের এই অংশটি বয়সে বেশ নবীন। তাই এর পাথর-মাটিও অনেকটা ঝুরঝুরে, অশক্ত। ভূকম্পন প্রধান অঞ্চলের জন্য মাটি আলগা হয়ে ভিতরে তৈরি হচ্ছে বড় বড় ফাটল। সিকিম পাহাড়ের উপরে আছে বেশ কয়েকটি হিমবাহ। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য সেগুলি ক্রমশ গলে তৈরি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জলরাশি। এর সঙ্গে ভারী বর্ষণ আর মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ‘ক্লাউড বার্স্ট’-এর জন্য বাড়তি জল গিয়ে মিশছে সেই সব বড় হ্রদে। এই সব প্রাকৃতিক হ্রদ বা লেকের মধ্যে ১০-১২টির শরীর-স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। এমন জলের চাপে পাহাড়ের প্রাকৃতিক দেওয়ালে ফাটল ধরে হিমবাহ-ফাটা বন্যার ধাক্কায় মুহূর্তের মধ্যে জল মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে উপচে পড়ছে নীচে। তৈরি হচ্ছে হড়পা বান। সম্প্রতি রাতের অন্ধকারে লোনাক লেকের উপর মেঘ-ভাঙা বৃষ্টিতে চুংথাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধের জল তিস্তা নদীতে আছড়ে পড়ে। জলের তোড়ে মুহূর্তের মধ্যে নীচের সেনা ছাউনি-সহ অসংখ্য ঘরবাড়ি, ছোট বড় মোটর গাড়ি, গোলাগুলি ও যন্ত্রপাতি-সহ পুরো এলাকা ভেসে গিয়ে ২৩ সেনা কর্মী মৃত ও শতাধিক নিখোঁজ হয়ে যান। তিস্তা পাড়ের সাধারণ মানুষের অবস্থাও তথৈবচ।

প্রকৃতির নিয়মনীতি লঙ্ঘন করার ফল হিসাবে বার বার প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপ দেখেও কি আমরা তার থেকে শিক্ষা নেব না!

সঞ্জীব রাহা, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement