সে যুগে মাস্টারমশাইদের মাইনে ছিল কম, পুজোর ছুটি ছিল বেশি। ফাইল চিত্র।
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘সারা বছরের সুখ ছিল ক’দিনে’ (১৫-১০) লেখায় বাঙালির মনের কথাটাই উঠে এসেছে। সে যুগে মাস্টারমশাইদের মাইনে ছিল কম, পুজোর ছুটি ছিল বেশি। দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো শেষে হোল্ডঅলের মধ্যে সংসারের খুঁটিনাটি ভরে আমার শিক্ষক বাবা সবাইকে নিয়ে মাসখানেকের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে দেওঘর বা কাশীতে বেড়াতে যেতেন। মা-মাসিদের ‘রাঁধার পরে খাওয়া, আর খাওয়ার পরে রাঁধা’র জীবনে পছন্দের জায়গা ছিল পুরী। সে সুখও কখনও জুটত ওই পুজোর পরেই।
বর্তমান গতির যুগে হয়তো আর্থিক কিছুটা সুরাহা হয়েছে, কিন্তু সময় কম। এক শুক্রবার সন্ধের ফ্লাইট ধরে, পরের দু’দিন বেঙ্গালুরু, মাইসুরু এ-ফোঁড়, ও-ফোঁড় করে, সোমবার সকালের ফ্লাইটে এসে সরাসরি অফিস করেছিলাম। এক বার গুয়াহাটিতে গিয়ে দেখি পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল, মাইকের শব্দে কথা শোনা দায়। তবে শান্ত শিলঙে ঘরোয়া কিছু পুজোর আন্তরিকতা ভোলা যায় না। অষ্টমীর অঞ্জলি দিলাম, দুপুরে তাঁরা হাত ধরে ভোগের খিচুড়ি পায়েস খেতে বসিয়ে দিলেন। আর এক বার নবমীর ভোরের ফ্লাইটে পোর্ট ব্লেয়ার। স্পিডবোটে বারাটাং আইল্যান্ড যাওয়ার পথে সচল নেটওয়ার্ক-এর কল্যাণে কলকাতা, মুম্বই থেকে বিজয়ার শুভেচ্ছার ফোন পেয়ে মনটা কেমন করে উঠল। দিনকয়েক বাদে হ্যাভলক থেকে সন্ধেয় জাহাজে ফেরার সময় দেখি অপার্থিব মায়াময় চাঁদের নীলচে আলোয় আকাশ-সাগর ভেসে যাচ্ছে। মনে পড়ল, আজ লক্ষ্মীপূর্ণিমা!
শিখা সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১
চমকের দিন
‘সারা বছরের সুখ ছিল ক’দিনে’ শীর্ষক লেখাটি এক ধাক্কায় আমাকে নিয়ে ফেলল আমার কিশোর জীবনে, সেই সত্তর-আশির দশকে। বাবা ছিলেন রেলকর্মী। ফ্রি পাশ পেতেন বছরে দুটো। আর আমরাও সপরিবারে ঘুরতে যেতাম বছরে দু’বার, স্কুলের ছুটিতে। ভাবতাম, আমরা বুঝি বিনা পয়সায় ঘুরতে যাই, যে-হেতু ট্রেনের ভাড়া লাগে না। এখন বুঝি ট্রেনের ভাড়াটা বাকি সমস্ত খরচের একটা অংশমাত্র এবং সাধারণ বাঙালি জীবনে এই ভ্রমণখরচের টাকা, অনেকটাই। সংসারের সমস্ত খরচ বাঁচিয়ে বাবা সঞ্চয়ের অনেকটাই ব্যয় করতেন আমাদের এই বছরে দু’বার ঘুরতে যাওয়ার পিছনে।
তখন ট্রেনে যাওয়া মানে সংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণি, কয়লার ইঞ্জিন, জানলা দিয়ে গুঁড়ো কয়লার হাওয়ায় ভেসে আসা, ট্রেনটা বাঁক নিলে দেখতে পেতাম অনেক দূরে সামনের ইঞ্জিনটাকে। আমার প্রথম প্রেম সেই সব ট্রেনযাত্রা। ভ্রমণকালে আমাদের সঙ্গে ট্রাঙ্ক, হোল্ডঅল তো যেতই, সঙ্গে যেত সুচ-সুতো, ছাতা, বিছানার চাদর, ফোলানো বালিশ থেকে কম্বলও। থাকত বাবার একটা ক্লিক থ্রি ক্যামেরা, একটা রিলে বারোটা ছবি। এ ছাড়াও থাকত হাতা, খুন্তি, কড়াই থেকে রান্নার প্রায় পুরো সরঞ্জাম, এমনকি কেরোসিন তেলের স্টোভও। আর থাকত মা’র উলের গোলা আর বোনার কাঁটা, গল্প-আড্ডার সঙ্গে চলত সোয়েটার বোনা। তখন এটিএম ছিল না। যে দিন আমরা ঘুরতে যেতাম, তার এক-দু’দিন আগে বাবা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে আনতেন আর গভীর রাতে দেখতাম মা তুলোর বালিশের খোল খুলে তার ভিতরে কয়েকটা টাকার বান্ডিল ভরে আবার বালিশের খোল সেলাই করে দিচ্ছেন। আপৎকালীন টাকা থাকত ওই একটা-দুটো বালিশের খোলের ভিতর, যা প্রয়োজনে বার হত, না-হলে আবার ঘুরে চলে আসত কলকাতায়।
মনে পড়ে এক বার বম্বে (এখনকার মুম্বই) ভ্রমণে মেজোমাসিদের যেতে বললে মাসি বলল মেসোমশাইয়ের অফিসের কাজে অন্য জায়গায় যাওয়ার আছে। তবে মেসোমশাইকে দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন মোটামুটি কী রকম প্ল্যান করছি। নির্দিষ্ট দিনে আমরা রওনা দিলাম। পৌঁছনোর পর দিন দুপুরে এলিফ্যান্টা কেভ যাওয়ার জন্য গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ছাড়লে আমি চলে গেলাম সামনের ডেকে। দূর থেকে দেখছি এক ভদ্রলোক ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন চোখে রোদচশমা পরে, দেখতে যেন অবিকল মেসোমশাই। আর একটু কাছে গিয়ে দেখে চোখ কচলালাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি দূরে বসে মাসি, মাসতুতো বোনেরা হাসছে। এক দিন বাদে এসেছে, যাতে ট্রেনে দেখা না হয়ে যায়। একই হোটেলে উঠেছে চুপি চুপি। সারপ্রাইজ়।
বিশ্বদীপ কর রায়, কলকাতা-৫৪
মন্দ অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি সপরিবারে সিকিম ঘুরে এলাম। এর আগে বেশ কয়েক বার গ্যাংটক এসেছি। এমন লোডশেডিং কখনও দেখিনি। এক বার সন্ধ্যায় গিয়ে সারা রাত আলো এল না। হোটেলের জেনারেটরে আলো জ্বললেও গিজ়ার, বাচ্চার খাওয়ার জল গরম করার ইলেকট্রিক কেটলি কাজ করল না। জিনিসপত্রের দামও অস্বাভাবিক চড়া।
গ্যাংটক থেকে বহু পর্যটকই প্যাকেজে ঘুরতে যান উত্তর সিকিম। দু’রাত, তিন দিনের প্যাকেজের খরচ কোথাও ৪৫,০০০-৫৫,০০০ টাকাও চাইছে। যথেষ্ট খরচ করে প্যাকেজ নেওয়ার পরও দেখতে হল, ‘প্যাকেজ’ পর্যটকদের প্রতি পদে হয়রানি। ভাতের বদলে রুটি চেয়ে শুনতে হল, রুটি প্যাকেজের লোককে দেওয়া যাবে না। লাচেনের হোটেলে জেনারেটর অচল। যিনি লিজ় নিয়েছেন, তিনি বিদ্যুতের দাম মেটাননি। শাস্তি পাওনা পর্যটকদের। ছ’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে এসে এক কাপ করে চা আর দুটো মোমবাতি মিলল। অনেক অনুরোধের পর দু’ঘণ্টা জেনারেটর চলল মোবাইলের চার্জটুকু দেওয়ার জন্য। পর দিন গুরুদোংমার যাওয়ার আগে ব্রেকফাস্টে এক কাপ চা, আর হাতে ধরানো হল কাঁচা পাউরুটির প্যাকেট। সেঁকে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই, ডিমও নেই। লাচুং-এর হোটেলে বাড়তি পাওনা বাঙালি কর্মচারীদের অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার। চায়ের সঙ্গে বিস্কুটও নাকি ধরা থাকে না প্যাকেজে। সন্ধ্যার জলখাবার পয়সা দিয়েও মেলে না।
বহু হোমস্টে-তে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কোথাও ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট ধরিয়ে বলা হয়নি, রাস্তায় দোকানে বললে ফুটিয়ে দেবে। এমন আধপেটা খেয়ে কখনও ঘুরিনি। বরং উষ্ণ আন্তরিকতাই পেয়েছি। উত্তর সিকিমে আগত অন্য বাঙালি পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অনেকের অভিজ্ঞতাই খারাপ। এক জন বললেন, তাঁদের ঘরের মেঝে দিয়ে জল উঠছে। অভিযোগ করলেও ঘর পাল্টানো হয়নি।
এই দুর্গম পথে অনেক শিশু, বয়স্করা যান। সেখানে এমন অব্যবস্থা কেন? এমন চলতে থাকলে অচিরেই সিকিমের জনপ্রিয়তায় টান পড়বে।
উজানি দাস, কলকাতা-৫৭
দেশের অপমান
এ বছর ফিচার ফোটোগ্রাফি বিভাগে পুলিৎজ়ার পুরস্কার বিজয়ী রয়টার্স টিমের অন্যতম সদস্য কাশ্মীরের চিত্র সাংবাদিক সানা মাট্টু। আমেরিকায় সেই পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়ে তাঁকে দিল্লির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিবাসনে আটকে দেওয়া হল। এতে শুধুমাত্র এক সাংবাদিকেরই অসম্মান করা হয়নি, দেশেরও অসম্মান হল। সানার বিশ্বমঞ্চে উপস্থিতিতে তো ভারতেরই গৌরব হত। শুধুমাত্র সঙ্কীর্ণ মনোভাব এবং বিভেদ কামনার জন্যই সেই গৌরব থেকে ভারতকে বঞ্চিত করা হল। সাংবাদিকদের হেনস্থার মতো জঘন্য কাজ আগেও হয়েছে এই সরকারের জমানায়। ২০২২-এর ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর রিপোর্টে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৫০-তে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক কিছু শেখার আছে। অন্যতম উদাহরণ ঋষি সুনক, যিনি সে দেশে সংখ্যালঘু, ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হলেন। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার সঙ্কীর্ণ, বিভেদকামী মনোভাব কাটিয়ে উঠতে না পারলে দেশের পক্ষে তা মঙ্গলজনক হবে না।
রবীন্দ্রনাথ রায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ