Society

সম্পাদক সমীপেষু: শিকড় গভীরে

সংরক্ষণ ব্যবস্থাটির লক্ষ্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা— সচেতন ভাবে পিছিয়ে-রাখা মানুষদের অপূরণীয় ক্ষতির কিছু ক্ষতিপূরণ মাত্র।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:৪৫
Share:

জাতিপ্রথার দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণ হল, এর কাঠামোতে প্রত্যেক জাতি এবং জনজাতিরই একটি সুনির্দিষ্ট স্থান আছে। ফাইল চিত্র।

জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন, জাতি ব্যাপারটি ভারতীয় সমাজ থেকে এক দিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তার বদলে অম্বেডকরের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে জাতিভেদ প্রথা তার দাঁত-নখ নিয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে বিদেশেও (‘অম্বেডকর যা ভেবেছিলেন’, ২৪-৩)। অম্বেডকর বলেছিলেন, জাতিপ্রথার দীর্ঘস্থায়িত্বের কারণ হল, এর কাঠামোতে প্রত্যেক জাতি এবং জনজাতিরই একটি সুনির্দিষ্ট স্থান আছে। নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা হারানোর ভয়ে কোনও জাতিই তার নীচের জাতির সঙ্গে একজোট হয়ে সমগ্র ব্যবস্থাটিকে উপড়ে ফেলার কথা ভাবে না। সুবিধাভোগী এবং বঞ্চিত, দুই শ্রেণির মানুষই বৈষম্যকে আত্তীকরণ করেছেন এমন ভাবে যে, এটি একটি ‘স্বাভাবিক’ ব্যবস্থা বলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এবং এটাকে সচল রাখতে প্রায় কোনও বাহ্যিক শক্তিরই প্রয়োজন পড়ছে না।

Advertisement

জাতপাত প্রথার ব্যাপারটি শৈশব থেকেই মানুষের মনের গভীরে এমন ভাবে প্রোথিত হয়ে যায় যে, পরবর্তী কালে বিদেশের নামী প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রি, উচ্চশিক্ষা, বিদেশে কর্ম, এমনকি বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি, ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতাও মনকে তা থেকে মুক্ত করতে পারে না। এর জন্য মানুষের শুভবুদ্ধি উদয়ের আশায় না থেকে, আইন প্রণয়ন করাটাই অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সর্বক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের মানুষদের জনসংখ্যার হারে সমান প্রতিনিধিত্ব। প্রবন্ধের পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার যে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সেই উদ্দেশ্য বিশেষ সফল হয়নি। সংরক্ষণ ব্যবস্থাটির লক্ষ্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা— সচেতন ভাবে পিছিয়ে-রাখা মানুষদের অপূরণীয় ক্ষতির কিছু ক্ষতিপূরণ মাত্র। এটি কখনও চিরস্থায়ী সমাধান হতে পারে না, বা তেমনটা হওয়া কাম্যও নয়। কিন্তু এই নিয়ে ক্রমাগত রাজনৈতিক তরজার আড়ালে চাপা পড়ে যাচ্ছে মূল প্রশ্নটি, যার উত্তর খোঁজা একান্ত প্রয়োজন— কেন সংরক্ষণ ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে দলিতদের উচ্চপদে সমান স্থান দিতে ব্যর্থ?

ইমন মণ্ডল, হাওড়া

Advertisement

কেবল চাতুরি

নির্মম সত্যের নির্মোহ উচ্চারণ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধটি (‘আসুন, সেলফি তুলি’, ১৭-৩)। আসলে, সমাজ থেকে লজ্জা উধাও হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের ‘আপডেট’ করেছেন গণ্যমান্য, প্রতিষ্ঠিতরা। লোভ ও প্রাপ্তি, ও তাতে মহাতৃপ্তির সাধনা সব দিক থেকে দেখিয়ে চলেছেন। তাঁরা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, কলাকৃষ্টিতে কৃতিত্বের অধিকারী। তাঁদের টাকা মেঝেতে, খাটের নীচে গড়াগড়ি দিয়েছে। টাকার ব্যবহারও করা যায়নি সবটুকু। এ ভাবে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হয়ে উঠেছেন শুধু শিক্ষা নয়, যে কোনও ক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিরা। আশ্রয়, প্রশ্রয়ে কাজে লাগিয়েছেন নীচের মহলকে। শীর্ষ ব্যক্তিরা এতে সম্মত না হলে, কোনও কোনও অঞ্চলে কেউ কেউ কিছু লোককে কিছু দিনের জন্য প্রতারিত করতে পারতেন। কিন্তু দশকব্যাপী এই দুর্নীতি চলেছে, কারণ প্রাতিষ্ঠানিক যোগসাজশে কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছে। এত বড় এক আয়োজন নিরুপদ্রব করার জন্যই হয়তো আনমনা, উদাসীন থেকেছেন সেই মানুষেরাও, যাঁরা শিক্ষিত, সুধীজন বলে গণ্য হন। টাকার শক্তিতে ভেসে গিয়েছে বোধ-বিবেক। টিকে আছে কেবল চাতুরি, চাটুকারিতা। আর আইনকানুন? সে তো বাইরের দরজার প্রহরী মাত্র।

এ ভাবে ক্ষমতার ওঠাপড়ার সঙ্গে তাল দিয়ে সমাজের গণ্যমান্যরা যখন ‘বুদ্ধিমান’ হয়ে ওঠেন, যখন দুর্নীতিই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র নীতি, তখন দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুললে সম্মিলিত অনুভব হয়ে ওঠে, “ছাড়ুন তো এ সব!” সেলফি তোলার দিকেই মন যায়, শুধু ছবির ভঙ্গিটা হয় ঘাড়টা অন্য দিকে ঘুরিয়ে, শিরদাঁড়াটা বাঁকিয়ে, আনমনা উদাসীন থেকে।

মানস দেব, কলকাতা-৩৬

যক্ষ্মামুক্তি

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হল ২৪ মার্চ। আজও কত জন যক্ষ্মা রোগী এ দেশে আছেন, কত জনের মৃত্যুর কারণ যক্ষ্মা, আর কত জনই বা যক্ষ্মাজয়ী হয়েছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। এই রোগের কারণে ঘর ছাড়া, স্কুল ছাড়ার গল্পও তো শেষ হয়নি আজও। দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে যক্ষ্মামুক্ত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করেছে। আর রাজ্য ২০২৫ সালে যক্ষ্মামুক্ত হওয়ার ভাবনায় এক ধাপ এগিয়ে আছে। রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধ— এ তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিক মাত্রায় ওষুধ খেলে যক্ষ্মা রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়। তবে আক্রান্তদের অপুষ্টি থেকে বাঁচিয়ে তুলতে ‘নিক্ষয় মিত্র’ নামে দত্তক নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যে কোনও সহৃদয় ব্যক্তি অন্তত ৬ মাস উচ্চ ক্যালরিযুক্ত পুষ্টিকর খাবার জোগান দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে ওই রোগীকে রোগমুক্ত করার দায়িত্ব নিতে পারেন। তবে, অপুষ্টির করাত এই মানুষগুলিকে জখম করতেই থাকে নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে। চোলাই মদের প্রলোভন থেকে সরে আসতে পারেন না এঁরা।

নখ আর চুল ছাড়া শরীরের যে কোনও অঙ্গে যক্ষ্মা হতে পারে। তবে ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগীরাই রোগ ছড়ান। এক জন রোগী দশ জনকে তাঁর রোগের অংশীদার করে নিতে পারেন। তাই মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে পাশে দাঁড়ানো, বা ৬ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলা সমীচীন। হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ, তাই রোগীকে অবশ্যই মুখে ঢাকা দিয়ে কথা বলতে হবে। হাত ভাঁজ করে কনুইয়ের মাঝখানে মুখ রেখে হাঁচি-কাশি সামাল দিতে পারলে জীবাণু ছড়িয়ে পড়বে কম। তবে আজ আর রোগীকে আলাদা করে না রেখে, নিজের বাড়িতেই সকলের সঙ্গে রেখে চিকিৎসা করা হয়। গুরুতর অসুস্থ ছাড়া যক্ষ্মা-আক্রান্তকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। এমনকি রোগীর ব্যবহৃত থালা-বাটি, গেলাস আলাদা করাও অজ্ঞতার পরিচয় দেয়। তবে কফ, থুতু ফেলার ব্যাপারে সাবধানতা পালন অবশ্য কর্তব্য।

প্রত্যন্ত এলাকার কর্মীরা যদি যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে পূর্ণ উদ্যোগ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন, হাতের নাগালে গজিয়ে ওঠা চোলাই মদের ঠেকগুলোকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যেত, রোগীদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা যেত, অশিক্ষা ও কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা যেত, তা হলে হয়তো বলা যেত, আমরা যক্ষ্মামুক্ত ভারতের নাগরিক। না হলে ২০৩০ সালেও কি আমরা যক্ষ্মামুক্ত হতে পারব!

রীনা সামন্ত, বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর

বিবেক কী বলে

ফাঁসির পরিবর্তে বিকল্প ভাবনা বিষয়ে প্রকাশিত খবরটি (‘ফাঁসির বদলে কী, ভাবনা কমিটির’, ২২-৩) পড়তে গিয়ে একরাশ যন্ত্রণা হৃদয় ব্যথিত করে তুলল। আইন যা-ই বলুক না কেন, হত্যা কখনও মানবিক বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; তা সে ফাঁসি দিয়ে হোক, কিংবা গুলি করে, বা বিষ প্রয়োগে, বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে বা গ্যাস চেম্বারে শ্বাসরোধ করে। একটি মানুষকে ঠান্ডা মাথায় বিচার-বিবেচনা করে হত্যা করার আদেশ আইনসিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু বিবেকসিদ্ধ হওয়া কঠিন। যেমন, আত্মহত্যা কিংবা রোগযন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে স্বেচ্ছামৃত্যু মন থেকে মেনে নেওয়া যায় না। এ শুধুমাত্র যে গ্রহণের অযোগ্য তা নয়, নৈতিক অপরাধও বটে।

যদি এমন একটি কমিটি তৈরি করা যায়, যা হত্যার রকমফের বিচারের মধ্যে না গিয়ে অপরাধী মানুষকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দিতে পারে, তবে সেটিই হবে মানবিকতার এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। বছরে ক’টি মানুষকে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিতে শুনি আমরা? বিচারাধীন কালেই শরীর ও মনের উপর দিয়ে কাটতে থাকে চরম সাজা। অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হওয়া শারীরিক আঘাতের থেকেও বেশি মারাত্মক। সেই বোধ যদি জন্মানো যায়, তবে সেটাই হবে যথার্থ শাস্তি। মানবহত্যার মতো নৃশংস অপরাধ থেকে তা বাঁচাতে পারে।

বাবুলাল দাস, ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement