কোনও শিক্ষক মিড-ডে মিলের দায়িত্ব চলে গেল বলে হা-হুতাশ করবেন না, নিশ্চিত। ফাইল চিত্র।
মোহিত রায়ের ‘কাগুজে বাঘদের কর্মকাণ্ড’ (২৯-৩) প্রবন্ধে শিক্ষকদের সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, যা শিক্ষক সমাজকে পরোক্ষ ভাবে কলুষিত করেছে বলে মনে করি। উনি সরকারি স্কুল উঠে যাওয়ার পিছনে মিড-ডে মিল খাওয়ানোকে দায়ী করেছেন। বলতে চেয়েছেন, স্কুলে যত শতাংশ ছাত্র উপস্থিত হয়, তার মাত্র কয়েক শতাংশ মিড-ডে মিল খায়। কিন্তু উনি জানেন না, যত জন ছাত্র মিড-ডে মিল খায়, তত জন ছাত্রপিছু খরচই স্কুলকে দেওয়া হয়, এবং প্রতি দিন কত ছাত্র খেল, তা নির্দিষ্ট পোর্টালের মাধ্যমে রোজ আপডেট দিতে হয়। উনি বলেছেন, শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি থাকে মিড-ডে মিলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। একেবারেই ভুল কথা। বরং প্রত্যেকটি শিক্ষক সংগঠন বার বার বলেছে মিড-ডে মিলের দায়িত্ব থেকে শিক্ষকদের অব্যাহতি দেওয়া হোক। কারণ, বাজার করা থেকে রান্নার গ্যাস আভেনের ব্যবস্থা, খাবার টেস্টিং— শিক্ষকদের করতে হয়। সাম্প্রতিক কালে এই রাজ্যে পাইলট প্রোজেক্ট হিসাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে এই দায়িত্ব দেওয়া শুরু হয়েছে। এই দায়িত্ব স্থায়ী ভাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উপর বর্তালে শিক্ষকদের বহু সময় বেঁচে যাবে, এবং তাঁরা আরও ভাল শিক্ষাদানে তৎপর হবেন। কোনও শিক্ষক মিড-ডে মিলের দায়িত্ব চলে গেল বলে হা-হুতাশ করবেন না, নিশ্চিত।
লেখক বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলের ছাত্ররা প্রাইভেট টিউশনে ভারতে প্রথম স্থানে রয়েছে। ঠিক, কিন্তু বঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে টিউশনি-নির্ভরতা দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য। প্রশ্ন জাগে, যাঁরা বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করেন, তাঁরা কেন তাঁদের সন্তানের প্রাইভেট টিউশনের পিছনে টাকা খরচ করেন? তা হলে কি বেসরকারি স্কুলের পড়াশোনার উপরও এই রাজ্যে অভিভাবকরা আস্থা হারিয়েছেন?
প্রণয় ঘোষ, কালনা, পূর্ব বর্ধমান
নীতির ত্রুটি
মোহিত রায় যথার্থই বলেছেন, সরকারি বিদ্যালয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের ফল সরকারি বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মানের অবনতি, ছাত্রসংখ্যা হ্রাস, ও একের পর এক বিদ্যালয় উঠে যাওয়া। কিন্তু এটা আংশিক সত্য। সমস্যার গোড়া আজকের নয়। বামফ্রন্ট সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্যে প্রাথমিক স্তরের সরকারি বিদ্যালয়গুলি থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজির চর্চা এবং পাশ-ফেল প্রথা উঠে গিয়েছিল। তখন সরকারি স্কুলই ছিল বেশি, বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ফলে এক দিকে, এ রাজ্যের সাধারণ পড়ুয়ারা ইংরেজি ভাষাতে দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে (আজ ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি রাজ্যের মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ আসলে এরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া), অন্য দিকে, পাশ-ফেল প্রথা উঠে যাওয়ায় সাধারণ পড়ুয়াদের মধ্যে থেকে পড়া তৈরির উদ্যম চলে যায়। ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা যত ভাল শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, ছাত্ররা পিছিয়ে পড়ে।
এর পরে মাধ্যমিকেও প্রতি পেপারে পাস-মার্ক কমিয়ে ৩০ থেকে করা হয় ২৫। এগ্রিগেটে আগে ৩৪% পেতে হত পাশ করতে হলে। এ নিয়ম উঠে যায়। উচ্চ মাধ্যমিকে প্রতি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হত, দুটো পেপারে মোট ২০০ নম্বরের। সেটাও কমে হয়ে যায় একটি পেপার, ও ১০০ নম্বর। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক— দু’টি পরীক্ষাতেই একটি করে অতিরিক্ত বিষয় নিতে হত, যার একটা নির্দিষ্ট নম্বর বাদ দিয়ে তার উপরে পাওয়া নম্বর মোট নম্বরের সঙ্গে যোগ করা হত। এই নম্বর যোগের ব্যাপারটি তুলে দেওয়া হয়। ফলে, এই অতিরিক্ত বিষয়টি আজকাল আর কোনও ছাত্র নেয় না। অর্থাৎ, পুরোটা জুড়ে দেখলে আমরা দেখতে পাব, লেখাপড়ার মানের ক্ষেত্রে একটা ধারাবাহিক অবনমনের চিত্র, যার পুরোটাই নীতিগত সিদ্ধান্তের ফল। আর এই নীতি ঠিক করে সরকারের শিক্ষা দফতর, শিক্ষকরা করেন না। অথচ, মোহিতবাবু সমগ্র বিষয়টির জন্য কার্যত শিক্ষকদেরই দায়ী করলেন। শিক্ষানীতি যাঁরা ঠিক করেন, তাঁরা আড়ালেই রয়ে গেলেন।
বিগত শতকের আশির দশকে এই শিক্ষানীতির সর্বনাশা দিকটি দেখতে পেয়ে সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো মানুষ প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন, এবং সে জন্য সরকারের বিরাগভাজনও হয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৯ বছরের আন্দোলনের পরে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিকে ইংরেজি ফিরে এলেও, পাশ-ফেল প্রথা আর ফেরেনি। বরং, ২০০৭ সালে শিক্ষার অধিকার আইনের বলে ২০০৯ থেকে তা রদ হয়ে যায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ মাধ্যমিক পরীক্ষাকেও অপ্রয়োজনীয় বলে তুলে দেওয়ার কথা বলছে। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি অনুসারে সরকারি ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা হবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। এবং কোনও বইয়ের বালাই থাকবে না। ক্লাস থ্রি-ফোর-ফাইভে প্রাইমারি স্কুলে থাকবে সাকুল্যে একটি বই, মাধ্যম মাতৃভাষা। তার পরে মিডল স্কুল, যেখানে তাকে শিখতে হবে হাতে-কলমে কাজ; মাতৃভাষা পর্যন্ত ঐচ্ছিক। মাধ্যমিক পর্যায়ের চার বছরে ৮টি সিমেস্টারে তাকে মোট ৪০টি বিষয় পড়তে হবে। বলুন তো, কোন অভিভাবক এমন ‘চমৎকার’ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উপর ভরসা রেখে নিজ সন্তানকে সেখানে পড়তে পাঠাবেন?
অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ অবশ্যই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি একটা বড় আঘাত। কিন্তু সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার সেটাই মূল কারণ নয়, বিগত এবং বর্তমান রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের শিক্ষানীতিই এর জন্য মূলত দায়ী। এই মূল কথাটি অনুচ্চারিত থেকে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রবন্ধটি কিছুটা একদেশদর্শী থেকে গেল।
অরিন্দম মৈত্র, চুঁচুড়া, হুগলি
কর্মকাণ্ড
মোহিত রায় অভিযোগ করেছেন, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির ‘থ্রিলার’ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি আসলে সংবাদমাধ্যম-অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথক দাবি নিয়ে যে ধর্না মঞ্চ বসেছে, তা কোথাও দিনের পর দিন, কোথাও মাসের পর মাস, কোথাও বছরের পর বছর চলছে। বঞ্চিত প্রার্থীরা প্রাপ্য চাকরির দাবিতে, চাকরি হারানো কর্মীরা কাজ ফিরে পাওয়ার দাবিতে, সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষকরা মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাঁরাও জনগণের অংশ। তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ পৃথক হলেও, সেগুলি কখনও পৃথক, কখনও সমবেত ভাবে প্রতিটি ধর্না মঞ্চে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের দাবিকে সমর্থন জানাচ্ছে। এই সমর্থন জানানোই এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম ‘কর্মকাণ্ড’। অবশেষে সরকার পক্ষও নিজেদের দাবি ও বক্তব্য নিয়ে ধর্না ও সমাবেশ আয়োজন করল। প্রমাণিত হল, দাবি জানানোর জন্য ধর্না, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করাটাই স্বাভাবিক। আর প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের কাজই হল, এই সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা। তাকে ‘রগরগে ইসু’ বলে চিহ্নিত করলে ধর্না মঞ্চে উপস্থিত মানুষের দাবিগুলিকে হালকা করে দেওয়া হয়। এবং রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি সংবাদমাধ্যমই ঠিক করে দিচ্ছে, এ কথাও সমর্থনযোগ্য নয়। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখানো সহজ কাজ ছিল না। কেউ-না-কেউ বঞ্চিত প্রার্থীদের সাহস জুগিয়েছেন, ধর্না মঞ্চে একত্রিত করেছেন। কিছু আইনজীবী উচ্চ আদালতে মামলা করায় উৎসাহিত হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচারক এমন গুরুত্বপূর্ণ রায় দিলেন।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা