‘অব তো কাশ্মীর সে লায়েঙ্গে দুলহনিয়া...’ গানের সঙ্গে নাচে মত্ত হয়ে যখন খেটে-খাওয়া মানুষের অনেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন, তখনই পাঁচ বাঙালি শ্রমিকের হত্যার ঘটনায় বোঝা গেল, কাশ্মীর থেকে দুলহনিয়া আনা তো দূরের কথা, দু’মুঠো ভাত আনাও বোধ হয় আর সম্ভব হবে না। আসলে ক্রমাগত মিথ্যে প্রচারের ঢাকে মগজটা খাক হয় গরিব মানুষেরই। নিশ্ছিদ্র প্রহরায় থেকেও যে কাশ্মীর অগ্নিগর্ভ— এই সহজ সত্যটা অস্বীকার করলেই তো আর অদৃশ্য হয়ে যায় না। যাঁরা প্রকৃত সত্য লুকিয়ে মঞ্চে উঠে বার বার বলে গেলেন, ‘অল ইজ় ওয়েল’, তাঁরা কি সামান্য হলেও দায়ী নন এতগুলো প্রাণ হারানোর জন্য? অবশ্য রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়! যাঁরা কথায় কথায় সার্জিকাল স্ট্রাইক করেন, ‘‘এ বার ‘পি ও কে’’’ বলে চেঁচান, তাঁদের কাছে এই পাঁচটি প্রাণের মূল্যই বা কী! হ্যাঁ, অল ইজ় ওয়েল! কাশ্মীর স্বাভাবিক!
পিন্টু পোহান
কলকাতা-৮
নষ্ট নয়
2 সন্দীপন চক্রবর্তীর ‘শতবর্ষ ও শত নষ্ট সুযোগ’ (২১-১০) শীর্ষক নিবন্ধ বিষয়ে কয়েকটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। ‘সিপিএম...’ (২৪-১০) চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘‘... পশ্চিমবঙ্গের শয়ে শয়ে দুর্গাপুজোর মণ্ডপ থেকে রামশিলা পুজো করে অযোধ্যা পাঠানো হয়েছে।’’ কথাটি সত্য নয়। সেই সময়ে রাজ্যে আদৌ বিজেপির প্রাধান্য ছিল না। কয়েক জন মানুষ (শয়ে শয়ে নয়) তাঁদের আবেগের বশে রামশিলা পূজা করে থাকলেও তাতে বাধা দেওয়া সঙ্গত ছিল না। কখনও বামফ্রন্ট সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কোনও বাধা সৃষ্টি করেনি।
দ্বিতীয়ত, পত্রলেখক লিখছেন ডাইনি দাগিয়ে দিয়ে হত্যা, বধূহত্যা ও পণপ্রথার মতো কুপ্রথার বিরুদ্ধে বামফ্রন্ট সরকার কোনও কড়া আইন প্রণয়ন করেনি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এগুলির বাড়াবাড়িও ৩৪ বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে ঘটেনি। তা ছাড়া এই সময়ে রাজ্যে বিজ্ঞান মঞ্চ গড়ে ওঠায়, বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচুর আন্দোলন ও প্রচার সংগঠিত হয়।
‘...সাম্প্রদায়িকতা’ (২৪-১০) চিঠিটির উত্তরে বলি, বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থানে এই রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অটুট থাকায়, ধর্মান্ধ বা মৌলবাদী সংগঠন মাথা চাড়া দিতে পারেনি। ফলে ইন্দিরা গাঁধীর হত্যাকাণ্ডের পরে সারা দেশে ভয়াবহ দাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও, পশ্চিমবঙ্গের সকল ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অটুট ছিল। এমনকি, বাবরি মসজিদ ভাঙার পরেও গণতান্ত্রিক তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন ছাড়া কোনও হঠকারী বা বিচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়নি।
এই চিঠির লেখক উদ্বাস্তুদের কথাও উল্লেখ করেছেন। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে বামপন্থীদের সম্মিলিত উদ্যোগে রাজ্যে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের অনুকূলে বামফ্রন্ট সরকার স্থায়ী দলিল প্রদান-সহ বহু জনস্বার্থবাহী কাজ সম্পাদন করে, যা আজকের যুবসমাজের কাছে অনেকাংশে অজ্ঞাত।
‘প্রতিষ্ঠা ঠিক কবে’ (২৫-১০) চিঠির উত্তরে বলি, কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২০ সালে তাসখন্দ শহরে মানবেন্দ্রনাথ রায়-সহ সাত জন প্রবাসী বিপ্লবীদের উপস্থিতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সম্পাদক নির্বাচিত হন মহম্মদ শফিক। ১৯২১ সালে ইলাহাবাদে ৩৬তম জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি আহ্বান জানায়। অতঃপর ১৯২৫ সালে ভারতবর্ষের কানপুর সম্মেলনে পার্টির প্রতিষ্ঠার পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
মূল নিবন্ধে (‘শতবর্ষ ও...’) লেখক শ্রীচক্রবর্তী সিপিএম-এর দু’এক জন নেতার তারাপীঠে পুজো বা হজ যাত্রার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। নিজ নিজ সত্তা বজায় রেখে সবাই সব জায়গায় যেতে পারেন, তাই বলে বিশাল সমাজের মানুষের কাছে তাঁরা কখনও অচ্ছুৎ হন না। পুজোর মণ্ডপ প্রাঙ্গণে পার্টির বুক স্টল স্থাপন করলেই কেউ নীতিভ্রষ্ট হন না, বরং মানুষের কাছে পত্রপত্রিকা বিক্রয়ের মাধ্যমে তাঁদের লক্ষ্য তুলে ধরেন।
খগরাজ ভৌমিক
কলকাতা-৭৮
মনে রাখতে হবে
সন্দীপন চক্রবর্তীর ‘শতবর্ষ ও শত সুযোগ নষ্ট’ (২১-১০) শীর্ষক নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা।
মুখ্যত এম এন রায় ও অবনী মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ১৯২০-র ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হলেও অচিরেই উভয়ের মধ্যে বিরোধ বাধে, পরিণামে বিচ্ছেদ গত শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি। ওই দশকেরই শেষাশেষি (ডিসেম্বর ১৯২৯) এম এন রায় কমিনটার্ন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মেক্সিকো হয়ে দেশে ফেরেন। মার্ক্সবাদে বীতস্পৃহ হয়ে র্যাডিক্যাল হিউম্যানিজ়মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পৃথক সংগঠন গড়েন এবং আমৃত্যু (১৯৫৪) সেই তত্ত্বেই আস্থাবান ছিলেন। অন্য দিকে অবনীবাবু রাশিয়ায় ক্রমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী হলেও স্তালিনের আমলের কুখ্যাত ‘পার্জিং’-এর শিকার হয়ে ১৯৩৭-এ গ্রেফতার হন ও পরে স্তালিনের নির্দেশে তাঁর প্রাণদণ্ড হয়।
‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানেরও নির্দিষ্ট কারণ কিন্তু ব্যাখ্যাত হয়নি নিবন্ধে। যেমন, ‘‘নেতাজি বা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রাথমিক কমিউনিস্ট মূল্যায়নের কারণও খোঁজা যেতে পারে’’ বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদি ধরেও নেওয়া যায় সে মূল্যায়ন প্রাথমিক বা তাৎক্ষণিক, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, চূড়ান্ত মূল্যায়নই বা কী?
মনে রাখতে হবে, ছড়া কবিতায় মিথ্যে প্রচার করে এবং ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতে বৈপ্লবিক জাতীয়তাবাদের ঋত্বিককে অপবাদ দেওয়া হয়েছিল traitor আর তাঁর দলকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল fifth column। সেই বামপন্থী দল ঘোষণা করেছিল,"If Subhash Bose returns we will greet him with bullet".
সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম পড়ে, ‘‘...এই দলের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়ার নজির অম্লান।’’ মুসলিম লিগের ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর দাবির সহযোগী ছিল এই কমিউনিস্ট পার্টি। যখন সুভাষচন্দ্র বলছেন, ‘‘একাধিক কারণে পাকিস্তান একটি আজগুবি পরিকল্পনা এবং অকার্যকর প্রস্তাব। ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়া ভারতবর্ষ একটি অবিভাজ্য দেশ। দ্বিতীয়ত ভারতের অধিকাংশ অংশেই হিন্দু ও মুসলমানগণ এরূপভাবে মিশিয়া গিয়াছেন যে তাহাদের পৃথক করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত জোর করিয়া মুসলমান রাষ্ট্র যদি গঠন করা হয়,তাহা হইলে এই সকল রাষ্ট্রে নূতন সংখ্যালঘু সমস্যার সৃষ্টি হইবে যাহার ফলে নূতন নূতন অসুবিধা দেখা দিবে’’, তখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সাজ্জাত জাহির মুসলিম লিগকে সমর্থন করে ‘পাকিস্তান আ জাস্ট ডিমান্ড’ প্রবন্ধে (জনযুদ্ধ ১৯৪৪) লিখছেন, "The league objective aim of complete elimination of British Imperialism, as complete independence-exactly the same are the objective of Congress".
আবার নেতাজি দেশভাগের প্রস্তাব শুনেই যখন পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গন থেকে বেতার মাধ্যমে দেশবাসীকে সতর্ক করছেন, "I have no doubt that if India is divided, she will be ruined", তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক তাত্ত্বিক নেতা ড. জি অধিকারী পাকিস্তান গঠনের দাবিকে ন্যায়সঙ্গত আখ্যা দিয়ে বললেন, "The demand for Pakistan, if we look at its progressive essence, is in reality the demand for the self-determination of the area of muslim nationalities of the Punjab, Pathans, Sind, Baluchistan and of the eastern province of Bengal".
যা-ই হোক, এখন বামের ভোট রামে গিয়েছে বলে বিলাপ করলেও প্রায় তিন দশক আগে ময়দানে জনসভায় হাত-ধরাধরির ছবিটাও একেবারে বিস্মৃত নয়।
শান্তনু রায়
কলকাতা-৪৭
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।