পঞ্জাবের চাষির বিদ্রোহে গোটা দেশের কৃষকের স্বার্থ জড়িত নয়। যে উদ্বৃত্ত ফসল এত কাল চাষিরা মাঠে ফেলে এসেছেন, কিংবা বিক্রি করে চাষের খরচটুকুও ফেরত পাননি, তা যদি কেউ দরদাম করে কিনে নেয়, তা হলে চাষিদের লাভ হবে, না ক্ষতি হবে? যে জমি জলের অভাবে বছরে এক বার মাত্র চাষ হয়, সেখানে যদি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে সারা বছর জমির চরিত্র অনুযায়ী চাষ হয়, তা হলে চাষির লাভ হবে, না ক্ষতি হবে?
আড়তদারদের ফাটকাবাজির দৌলতে বছরের একটা সময়ে আলু, পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্য তেল-সহ নানা কৃষিজাত পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম হয়। সেই সমস্ত পণ্যের উৎপাদন, জোগানের দায়িত্ব যদি চাষিদের সঙ্গে কর্পোরেট সংস্থা যৌথ ভাবে নেয়, তা হলে কি এ ভাবে দ্রব্যমূল্য মাথাচাড়া দেবে? প্রতি বছর হাজারখানেক কৃষক আত্মহত্যা করেন ফসল নষ্ট হলে, বা ফসলের দাম না পাওয়ায় মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পেরে। চুক্তি চাষ হলে চাষের খরচ থেকে ক্ষতির ভার, সমস্তটাই বহন করবে জড়িত সংস্থা। চাষিকে মহাজনের কাছে ঋণ নিতে হবে না। উপরন্তু পাবেন সার, বীজ, কীটনাশক-সহ প্রযুক্তিগত সহায়তা। ফসলের পরিমাণ ও গুণগতমান বাড়বে, একফসলি জমি হবে দু’ফসলি, তিনফসলি।
পঞ্জাবের কৃষকের সঙ্গে দেশের অন্যান্য রাজ্যের কৃষকের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। পঞ্জাবের চাষিরা বড় চাষি। ওখানে চাষির বাড়িতে মার্সেডিজ়, অডি দেখতে পাওয়া যায়। তাঁদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে। চাষ হয় মেশিনে। গবাদি পশু চাষের কাজে ব্যবহার হয় না। তাই খেতে বিচুলি পড়ে থাকে, মেশিনের সাহায্যে খেতেই ধান ঝাড়াই করে খামারে চলে আসে।
নতুন কৃষিনীতির জন্য দেশ জুড়ে পঞ্জাবের চাষিদের যে একাধিপত্য, তা মার খাবে। গোটা দেশের কৃষিজাত পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করেন পঞ্জাবের চাষিরা। এতে অন্যান্য রাজ্যের কৃষকরা মার খেলেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। ফলে দেশ জুড়ে চাষিরা যখন অনাহারে ধুঁকছেন, আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন, তখন পঞ্জাবের কৃষকরা ফুলেফেঁপে উঠছেন। নতুন কৃষিনীতি তাঁদের স্বার্থে আঘাত হানবে বলেই তাঁরা এই কৃষি আইন আটকাতে মরিয়া। এর সঙ্গে গোটা দেশের কৃষকের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই।
কৌশিক সরকার রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া
জমাট লড়াই
“ইয়ে ইনকিলাব হ্যায়, ইয়ে রেভলিউশন হ্যায়”— টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পঞ্জাবি যুবকের প্রতিটা শব্দে প্রত্যয় ঠিকরে বেরোচ্ছিল। শীতের রাজধানীতে বিপ্লবের অকালবসন্ত নামবে কি না, তা সময় বলবে। কিন্তু দিল্লিতে এই মুহূর্তে যা ঘটছে, তা রূপকথার চেয়ে কম নয় মোটেই। দীর্ঘ দিন পর এমন জমাট লড়াই দেখছে এ দেশ। তা-ও কৃষকদের নেতৃত্বে, ঋণের ফাঁসে আত্মহত্যাই যাঁদের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল সরকার থেকে আমজনতা। প্রতি ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে এই দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে এক জন কৃষক আত্মহত্যা করেন জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে। সেই কৃষকরাই লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, বেধড়ক লাঠিচার্জ, দিল্লির ঠান্ডা, কিছুই দমাতে পারেনি। পারেনি দিল্লি অভিমুখে অভিযান আটকাতে।
একের পর এক আপাত অসম্ভব দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। বছর ছাব্বিশের নভদীপ সিংহ জলকামানের মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, লাফ দিয়ে নীচে নামছেন। দিল্লি পুলিশের বেপরোয়া লাঠির জবাবে কৃষকরা নিজেদের খাবার, জল ভাগ করে নিচ্ছেন পুলিশ কনস্টেবলদের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলে বলছেন, “ইয়ে তো সারে আপনেহি বচ্চে হ্যায়, ইন পুলিশওয়ালো কি বাপ-দাদা ভি হমারে তেরহা খেতি করতে হ্যায়।” ছাত্রের দল দিল্লি-হরিয়ানার সিঙ্ঘু সীমান্তে অবস্থানরত কৃষকদের জন্যে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে, আবার সংহতি জানিয়ে স্লোগানও দিচ্ছে। বরাবরের মতোই দিল্লির গুরুদ্বারগুলো লঙ্গরখানা খুলে আমাদের অন্নদাতাদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। এ বার তার সঙ্গে বেশ কিছু মসজিদও জুড়ে গিয়েছে। সবাই মিলে সুখ-দুঃখের রুটি ভাগ করে নিচ্ছেন। ভাবা যায়! এই সেই দিল্লি, কিছু দিন আগেও যেখানে ধর্মের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে! জাতপাত, ধর্ম, বর্ণে বিভক্ত এই দেশে এমন দৃশ্য কোনও অংশেই বিপ্লবের চেয়ে কম নয়।
শেষ ছ’-সাত বছর এই দেশ সাক্ষী এক নতুন ধরনের প্রায় একনায়কতান্ত্রিক শাসনের। মিডিয়া থেকে আদালত, প্রশাসন থেকে সংসদ— সর্বত্র শাসকের ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত। একের পর এক জনবিরোধী, সংবিধানবিরোধী সিদ্ধান্ত স্রেফ গায়ের জোরে, সংখ্যার জোরে পাশ হয়েছে। বিরোধী শিবির উদ্ভ্রান্ত, ছন্নছাড়া। সেখানে কৃষকদের লড়াই নতুন আশার আলো।
স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু ঠিক উল্টো পথে হেঁটে কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে আনলেন নয়া কৃষি আইন। এই অতিমারিতে যখন দেশের সাতটি বুনিয়াদি শিল্প-সহ সমস্ত ক্ষেত্রে পর পর দুই ত্রৈমাসিকে মন্দা জাঁকিয়ে বসেছে, তখনও আমাদের দেশের কৃষি ৩.৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। তাই দেশের কৃষিই কর্পোরেটের নতুন লক্ষ্য। কৃষকদের দাবি, অবিলম্বে তিনটি নয়া কৃষি আইন বাতিল করতে হবে, সঙ্গে বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল ২০২০-ও বাতিল করতে হবে। দাবি আদায়ের লড়াই দীর্ঘ হতে পারে জেনে ছ’মাসের রসদ সঙ্গে এনেছেন কৃষকরা। প্রায় ৪০ হাজার মহিলা কৃষকও হাজির দিল্লির উপান্তে।
কৃষকরা অমিত শাহের শর্ত মেনে আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে হুমকি দিয়েছেন, আলোচনা আপাতত তাঁদের শর্তে হবে। তাঁরা সরকারের সদর্থক পদক্ষেপ না দেখলে দিল্লি সীমান্ত থেকে এক পা-ও নড়বেন না। এ বিপ্লব নয় তো কী!
স্বর্ণেন্দু সিংহ, নবদ্বীপ, নদিয়া
বাম ভূমিকা
বর্তমানে দেশ জুড়ে সরকার-বিরোধী যে কৃষক আন্দোলন চলছে, সেখানে বামপন্থীদের ভূমিকা কী? সর্বভারতীয় স্তরে কৃষক সংগঠনে তার অস্তিত্ব কতটুকু? হরিয়ানা, পঞ্জাব থেকে জেগে ওঠা বর্তমানের কৃষক আন্দোলনে এ রাজ্যের কৃষকদের কতটা উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন বামেরা? এ রাজ্যের কৃষকরা কি কেন্দ্রীয় সরকারের আনা কৃষি বিল সম্পর্কে আদৌ অবহিত?
এই সব প্রশ্নের উত্তরের পিছনে রয়েছে বামপন্থীদের অস্তিত্বহীনতা। বর্তমানে বামেরা এতটাই দুর্বল যে, এ রাজ্যে এক দিকে শাসক তৃণমূল, অন্য দিকে প্রভাবশালী বিজেপির বিরুদ্ধে নিজের সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে লড়াই করার পরিবর্তে, কংগ্রেসের মতো জনসংযোগহীন, সংগঠনহীন, নেতৃত্বহীন একটি দলের সঙ্গে জোট বেঁধে টিকে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনও বামপন্থী দলের কাছে যখন নির্বাচনী লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হয়ে দাঁড়ায়, তখন বোঝা যায় তারা কতটা অপ্রাসঙ্গিক। তাই ১ ডিসেম্বর ‘সম্পাদক সমীপেষু’-তে বাম রাজনীতি নিয়ে একাধিক পত্র দেখে প্রশ্ন জাগে, বামপন্থীদের নিয়ে চর্চার প্রয়োজন পড়ল কেন?
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
নবান্ন
হেমন্তের দ্বিতীয় মাসটি অগ্রহায়ণ। শীতের আদর মাখতে মাখতে শীত এসেই পড়ে। মাঠে মাঠে আমন ধানের ঝাড়াই মাড়াই চলছে। ফাঁকা মাঠে কচিকাঁচাদের ঘুড়ির লড়াই। রবিচাষের তাড়া। তারই মাঝে নবান্ন কিছু বিশেষ ভাবেই পালন করে বাঙালি। যার যেমন জোটে, তাই দিয়েই। কিন্তু আজ রোজগার কই? দিনমজুর কাজে আসতে বিধিনিষেধ। চাষিরা লোকবলের অভাবে হিমশিম। ফসল বিক্রির জন্যও অনেক জাঁতাকলে পাক খেতে হয়। জিনিসের দাম এত বেশি যে, কোনও কিছুতে হাত দেওয়া যায় না। একা অতিমারি উৎসব মাটি করছে না, অভাবেও শুকিয়ে যাচ্ছে উৎসবের সরসতা।
পিউপা ঘোষ, বুদবুদ, পূর্ব বর্ধমান
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।