যন্ত্র ও মানুষের মেলবন্ধন। প্রতীকী চিত্র।
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রক্তমাংসের (রো)বট’ (৭-২) শীর্ষক প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে কিছু কথা। ছিন্নপত্র-এ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ ক’রে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি! ওর এই গাছপালা নদী-মাঠ কোলাহল-নিস্তব্ধতা প্রভাত-সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, পৃথিবীর কাছে থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন-কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম?”
কবির ভালবাসার এই পৃথিবী আজ যান্ত্রিক। যন্ত্রকে মানুষের মতো ভাবতে দিয়ে মানবসভ্যতা যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে, অথবা যন্ত্রের মতোই ভাবতে শুরু করে, তা হলে কৃত্রিমতার সেই বিশ্বে মানবসত্তার দুর্দিন বুঝি আসন্ন। বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ সমাজে বহু অংশেরই কাজ কেড়ে নিয়েছে। সাদামাটা একটা বিষয়কেই এখানে উত্থাপন করা যায়। যেমন— সংবাদপত্র বা পত্রিকার দফতরে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি থেকে কম্পিউটারে আঙুলের ঝড়ে অক্ষর সৃষ্টি এক দল মানুষের দ্বারা সম্পাদন করা হত। তাঁদের সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে একের পর এক পাণ্ডুলিপি লেখকেরই দ্বারা ছাপার উপযোগী হরফে কম্পিউটারে টাইপ হয়ে পত্র-পত্রিকা দফতরে পৌঁছচ্ছে। ‘ডিটিপি অপারেটর’ পদটি এখন লেখকরাই পূরণ করে চলেছেন। এ ভাবেই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ এক অংশে যখন আলো হয়ে ঝরে পড়ছে, তখন অন্য অংশে চলছে ঘোর অমাবস্যা।
প্রবন্ধকারের চিন্তায় সমাজকে গ্রাস করার ক্ষমতায় ঋদ্ধ যন্ত্রমানবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যে ভাবনাচিন্তাগুলি দানা বেঁধেছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। তবু বহু যুগ পিছিয়ে দেখতে গিয়ে মনে হয়, ভ্যান গখ যখন একের পর এক গনগনে সূর্যমুখী ক্যানভাসে ভরিয়ে তুলছেন এবং নষ্ট করছেন, যন্ত্রমানবের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রকৌশল কি তাঁর সেই সময়ের শিল্পীমনের স্থান নিতে পারবে? আমি নিশ্চিত, কৃত্রিম মেধা তাঁর সৃষ্টিশীলতার সুউচ্চ চূড়াটিকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হবে। মানবমন এবং মস্তিষ্কের জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়া যে সব অনুভূতির ফসল ফলায়, তার বিকল্প সম্ভব নয়।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ ক্রমশ যন্ত্রের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এই শিক্ষাব্যবস্থায় মনুষ্যমন সৃষ্টির জটিল প্রক্রিয়া কেবলই যে বোতাম টেপা যন্ত্রের চলাফেরা, ওঠানামার অনুকরণে সদা ব্যস্ত। তাসের দেশ-এর ‘ইচ্ছেমন্ত্রে’ আমরা কেবলই উঠছি, বসছি, পাশ ফিরছি, পিঠ ফেরাচ্ছি, মাটিতে গড়াচ্ছি। তাসের দেশে গোলাম রাজাকে বলেছিলেন, “যে দেশে বায়ু না মানে/ বাধ্যতামূলক বিধি,/ সে দেশে দহলা তত্ত্বনিধি/ কেমনে করিবে রক্ষা কৃষ্টি—/ সে দেশে নিশ্চিত অনাসৃষ্টি।।” উত্তরে রাজা বলেছিলেন, “থাক্, আর প্রয়োজন নেই। এটা চতুর্থবর্গের পাঠ্য পুস্তকে চালিয়ে দিয়ো। তাসবংশীয় শিশুরা কণ্ঠস্থ করুক।”
প্রবন্ধকারের সংশয় অনুসারে, ছাঁচে-ঢালা শিক্ষায় একশো জনের চিন্তা-ভাবনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক জনের অন্য ধারার অনুগামী হওয়া এখন আমাদের সমাজে আর হয়ে ওঠে না। সব শিয়ালের এক রা। যন্ত্রসভ্যতায় মানুষ অন্য রকম ভাবে ভাবতেই ভুলে গিয়েছে। কিংবা, অন্য ভাবে ভাবতে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবুও ভ্যান গখের সূর্যমুখীগুলো এখনও স্বপনে-জাগরণে চোখ রাঙায়।
সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া
পোশাকবিধি
ডাক্তার চেনাতে হরিয়ানা সরকার পোশাকের বিষয়ে বিধিনিষেধ জারি করেছে। ডাক্তারদের জন্য বিশেষ উর্দির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। ১৯৭২ সালে এ রাজ্যে প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী অজিত পাঁজার আমলে ডাক্তারদের জন্য বুকে নাম লেখা সাদা এপ্রন পরার সরকারি আদেশনামা বেরিয়েছিল। পদমর্যাদা বোঝাতে সাদা, কালো ও লাল রঙের ব্যাজের ব্যবস্থা ছিল শিক্ষক, অশিক্ষক ও প্রশাসক চিকিৎসকদের জন্য। খুব অল্প দিনের মধ্যেই তদারকির কড়াকড়ি না থাকায় ব্যবস্থাটির প্রয়োগ আর দেখা যায়নি। বাম জমানায় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে দেওয়ালে কর্তব্যরত ডাক্তারের নামের বোর্ড ঝোলানো থাকত, এখন সেই ব্যবস্থাও নেই। সম্প্রতি শান্তিপুর হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে কর্তব্যরত এক ডাক্তারকে তাঁর চিকিৎসা-করা এক রোগী নাম জানতে চাইলে তিনি নাম জানাতে অস্বীকার করেন। দোষ না থাকলে, বা আইনানুগ কাজ করলে কর্তব্যরত চিকিৎসক অথবা চিকিৎসা কর্মীর নাম জানানোয় কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়।
বাসুদেব দত্ত, শান্তিপুর, নদিয়া
খেলায় অনাদর
“প্রাথমিকে খেলা খাতে ‘মুষ্টিভিক্ষা’, আতান্তরে স্কুল” (১৩-২) শীর্ষক খবরটি পড়ে বোঝা গেল, প্রাথমিক স্কুলের খেলাধুলো ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য বছর তিনেক আগে পর্যন্তও চক্র-প্রতি যেখানে এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল, তা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে, যা প্রাথমিক স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের মতে ‘মুষ্টিভিক্ষা’। এক-একটি জেলায় প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা অনুযায়ী চক্র-সংখ্যা নির্ধারিত হয়। যে জেলার চক্র-সংখ্যা বেশি, তারা বেশি টাকাই পেত। কলকাতা জেলার চক্র-সংখ্যা যেমন ২৩, তাদের বরাদ্দ ছিল ২৩ লক্ষ, তা এখন থোক ৫ লক্ষ টাকায় নেমেছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত কলকাতা জেলার ২৩টি চক্রের জন্য ২৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হলেও এ বার তা নেমে ৫ লক্ষ টাকায় দাঁড়িয়েছে। জেলাগুলোর ভাগেও এ ভাবেই খেলা-খাতে টাকার বরাদ্দ কমেছে। রাজ্য সরকারের আর্থিক দৈন্যদশার পরিচায়ক এটা।
খেলাধুলো নিয়ে এমন উদাসীনতার পাশাপাশি দেখা যায়, ক্লাব বা পুজোয় দেদার বরাদ্দ আছে সরকারের। সরকারি বরাদ্দের অভিমুখ স্বচ্ছ ও প্রয়োজনভিত্তিক সঠিক দিশা পেলে কাজের কাজটুকু হয়। প্রাথমিক বা ঠিক তার পরের স্তর থেকেই তো ছেলেমেয়েদের বেছে নেওয়া উচিত জেলা, রাজ্য, আন্তঃরাজ্য বা জাতীয় স্তরের খেলাধুলার লক্ষ্যে। এ ভাবেই উঠে আসে জ্যোতির্ময়ী-সোমা-সুস্মিতা-সরস্বতীর মতো প্রতিভা। সেখানে কার্পণ্য দেখিয়ে, বিভিন্ন অ্যাকাডেমি খোলার বিজ্ঞাপন দিয়ে মাঠ ভরালে খেলার গুণগত কোনও পার্থক্য ধরা পড়বে না। প্রকৃতপক্ষে খেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই নয় এই রাজ্য সরকারের কাছে। খেলাকে স্কুলশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিলে খেলোয়াড় তৈরির সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ নাগরিক গঠন প্রক্রিয়াও জারি থাকে গোড়া থেকে। এ কথাও ভেবে দেখা উচিত কর্তৃপক্ষের।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
পরিবেশবান্ধব
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমরা কি পিছন দিকে হাঁটছি’ (২৩-২) লেখাটি সময়োপযোগী। প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপারে যদি আমরা সচেতন না হই, তবে বারে বারে ফিরে আসবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়। আর দূষণ যখন ভয়াবহ রূপ নেবে, তখন নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি আর ক্ষতির সম্মুখীন হব আমরা। খেলা, মেলা, উৎসব পালনের সঙ্গেই আমরা যদি একটু সচেতন হই, তা হলে অনেক উপকার হবে। তবে এই সচেতনতা শুধুমাত্র শহরে নয়, গ্রাম-মফস্সলেরও সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধুমাত্র ব্যানার বা এক দিনের কোনও সরকারি অনুষ্ঠান নয়, ধারাবাহিক ভাবে সারা বছর ধরে এই কর্মসূচি পালন করতে হবে। গঙ্গা ও অন্য নদনদী, খাল, বিল, পুকুর ও জলাশয়ের জলদূষণ রোধ করতে শুধুমাত্র প্রতিমা, ফুল, সিঁদুর নয়, প্লাস্টিক ও থার্মোকলের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। এই ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে সকল নাগরিককেও এগিয়ে আসতে হবে পরিবেশবান্ধব এক সমাজ গড়তে। নিজের প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে গাছ, চটের নকশা করা বিভিন্ন ব্যাগ কি দেওয়া যায় না? সমাজকে পিছন দিকে নয়, সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের কর্তব্য।
তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি