সম্পাদক সমীপেষু: টি টোয়েন্টি তো নয়!

জনগণ যেন ঠিক এ রকমই পুলিশের অপেক্ষায় ছিল, যারা এই ভাবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করবে। আর জনগণ মনুষ্যরূপী কোনও ভগবানসুলভ রক্ষক পেয়ে তার চরণতলে মাথা ঠুকে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৩১
Share:

অনুরাগ কাশ্যপের ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ সিনেমায় একটি সংলাপ ছিল, যার মূল বক্তব্য: যত দিন এই দেশে সিনেমা নামক বস্তুটি থাকবে, তত দিন দেশের লোকজন বোকা বনবে। হায়দরাবাদ এনকাউন্টার কাণ্ডে মনে হয় সেটাই প্রমাণিত হল। জনগণ যেন ঠিক এ রকমই পুলিশের অপেক্ষায় ছিল, যারা এই ভাবে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করবে। আর জনগণ মনুষ্যরূপী কোনও ভগবানসুলভ রক্ষক পেয়ে তার চরণতলে মাথা ঠুকে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবে। জনগণ অবশ্য বরাবরই নিজস্ব বিচারবুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনও দাদা বা দিদির থানে মাথা ঠুকতেই পছন্দ করে; কিন্তু তাতে সত্য বদলায় না।

Advertisement

প্রথমত, এই ঘটনায় আবেগে চোখে-নাকে জল এসে যাওয়া জনতার এটা বোঝা দরকার, ‘অভিযুক্ত’ এবং ‘দোষী’ শব্দ দু’টির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মাঝখানের ফারাকটাকে মুছে ফেলা কোনও সুস্থ রাষ্ট্রের পক্ষেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। হায়দরাবাদের চূড়ান্ত অমানবিক, নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় পুলিশ যে চার জনকে গ্রেফতার করেছিল; তারা অভিযুক্ত; দোষী নয়। অভিযুক্তকে দোষী ঘোষণা করে সাজা দিতে পারে এক এবং একমাত্র বিচারব্যবস্থা, পুলিশ নয়। যত ক্ষণ না কোর্ট কাউকে দোষী বলে ঘোষণা করছে, তত ক্ষণ সে নির্দোষ।

সংখ্যাগুরু জনগণের এ-হেন উচ্ছ্বাসের কারণ কী? কারণ তারা মনে করছে, আদালতে অধিকাংশ সময়েই ন্যায়বিচার হয় না, আসল অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়, বিচার হলেও বহু সময় লাগে। এই সব উক্তির যে বাস্তব ভিত্তি নেই, তা নয়। আমাদের দেশ বলে নয়, দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশেই বিচারব্যবস্থা কিঞ্চিৎ ধীরগতিসম্পন্ন। কিন্তু তার সমাধান কখনওই ‘এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং’ হতে পারে না। বিচারপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে হবে; সংখ্যাগুরু জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে বিচারব্যবস্থার শূন্যপদ পূরণে ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু পুলিশ যদি দোষী নির্বাচন করে শাস্তি দিতে শুরু করে, তা হলে সমূহ সর্বনাশ।

Advertisement

২০১২ সালে ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুরে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১৭ জনকে হত্যা করেছিল। সদ্য প্রকাশিত বিচারবিভাগীয় তদন্তের রিপোর্টে দেখা গেল, নিহতরা ছিলেন নিরীহ গ্রামবাসী। কোনও মাওবাদী ওই ঘটনায় মারা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, গ্রামবাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিও চালায়নি। এ রকম বহু ঘটনা ঘটেছে। বছরখানেক আগে রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে একটি বাচ্চাকে হত্যার জন্য পুলিশ ওই স্কুলেরই একটি স্কুলবাসের কন্ডাক্টরকে গ্রেফতার করে। বলা হয়, ওই কন্ডাক্টর পুলিশের কাছে কবুল করেছে, সে যৌন হেনস্থা করে সাত বছরের বাচ্চাটিকে খুন করেছে। পরে সিবিআই তদন্ত করে জানায়, ওই স্কুলেরই বয়সে বড় এক ছাত্র, স্কুলের পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে এই হত্যাটি করে। বিচারব্যবস্থাকে টপকে শাস্তি দিতে গেলে তার পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে; এই ঘটনাগুলি তার প্রমাণ।

শুধু জনগণকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও কমবেশি একই কথা বলেছেন। এনকাউন্টারের পরেও জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের উল্লাস লুকিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। আর যাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে সহমত হতে পারেননি; তাঁরা গালাগালি খেয়েছেন। অবশ্য যে দেশের জনগণ ধর্ষকের মাকে ধর্ষণ করার নিদান দিয়ে ধর্ষণের প্রতিবাদ করে; সেখানে এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যখন ‘বিধিদ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভারতের সংবিধানের’ নামে শপথ গ্রহণ করে এ ভাবে সংবিধান, আইনকানুনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছেন, তখন দেশের জনগণ সংবিধানকে মেনে চলবে, ভাবাই বাতুলতা।

সর্বোপরি, যাঁরা মনে করেন যে এই এনকাউন্টারে ন্যায়বিচার এসেছে; তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই এও বিশ্বাস করেন যে এটা ফেক এনকাউন্টার ছিল। অর্থাৎ দেশ জুড়ে ফেক এনকাউন্টারের মতো চূড়ান্ত অমানবিক এবং বেআইনি বিষয়ের পক্ষেও জনসমর্থন তৈরি হচ্ছে!

আসলে ‘জাস্টিস’ নয়; দেশের সংখ্যাগুরু জনগণ যা চাইছে, সেটা হল তৃতীয় শ্রেণির কোনও হিন্দি সিনেমার বাস্তবিক রূপ। যেখানে অপরাধ হবে, পুলিশ ধর্ষককে ধরে সেখানেই গুলি করে ন্যায়বিচার দিয়ে দেবে। আহা, এ যেন টি টোয়েন্টি ক্রিকেট! শুধু চার আর ছয়। অথচ ধর্ষণের মতো অপরাধের পিছনে মূল কারণ কী, সেটাকে কী ভাবে এই সমাজ থেকে উৎখাত করা হবে, সেই নিয়ে অধিকাংশ জনগণ বা তাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কোনও উৎসাহই চোখে পড়ছে না।

সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়

ইমেল মারফত

উগ্রতা বাড়ছে

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হোক এনকাউন্টার!’ (৮-১২) শীর্ষক নিবন্ধটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। তেলঙ্গানার ধর্ষণের ঘটনা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে প্রচণ্ড ভয় ও দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে। পাশাপাশি চার জন ধর্ষক ও খুনির ‘এনকাউন্টার’ একই রকম ভয় পাইয়েছে। অবাক হয়েছি, ‘এনকাউন্টার’ করা পুলিশ অফিসারকে জনগণ ‘হিরো’র ভূমিকায় নিয়ে যাওয়ায়।

আর প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-তে সাধারণ মানুষের দেওয়া ভয়াবহ শাস্তির নিদানগুলোতে। বিষয়টা প্রায় এমন জায়গায় গিয়েছিল, যিনি যত বেশি কঠিন বা ভয়ঙ্কর শাস্তির বিধান দেবেন, তিনি তত বেশি বিবেকবান! সত্যিই কি তাই? ওই চার ধর্ষক যে নৃশংসতার নজির রেখেছে, প্রতিশোধের মধ্যেও কি একই রকম নৃশংসতা নেই? সামাজিক নৃশংসতা?

বোধ হয় আমাদের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা বা 'quick gain'-এর প্রবণতা বাড়ছে। এখানে ‘গেন’ কোনও গভীর মানবিক উন্নতি নয়, নেহাতই চটুল সহজ প্রাপ্তি। ওই এনকাউন্টারের দিনই কাগজে আরও এক ‘এনকাউন্টার’-এর খবর প্রকাশ হয়। উত্তরপ্রদেশে পাঁচ জন ব্রাহ্মণ তাদের মতো করে শাস্তি দিয়েছে এক অসহায় লোহার যুবতীকে। উগ্রতা বাড়ছে। যৌনতার, প্রতিশোধের, টিভিতে সত্য ঘটনা অবলম্বনে ‘ক্রাইম’কে আরও এক বার খুঁচিয়ে দেওয়ার। সব সময় কিছু না কিছু উত্তেজনা চাই। সাধারণ, সহজ, গঠনমূলক জীবন আমাদের আর টানছে না। কিন্তু এই উগ্রতা আর উত্তেজনার বশে কাণ্ডজ্ঞান ঠিক থাকে না। ওই চার ধর্ষক ও খুনিরও ছিল না।

প্রতিম বয়াল

আগরপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

কেশব, নারীমুক্তি

2 ‘কেশবের কয়েক দিন’ (২-১২) শীর্ষক পত্রে কেশবচন্দ্রের সস্ত্রীক প্রকাশ্যে পথে বেরোনোর ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে। কিছু সংযোজন। সেই সময় অনেক সাহসী প্রগতিশীল মানুষ‌ও সস্ত্রীক প্রকাশ্যে বেরোনোর কথা চিন্তা করতে পারতেন না, সামাজিক অনুশাসন এতটাই কঠোর ছিল। ১৩ এপ্রিল ১৮৬২, ঠাকুরবাড়িতে ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য পদে অভিষেকের উৎসব। ওই উৎসবে কেশবচন্দ্র সস্ত্রীক যাবেন, এই খবর পেয়ে কেশবচন্দ্রের কলুটোলার বাড়ি ঘিরে রেখেছিল তাঁর কিছু আত্মীয় এবং কিছু গুন্ডা। এই কারণে কেশবচন্দ্র কলুটোলা থানায় অভিযোগ করেন এই বয়ানে, "certain parties wish to prevent me from taking my wife to a friend's house. I want the help of the police to enable me to exercise my right in this matter."

পুলিশ শেষ পর্যন্ত আসেনি। ভোর পাঁচটার সময় সস্ত্রীক কেশবচন্দ্র সদর দরজায় এসে দাঁড়ান এবং গুন্ডাদলকে নির্দেশ দেন দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। কেশবচন্দ্রের তেজোদীপ্ত দৃষ্টি ও প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে কুঁকড়ে গিয়ে গুন্ডাদল ফটক খুলে দেয়। কেশব স্ত্রীর হাত ধরে রাস্তায় নেমে আসেন। ‌

এই তারিখটি সেই কারণে নারী প্রগতির ইতিহাসের একটি লাল অক্ষরে লেখা দিন। কেশবচন্দ্রের জীবনীকার ও ব্রাহ্ম সমাজের বিশিষ্ট নেতা প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার এই দিনটি নিয়ে যা লিখেছেন, তার মর্মার্থ: এই ঘটনার মাধ্যমেই স্ত্রীশিক্ষা ও নারীস্বাধীনতার প্রথম ধাপটি নির্মিত হয়েছিল।

সুদীপ বসু

বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement