সুশান্ত কুমার ভট্টাচার্য (‘বাংলায় বিজ্ঞান চর্চা কেন নয়?’, ১৫-১) সময়োপযোগী নিবন্ধ লিখেছেন, সত্যিই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। তিনি অবশ্য পত্রিকা নয়, গ্রন্থের কথাই বেশি বলেছেন।
অথচ ব্যাপার এমনটি ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু বিজ্ঞানমূলক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে: বিজ্ঞান কৌমুদী (১৮৬০), বিজ্ঞান রহস্য (১৮৭১), বিজ্ঞান বিকাশ (১৮৭৩), বিজ্ঞান দর্পণ (১৮৭৬), সচিত্র বিজ্ঞান দর্পণ (১৮৮২)। এগুলিতে অবশ্য মৌলিক গবেষণা প্রকাশিত হত না। থাকত প্রধানত পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের উল্লেখযোগ্য গবেষণার খবর, আর তাঁদের গবেষণা-প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ। সম্পাদকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা, বিজ্ঞানকে একটি গণবাদী ও জনপ্রিয় চরিত্র দেওয়া।
সমকালীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকা, যেমন সংবাদ প্রভাকর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, বেঙ্গল স্পেকটেটর, সোমপ্রকাশ ইত্যাদি প্রায়ই বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার গুরুত্ব বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করত। সোমপ্রকাশ দুঃখ করেছিল, এ দেশে প্রকৃত বিজ্ঞানসাধনার সুযোগ নেই বললেই চলে। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চায় অনগ্রসরতার জন্য সরকারকে সমালোচনার পাশাপাশি সোমপ্রকাশ মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদেরও সমালোচনা করতে ছাড়েনি।
কিন্তু বিশুদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক পত্রিকাগুলি বেশি দিন চলেনি। প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত এ দেশে তখনও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল নগণ্য। দ্বিতীয়ত, সরকারও তার স্কুল-কলেজে এ সব পত্রিকার জন্য গ্রাহক-দাক্ষিণ্য দেখায়নি। তবে উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চা চলেছিল বিভিন্ন পত্রিকা, গ্রন্থ এবং অনুবাদগ্রন্থের মাধ্যমে। ক্যালকাটা গেজেট, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও জাতীয় গ্রন্থাগারের নথি থেকে, উনিশ শতকে বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের যে-সব বই ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তার তালিকা পাওয়া গিয়েছে। তাতে ৬০০-র বেশি গ্রন্থের উল্লেখ আছে। ওলাউঠা, ম্যালেরিয়া, প্লেগ, বসন্ত, সর্পাঘাত, শিশু চিকিৎসা, রোগী-পরিচর্যা, হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসা ইত্যাদি নানা বিষয়ে গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। লন্ডনে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে আমি আরও ৫০টি গ্রন্থের হদিশ পেয়েছি। কমপক্ষে ৭০০টি গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
উনিশ শতকে বাংলায় যত পত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রকাশনার সংখ্যা কম। ১৮৫৭ সালে বাংলায় ৪৬টি ছাপাখানা থেকে ৩২২টি গ্রন্থের মোট ৫,৭১,৬৭০টি কপি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র ৯টি ছিল বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ, আর এদের সম্মিলিত কপির সংখ্যা ১২,২৫০। পরবর্তী ২০ বছরে এই অনুপাত বৃদ্ধি পায়। ১৮৭৫ সালে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ১,৫৪৪টি বাংলা বইয়ের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এর মধ্যে ১১২টি বই ছিল অঙ্কশাস্ত্রের উপর, ৬১টি পদার্থবিজ্ঞান আর ৯৯টি চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক। এদের মধ্যে ৫১টি পাটিগণিত আর ৬৮টি চিকিৎসাশাস্ত্রের বই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। অন্য দিকে প্রকৃতিবিজ্ঞান আর শল্যচিকিৎসা সংক্রান্ত বই ছিল অবহেলিত। প্রকৃতিবিজ্ঞানের মাত্র দুটি, আর সার্জারির তিনটি বই জনপ্রিয় হয়েছিল।
সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে দেখলেও ব্যাপারটি উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ১৮৭৪ সালে সমস্ত ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত ৪,১২২টি গ্রন্থের মধ্যে মাত্র ৩৪৮টি বা প্রায় ৯% ছিল বিজ্ঞানবিষয়ক। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থসংখ্যা ২১৯। এদের মধ্যে পঞ্জাব থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ৪৯টি, বোম্বাই থেকে ১৮টি, মাদ্রাজ থেকে ১৪টি। তুলনায় বাংলা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৮৬টি। তবু বোঝা যায়, কী ভারতীয়, কী বঙ্গীয়, কোনও প্রেক্ষিতেই বিজ্ঞান বিষয়ে উদ্দীপনা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উনিশ শতকে একটিমাত্র বাংলা বইয়ের নাম পাওয়া গেছে: দুর্গাচরণ চক্রবর্তীর ‘বিশ্বকর্মা’ (১৮৮৬)। অক্ষয়কুমার দত্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ে যতটা উৎসাহী ছিলেন, প্রযুক্তি বা কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে ততটা নয়। রামেন্দ্রসুন্দর ‘মায়াপুরী’ গ্রন্থে বিজ্ঞানচর্চার ডাক দিয়েছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জনের জন্য। তাঁর মতে, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, ডায়নামো, মোটর, ইলেকট্রিসিটি, বাষ্পীয় জাহাজ উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ঠিকই, কিন্তু এগুলি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানসাধকের সত্যান্বেষণের বিমল আনন্দের কাছে তুচ্ছ।
এর অর্থ এই নয় যে বাংলায় বিজ্ঞানমনস্কতার সৃষ্টিপ্রয়াসে এই মনীষীদের অবদান নগণ্য। অক্ষয়কুমার দত্ত ভূগোল ও রসায়ন বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বঙ্কিম হিন্দু অধ্যাত্ম-মানসিকতাতেই ফিরে গেলেন। তিনি ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ তত্ত্বে হিন্দু ত্রিদেব-এর ছায়া দেখলেন। মন্ত্রশক্তি ও জ্যোতিষশাস্ত্রেও তাঁর আস্থা কম ছিল বলে মনে হয় না। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় কিংবা দ্বারকানাথ মিত্রের মতো পজ়িটিভিস্টরাও পশ্চিমী বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হতে রাজি ছিলেন, কিন্তু তা হিন্দু নীতিশাস্ত্র ও সামাজিক আচার আচরণের মূল্যে নয়। অক্ষয়কুমার ও রামেন্দ্রসুন্দরের রচনায় একটি ব্যক্তব্য ঘুরেফিরে আসে যে, পশ্চিমী বিজ্ঞানের যা কিছু মঙ্গলময়, তা প্রাচীন ভারতে ইতিমধ্যেই ছিল। রামমোহনের মতো রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞানসাধনা শুরু করেন বস্তুনিষ্ঠ জগতের অনুধ্যান দিয়ে, কিন্তু শেষ করেন ইন্দ্রিয়াতীত সংশয়বাদে। রামেন্দ্রসুন্দরের অন্তিম জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনি। এই স্বভাব-বৈপরীত্য উনিশ শতকের বাঙালির বিজ্ঞানচর্চায় বার বার ফিরে এসেছে। ১৮৮২ সালে রাধাগোবিন্দ কর ‘কবিরাজ-ডাক্তার-সম্বাদ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থে সনাতনপন্থীদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞাননিষ্ঠ চিকিৎসকদের যে বিরোধ আলোচিত হয়েছে, তা উনিশ শতকে বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দুই ঘরানার আরও বড় বিরোধেরই প্রতিভাস।
কলকাতায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যে উত্তরাধিকার উনিশ-বিশ শতক ধরে বাহিত হয়ে আসছিল, তা কালক্রমে ইংরেজিয়ানার দৌরাত্ম্যে হারিয়ে গেল। কিন্তু কলকাতার বাইরে এই ইংরেজি অভিযান ততটা প্রসারিত হল না। ফল হল বেদনাদায়ক। দীর্ঘ দিন মফস্সলে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার সামাজিক ইতিহাসের অধ্যাপনাসূত্রে দেখেছি, মেধা ও মননে ছাত্রছাত্রীরা কোনও অংশে কম নয়। কিন্তু ইংরেজিতে সড়গড় না হওয়ায়, আর বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই বাড়ন্ত হওয়ায়, এদের দুর্গতির শেষ নেই। আর, যে-সব শিক্ষক বাংলায় পাঠ্যবই লিখতে পারতেন, তাঁরা লেখেন না। যাঁরা লেখেন, তাঁদের জ্ঞান ও পারদর্শিতা প্রশ্নাতীত নয়।
অরবিন্দ সামন্ত
দমদম পার্ক
বঙ্কিমের বিজ্ঞান
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও কিছু বাংলায় লেখা বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ রয়েছে। ‘আশ্চর্য সৌরোৎপাত’, ‘আকাশে কত তারা আছে’, ‘গগনপর্যটন’ প্রভৃতি প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে বঙ্গদর্শন, ভ্রমর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তী কালে সেগুলো রচনাবলিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
পাশাপাশি, সাহিত্যসম্রাটের ১৭৫-তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৩ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ‘বিজ্ঞানরহস্য’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল; যেখানে বঙ্কিমচন্দ্রের সমস্ত বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধগুলি এক গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। সম্পাদনা করেছিলেন অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।
রঞ্জন পরামাণিক
বজবজ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা