oslo

‘এমন ঘুমন্ত ওসলো আগে দেখিনি!’

সারা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। চিনের উহান থেকে শুরু করে ইতালি, জার্মানি, স্পেন হয়ে ব্রিটেন, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের প্রকোপ। প্রতি দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে আতঙ্কও। বিশ্ব জুড়ে চলছে লকডাউন।সপ্তাহান্তে যে শহর মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে, ভরে ওঠে মানুষের কোলাহল কলরবে, আজ সেই শহর যেন চলে গেছে শীতঘুমে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৩১
Share:

সুনসান ওসলো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর।

সারা বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। চিনের উহান থেকে শুরু করে ইতালি, জার্মানি, স্পেন হয়ে ব্রিটেন, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের প্রকোপ। প্রতি দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে আতঙ্কও। বিশ্ব জুড়ে চলছে লকডাউন।

Advertisement

কর্মসূত্রে সাত বছর ধরে আমি বসবাস করছি নিশীথ সূর্যের দেশ নরওয়েতে। এই দেশের জনসংখ্যা খুবই কম, মাত্র ৫০ লক্ষ। মানে কলকাতার জনসংখ্যার তুলনায় একটু বেশি। তাই দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ভিড়ভাট্টা তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে রাজধানী শহর ওসলোতে থাকার সুবাদে ততটাও খালি খালি লাগে না। সাত বছরের অভ্যাসে নিজেকে অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছি।

বেশ কাটছিল। হঠাৎই যেন সব ওলটপালট হতে শুরু করলো। করোনার ভয়ঙ্কর প্রকোপ থেকে বাদ পড়লো না নরওয়েও। যদিও শুরুর দিকে কেউই তেমন একটা আমল দেয়নি। সাধারণ জীবনযাপনেই মানুষ ব্যাস্ত ছিল। এক এক করে বাড়তে থাকল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। মানুষের মনে তখনও তেমন ভয় বা আতঙ্ক চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু ১২ মার্চ পাল্টে গেল সবকিছু। নরওয়েতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা একলাফে বেড়ে আটশো হয়ে গেল। মানুষের চোখে-মুখে ধরা পড়ল আতঙ্কের ছাপ। সরকার তড়িঘড়ি করে ঘোষণা করল ১৪ দিনের লকডাউন। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস, আদালত সবকিছুই বন্ধ। শুধু বাদ পড়ল হাসপাতাল, ওষুধ দোকান, সুপারমার্কেট আর অন্যান্য জরুরি ব্যবস্থা। সরকারের হঠাৎ লকডাউনের সিদ্ধান্ত মানুষের মনে আতঙ্ক যেন আরও বাড়িয়ে দিল। আর তার প্রভাব পড়ল সুপারমার্কেটে। তড়িঘড়ি করে সবাই ছুটল খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে। অনাহারে কেই বা মরতে চায়!

Advertisement

আরও পড়ুন: অতিমারি পরিস্থিতির শিকার আয়ারল্যান্ডও

আমি অবশ্য বিষয়টা উপলব্ধি করলাম অনেকটা পরে। বিকেলে মেয়েকে ডে কেয়ার থেকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, গিয়েছিলাম মেয়ের জন্য দুধ কিনতে। গিয়ে দেখি, লোকজনের হুড়োহুড়ি আর ভিড়ে ঠাসা সুপারমার্কেটে জিনিসপত্র প্রায় সব শেষ। তাই তড়িঘড়ি করে হাতের সামনে যা যা পেলাম, আমিও তার কয়েকটা উঠিয়ে নিলাম। বন্ধুদের থেকে জানতে পারলাম অন্যান্য সুপারমার্কেটগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা।

ফাঁকা বাস ছুটছে ওসলোয়।

বর্তমানে নরওয়ের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার ছুঁতে চলেছে। সংখ্যাটা অনেকটা কম শোনালেও এ দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। ইতিমধ্যেই দু’লক্ষেরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে, তার অর্ধেকের বেশিই রাজধানী ওসলোতে। বয়স্ক মানুষের জন্য সুপারমার্কেটে আলাদা কাউন্টার খোলা হয়েছে এবং দিনের একটা বিশেষ সময়ে এক ঘণ্টা শুধু তাঁদের জন্যই খোলা থাকে। যাঁরা বাড়ির বাইরে বেরতে পারবেন না, তাঁদের জন্য হোম ডেলিভারির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ কয়েকটা ডে কেয়ার খোলা রাখা হয়েছে। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা অনলাইনেই চলছে। মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের অনেকেই স্বেছায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যোগ দিয়েছে। করোনা পরীক্ষায় কিটের সংখ্যা দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে। আক্রান্ত মানুষদের হোম কোয়রান্টাইনে রাখা হচ্ছে বা গুরতর অবস্থা হলে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। গনপরিবহন নিয়মিত চলছে এবং এখন সেটা পুরোটাই বিনামূল্যে। কিন্তু বাস, ট্রেন বা মেট্রোতে তেমন ভাবে কাউকে চোখে পড়ে না। রাস্তাঘাট একেবারে জনশূন্য। সারা শহর জুড়ে যেন এক চরম নিস্তব্ধতা। সপ্তাহান্তে যে শহর মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে, ভরে ওঠে মানুষের কোলাহল কলরবে, আজ সেই শহর যেন চলে গেছে শীতঘুমে।

না। এই ওসলো আমি আগে কোনও দিন দেখিনি।

আরও পড়ুন: জার্মানি সীমান্ত বন্ধের কথা ঘোষণা করতেই দেখি পুরো সুপারমার্কেট ফাঁকা! জীবনে প্রথম বার

মানুষের সহায়তা এবং স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করার লক্ষ্যে নরওয়ে সরকার উল্লেখযোগ্য ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে। পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় লকডাউন আপাতত ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়বে কি না সেটা সময়ই বলবে। আমি পেষায় একজন গবেষক। ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়ন বিভাগে কর্মরত। লকডাউনের কারণে বাড়িতে বসেই কোনও রকমে কাজকর্ম করতে হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের গবেষক হওয়ার সুবাদে করোনাভাইরাস সম্বন্ধে কিছুটা অবগত হলেও, মনের মধ্যে কোথাও একটা ভয় থেকেই যায়। আমি, আমার স্ত্রী আর আমার আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে একসঙ্গে থাকি। বাড়ির বাইরে সচরাচর বেরই না। কোনও বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে পা রাখলেই মনের মধ্যে করোনার ভয়। তাই বেশির ভাগ জিনিসপত্রই অনলাইনে আনিয়ে নিই।

ঘরবন্দি জীবন অবশ্যই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়, কিন্তু এ ছাড়া তো কোনও উপায়ও নেই। তাই বাড়িতে থাকাটাই মেনে নিয়েছি। দেশের বাড়িতে মা-বাবাও চিন্তিত। তাদেরও উদ্বেগে দিন কাটছে। আশা করি, খুব শীঘ্রই পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মানুষ তার সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরে আসবে। ওসলো শহর আবার উৎসবের মেজাজে ফিরে আসবে। সারা পৃথিবী করোনামুক্ত হবে।

দীপঙ্কর মান্না

ওসলো, নরওয়ে

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement