‘অগ্রাধিকার’ (৪-১২) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। দেশের সরকারপোষিত অবৈতনিক বিদ্যালয়গুলিতে কাজের দিনে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর জন্য রান্না করা দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত করেছে কেন্দ্রীয় তথা দেশের প্রতিটি রাজ্যের সংশ্লিষ্ট সরকার। যে-হেতু অবৈতনিক এই সব স্কুলের পড়ুয়ারা মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, সে-হেতু ভরপেট দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত করে এক দিকে ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির ব্যবস্থা এবং অন্য দিকে, পড়ুয়াদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতাকে বশে আনাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এটি নিঃসন্দেহে একটি মানবিক উদ্যোগ।
কিন্তু প্রশ্ন হল, বর্তমান অগ্নিমূল্যের বাজারে ‘মিড-ডে মিল’-এর বরাদ্দ তলানিতে রাখলে কী ভাবে এই পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশনের পদ্ধতিটির সফল রূপায়ণ সম্ভব? মিড-ডে মিলের মাথাপিছু বরাদ্দ ছ’টাকা উনিশ পয়সা কি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা নয়? যে দেশে মন্ত্রী-আমলা থেকে শুরু করে সাংসদ ও বিধায়কদের ভাতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাবারের বরাদ্দ বাড়ছে শম্বুক গতিতে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের বিপুল খরচ বহনে অক্ষম অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে সন্তানদের অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পাঠান। আক্ষেপের বিষয়, সরকারপোষিত এই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ তাঁদের কাজটিকে নিছকই চাকরির মতো মনে করেন, যেখানে দায়িত্ববোধের ছিটেফোঁটাও থাকে না। তাঁদের সন্তানদের জন্য তাঁরা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষার উপর ভরসা করেন, কিন্তু পেশাগত নিরাপত্তার কারণে চাকরির প্রয়োজন অনুভব করেন সরকারি বিদ্যালয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, বিদ্যালয় পরিদর্শক বিভাগ থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন অবনতি ঘটে যায় শিক্ষার। মূল্যবোধ জাগ্রত না হলে এই অবস্থা কিছুতেই পরিবর্তন হবে না।
মনে রাখতে হবে, বিদ্যালয়গুলিতে ছুটির দিনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে মোটামুটি ২০০-২০৫ দিন স্কুল খোলা থাকে। এই দু’শো দিনের জন্য খাবারের গুণগত মান ভাল রেখে মিড-ডে মিল পরিবেশন করা কি এতটাই দুঃসাধ্য কাজ? অন্য দিকে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মিড-ডে মিল পরিবেশন করার সিদ্ধান্তটিও অমানবিক। নবম, দশম কিংবা একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের কি খিদে পেতে পারে না? একই বিদ্যালয়ে এক সঙ্গে পড়াশোনা করে এক পক্ষ খেতে পাচ্ছে আর অপর পক্ষ উপবাস করছে, এই দৃশ্যটি কি সুখকর? নয়া শিক্ষা নীতিতে পাশ-ফেল প্রথা যেখানে অবলুপ্ত, সেখানে মিড-ডে মিলের নিশ্চিত সুযোগ অষ্টম শ্রেণিতেই হাতছাড়া হয়ে যায় বলে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায় ওই শ্রেণিতেই। এমন উদাহরণ গ্রামগঞ্জের স্কুলে রয়েছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের বলতে শোনা যায়, চেষ্টা করেও আমরা ফেল করতে পারি না। শিক্ষা নিয়ে এমন প্রহসনের সাক্ষী থাকছি আমরা সাধারণ নাগরিক।
জানা নেই, কারা এই মাথাপিছু মিড-ডে মিলের বরাদ্দ নির্ধারণ করেন। তবে এটুকু নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, যাঁরা এই কঠিন কাজটি করেন, তাঁরা ভারতীয় বাজারে পণ্য ক্রয় করেন না। বিদ্যালয়গুলিতে যে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার দায়িত্বে এই মিড-ডে মিল পরিচালিত হয়, তাঁদের থেকে জানা যায় তাঁরা কতটা পরিশ্রম করে এই যৎসামান্য টাকায় খাবারের ব্যবস্থা করেন। এই প্রহসন বন্ধ করে, সত্যিকারের জনসেবার কাজ করুক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি।
রাজা বাগচি, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
উপেক্ষিত
কেন্দ্রীয় সরকার ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ যোজনা’ প্রকল্প চালু করেছে এ দেশের প্রান্তিক মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য। অথচ, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য সাধনের সহায়ক নয়। সম্প্রতি মিড-ডে মিলের বরাদ্দ যৎসামান্য বাড়িয়ে, তা প্রচার করা হচ্ছে বড় করে। যার সঙ্গে বর্তমানের বাজারদরের কোনও সঙ্গতি নেই। এ টাকায় পুষ্টিকর খাদ্য তো দূরের কথা, পেট ভরে খাওয়ানোও সম্ভব নয়। আবার যে মিড-ডে মিল কর্মীরা এই প্রকল্পকে চালু রেখেছেন, তাঁদের প্রতি বঞ্চনাও সীমাহীন। ২০০৯ সালে ১০০০, ২০১৩ সালে ১৫০০, এ বছর ২০০০ টাকা করে সাম্মানিক পাচ্ছেন এই কর্মীরা। তা-ও আবার মাত্র দশ মাস। এই টাকা কি তাঁদের কাজের উপযুক্ত মজুরি? এ রাজ্যের কর্মীরা দীর্ঘ দিন দাবি করে আসছেন তাঁদের সাম্মানিক সম্মানজনক হোক। অন্ততপক্ষে আইসিডিএস-এর রান্নার কর্মীদের মতো তাঁদের মাসিক সাম্মানিক ৬৩০০ টাকা এবং অবসরকালীন ৫ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হোক। সরকারি কোষাগারে টাকা নেই, এই অজুহাতে তাঁদের দাবি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, কেউই কানে তুলছে না। কিছু কিছু রাজ্য সরকার অবশ্য এঁদের সাম্মানিক বেশি দিচ্ছে। এ ছাড়া নানা ধরনের ভাতা, অবসরকালীন টাকা, দুর্ঘটনা বিমা ইত্যাদি নানা রকমের সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে কর্মীরা পাচ্ছেন মাত্র ২০০০ টাকা। অত্যন্ত বঞ্চনার সঙ্গে এঁদের কাজ করতে হয়। সম্পাদকীয়-তে যথার্থই বলা হয়েছে যে এঁদের কাজকে স্বেচ্ছাশ্রম বলা সামাজিক অন্যায়। পুজো, মেলা, ইত্যাদি নানান দান-খয়রাতিতে সরকারি কোষাগারের টাকা খরচ করা হয়, দুর্নীতি করে অর্থ নয়ছয় হওয়ার বিষয়ও আজ প্রকাশ্যে এসেছে। অথচ, এঁরা কাজ করলেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক এঁদের দেওয়া হয় না। দাবি ওঠা দরকার, অনুদান-খয়রাতি বন্ধ করে প্রান্তিক মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার কথা বলে যাঁদের কাজে লাগানো হয়েছে, তাঁদের সাম্মানিক বাড়ানো হোক। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত।
শুধু মিড-ডে মিল নয়, আশা, পুর স্বাস্থ্যকর্মী (এইচএইচডব্লিউ) হিসেবেও মূলত মহিলাদের কাজ করানো হয়। এঁদের প্রতিও সরকারি বঞ্চনা সীমাহীন। এঁদের উপর কাজের বোঝা দিনের পর দিন বাড়ানো হচ্ছে। এই সব মহিলা-কর্মী সংসার, সন্তান পালন ইত্যাদি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে এ কাজ করে থাকেন সংসারের অভাব অনটন মেটানোর জন্য। কিন্তু তাঁদের সাম্মানিক দেওয়া হয় নামমাত্র। এ ভাবে তাঁদের অসম্মান করা হচ্ছে না কি? এই বঞ্চনা ও অসম্মানের শীঘ্র প্রতিকার হোক।
অনুরূপা দাস, পাঁশকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর
কার্পণ্য কেন?
মিড-ডে মিল প্রকল্পে, অধুনা যা প্রধানমন্ত্রী পোষণ প্রকল্প নামে পরিচিত, কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক অনুদান বৃদ্ধির পরিমাণে অবাক হতে হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ এই প্রকল্পে কেন্দ্র-রাজ্যের অনুদানের অনুপাত ৬০:৪০। অন্যান্য রাজ্য তার নিজস্ব অনুদানের পরিমাণ বাড়ালেও পশ্চিমবঙ্গে তা একই আছে।
সরকারি বিদ্যালয়ের প্রাথমিক পড়ুয়াদের জনপ্রতি চুয়াত্তর পয়সা বেড়ে হল ছ’টাকা উনিশ পয়সা, উচ্চ প্রাথমিক অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের সেটা এক টাকা বারো পয়সা বেড়ে হয়েছে ন’টাকা ঊনত্রিশ পয়সা।
প্রশ্ন হল, জনপ্রতি এই সামান্য বরাদ্দ টাকা প্রকল্পটির মূল যে উদ্দেশ্য, প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে আসতে উৎসাহিত করতে পারবে তো? খোলা বাজারে একটি ডিমই এখন সাত টাকা, নিত্যকার আনাজেরও এখন দর বেশ চড়া। কী করে তা হলে সরকারি নির্দেশ মেনে ছাত্রছাত্রীদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দেওয়া সম্ভব এই বরাদ্দ যৎসামান্য টাকায়?
সব রাজনৈতিক দল যেখানে ভোটদাতাদের দাক্ষিণ্য পেতে ব্যাপক আর্থিক অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, পুজো-পার্বণ উপলক্ষে ক্লাবগুলোর অনুদান বছর বছর বাড়ানো হয়, সেখানে কচিকাঁচাদের খাবারের ব্যাপারে দুই সরকারের এত কার্পণ্য কেন? আজকের কচিকাঁচারাই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। রাজ্যের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এমন অপুষ্টিতে অশিক্ষায় ভোগা সাধারণ জনগণ নিয়ে কী করে ভারতকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন প্রধানমন্ত্রী?
আনন্দ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৭৮