শিকাগো।
তিন-চার বার ফোনের অ্যালার্ম স্নুজ করার পর অবশেষে সকাল আটটায় নিজেকে বিছানা থেকে টেনে তুললাম। ন’টায় ক্লাস নেওয়ার থাকলে সাধারণত আরও এক বা দেড় ঘন্টা আগে উঠতে হত। চার লেয়ার গরম জামা পরতে হত, ব্যাগ গুছোতে হত, প্রায় দশ মিনিট বাসে চেপে ডিপার্টমেন্টে পৌঁছতে হত। শুধু তাই নয়, কফিশপে লাইন দিতে হত, সে দিনের ওয়ার্কশিট, হ্যান্ডআউট ইত্যাদি ফটোকপি করতে হত। এখন ওসব বালাই নেই। উঠে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে, চুল আঁচড়ে, একটা ভাল দেখে শার্ট পরে, এক কাপ কফি নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে পড়লেই হল। গত এক মাস হল বরফ পড়ছে না, তবু মিডওয়েস্টে এখনও কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। শিকাগো থেকে ১৩৫ মাইল দূরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলিধন্য এই ছোট্ট যমজ-শহর আর্বানা-শ্যাম্পেনে বছরে চার মাস ঠাণ্ডা। চার মাস ভীষণ ঠাণ্ডা, আর বাকি চার মাস আরও ঠাণ্ডা। ভোরবেলা কম্বল এবং হিটারের সাহচর্য কাটিয়ে ওঠা যে কোন ঘুমকাতুরের পক্ষে নেহাতই অসম মল্লযুদ্ধ। তবে এখন অনেকটা সময় এবং এনার্জি সঞ্চয় হচ্ছে।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহেই নভেল করোনো মোকাবিলা করতে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় স্প্রিংব্রেকের পর থেকে পাঠশালা বন্ধ। তবে পড়াশোনা বন্ধ হবে না। জুম (Zoom), মুডল (Moodle), ইত্যাদি ক্লাসোপযোগী সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন নভেল পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম চলবে। নোটবন্দির আগে যে রকম আমরা অনেকেই জানতাম না এটিএমের বিকল্প পেটিএম হতে পারে, তেমনি এই ‘কোভিড-সাগরে’ তলিয়ে যাবার আগেও আমরা অবগত ছিলাম না জুম নামক এই খড়কুটোর ব্যাপারে। আমার মতো যারা ক্লাসরুমটিকে স্টেজ এবং লেকচার ব্যাপারটিকে পারফর্ম্যান্স মনে করে অভ্যস্ত, তাঁরা মহা বিপদে পড়েছে।
ইতিমধ্যে হয়েছে আর এক সমস্যা। টাইমজোনের পার্থক্য। যাঁদের জানার তাঁরা জানেন মার্কিনমুলুক জুড়ে তিন তিনটে টাইমজোন। মন্ত্রীমশাই “আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ” বলার পর অনেকেই বাড়ি চলে গেছে, ওখান থেকেই অনলাইনে ক্লাস করছে। আমার এক ছাত্রের সঙ্গে কোনও একদিন সকাল দশটায় ইন্ডিভিজুয়াল কনফারেন্স করার কথা। নটা পনেরোয় ঘুম ভাঙার পর দেখি ইনবক্স ভরে গেছে তার ইমেলে। “সকাল দশটা বাজে। আমি কম্পিউটারের সামনে জুম চালিয়ে বসে। আপনি কোথায়? সব ঠিক আছে তো?” ইত্যাদি। বেশ ভিরমি খেয়ে গেলাম। ঘড়িগুলোও লকডাউনে চলে গেল নাকি? তারপর খেয়াল হল বোস্টন শহর, অর্থাৎ যেখান থেকে ওই ছাত্রটি আমাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, সেখানে সকাল দশটা পনেরো মিনিট আগেই বেজে গিয়েছে। তারও খেয়াল ছিল না ইলিনয় এক ঘন্টা পিছিয়ে। দু’জনেই ভুল বুঝতে পারার পর একসঙ্গে হেসে উঠলাম। আলাপ আলোচনা চলতে থাকল।
গোটা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যখন কোভিড নিরাময়ের ঔষধ অথবা টিকার খোঁজে ব্যস্ত, যখন বাণিজ্যের পণ্ডিতরা বিশ্বের অর্থনীতির কি অবস্থা হবে তার জটিল অঙ্কে নিমজ্জিত, তখন আমরা, যাঁরা টু পাইস সাহিত্য, সমাজবিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি চর্চা-টর্চা করে থাকি আর কি, আমরাও মেতে উঠেছি এই মারণ রোগকে বুঝে ওঠার খেলায়। নতুন করে পড়ছি মহামারির ওপর সাহিত্য। মনে হচ্ছে আমরা সবাই যেন যে যাঁর বাড়িতে সমাজবিচ্যুত প্রাণীর মতো নোয়ার আর্কে বসে আছি বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। চল্লিশ দিন হোক, বা চারশো, একদিন বৃষ্টি থামবে। রামধনু উঠবে।
দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায়
(লেখক ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় আর্বানা-শ্যাম্পেনে ইংরেজি বিভাগে গবেষক ও শিক্ষক সহকারী হিসেবে কর্মরত)