লকডাউনে বন্দি ম্যাসাচুসেটস।
আজ সকাল থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে, তবু মনটা সত্যিই খারাপ। খবরের চ্যানেল আর অনলাইনে নিউজ পড়তে পড়তে শিউরে উঠছি। যে ভাবে প্রত্যেক দিন কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত/মৃত্যুর সংখ্যা আগের পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে গিয়ে নতুন নতুন রেকর্ড করছে এবং পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুমিছিল চলছে— তাতে মনটা ভারাক্রান্ত লাগছে। ভাল লাগছে না কোনও কিছু। জানি না আর কত দিন এই ভাবে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে।
বিগত প্রায় এক বছর ধরে আমি ও আমার স্ত্রী থাকছি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বস্টন শহরে। বস্টন খুবই প্রাণবন্ত একটি শহর, সারা বছর কোনও না কোনও উৎসব লেগেই থাকে এখানে। মানুষজনও ভীষণ মিশুকে ও শান্ত স্বভাবের। এখানকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল এবং হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের নিউরোলজি বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চার আমি। গত ২০ মার্চ থেকে আমাদের রিসার্চ ল্যাব বন্ধ। গবেষণার সমস্ত কাজ বন্ধ। যদিও প্রত্যেক দিন অনলাইনে কোনও না কোনও মিটিং (অনলাইন কোর্স/ট্রেনিং, গ্রান্ট রাইটিং ওয়ার্কশপ, সেমিনার, গ্রুপ ডিসকাশন) থাকছে তবুও হাঁপিয়ে উঠছি, কবে থেকে যে আবার আগের মতো ল্যাবে কাজ করতে পারব জানি না।
দশ দিন আগে পর্যন্তও এখানকার মানুষজনের মধ্যে কোনও করোনা-ভীতি ছিল না, যেটা এখন দেখা যাচ্ছে। প্রথম বিশ্বের দেশ, অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার জেরে তুড়ি মেরে দেখে নেওয়ার এক অদৃশ্য আস্ফালন ছিল। কিন্তু এখন সেটা আর নেই। এই মুহূর্তে বিশ্বে করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি এখানে। প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত এবং ২৪ হাজার মানুষ মৃত। ম্যাসাচুসেটসে যেখানে ২০ দিন আগে পর্যন্তও মাত্র ৬০০-৭০০ জন লোক আক্রান্ত ছিল সেখানে এখন সংখ্যাটা প্রায় ২৭ হাজার। ওয়েবসাইটে দেখাচ্ছে যে এখানকার সর্বমোট ৯০ টি হাসপাতালে সর্বোচ্চ বেড সংখ্যা হচ্ছে ১৬ হাজার ৪০০। তার মধ্যে কতগুলো আইসিইউ বেড জানি না।
আরও পড়ুন: অপেক্ষায় আছি কবে এই দুর্দিন কাটবে
বাড়ির জন্য মনকেমন করছে। আত্মীয়স্বজন সবাইকে বারবার ফোন করে বলছি যেন বাড়িতেই থাকেন, খুব প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে না বেরন। যদি বেরতেই হয়, তা হলে যেন সঠিক সুরক্ষা নিয়ে বেরন। আসলে ভারতবর্ষের যা জনঘনত্ব, তাতে একবার যদি বাড়াবাড়ি রকমের গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়, তা হলে যে কী হতে পারে, তা ভেবেই হাত পা কাঁপতে শুরু করছে। যদি সবাই লকডাউন না মেনে বাইরে বেরতে থাকে, তা হলে কিন্তু সব শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। পশ্চিবঙ্গের মানুষের কাছে আবেদন, আপনারা বাড়িতে থাকুন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। হয়তো জীবনে আর কখনও এত দিনের লম্বা ছুটি আর আসবে না।
আরও পড়ুন: জনশূন্য জনপদ, রূপকথার গল্পে যেমন হয়
যেন ঘুমিয়ে আছে প্রাণবন্ত ম্যাসাচুসেটস!
এই সংক্রমণ চেনকে আটকাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদেরও প্রচুর টেস্ট শুরু করতে হবে। সারা বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বানানোর জন্য। তাঁদেরকে একটু সময় দিন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে এই কঠিন সময়ে যাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, সেই সকল ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকেল স্টাফ, ওয়ার্ডবয়, সংবাদমাধ্যমের কর্মী ও পুলিশকে মন থেকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। কিন্তু যখন শুনি যে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত বলে তাদেরকে ঘরভাড়া দেওয়া হচ্ছে না বা ঘর খালি করতে বলা হচ্ছে, তখন মনে হচ্ছে এ কী মারাত্মক ভুল করা হচ্ছে! এই সময় তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাঁদের কুর্ণিশ না করে এমন ব্যবহার আমাদের সমাজের অবক্ষয়কেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে।
সবশেষে সকলকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। নিরাপদে থাকুন ও সুস্থ থাকুন।
প্রসেনজিৎ মণ্ডল
বস্টন, ম্যাসাচুসেটস।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)