জনমানবহীন রাস্তা।
আতঙ্কের এক প্রহরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী।
নিজ গৃহে অন্তরীণ প্রায় ৪ সপ্তাহ। বাজারে গিয়েছি সাকুল্যে ৩ বার। আমার ঘরের নীচের তলাটা এখন আমার ক্লাস রুম, আমার অফিস, আমার শরীরচর্চা কেন্দ্র। একের ভেতরে তিন। এ ঘরে আমার যে টিভিটা ছিল সেটার উপরে চাপিয়ে দিয়েছি একটা সাদা বোর্ড। তার খানিকটা দূরে টেবলে একটা স্ট্যান্ডের উপরে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। নির্দিষ্ট সময়ে ছাত্রছাত্রী ভিডিয়ো কনফারেন্সে হাজির হয় আমার ল্যাপটপে। আর আমি ওদের পড়াই সেই সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে লিখে। সারা দিনে সূর্যের দেখা মেলে খুব কম। কাজের দিন আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন মিলে মিশে একাকার। ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনে চোখ না রেখে সপ্তাহের দিন বলতে পারি না। আমার খুব মনে হচ্ছে, এটা আমার জন্য এক ধরনের শাস্তি। অতি প্রয়োজনীয় শাস্তি। কেন মনে হচ্ছে এমনটা, একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদ ম্যলথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব মানতেন ডারউইন, বার্নার্ড শ এবং এইচ জি ওয়েলসের মতো বিখ্যাত মানুষও। সে তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর জন সংখ্যা যাতে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাড়তে পারে সে জন্য ইতিহাসে দুর্বল জনগোষ্ঠীর উপর নিবীর্যকরণ (স্টেরিলাইজেশন) –সহ অনেক ধরনের নিষ্পেষণ চালানো হয়েছিল। ১৮৪০ সালে আয়ারল্যান্ডের দুর্ভিক্ষের সময়ে ব্রিটিশ সহকারী অর্থমন্ত্রী চার্লস ট্রেভেলিয়ান বলেছিলেন, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে অতিরিক্ত জন সংখ্যা কমানোর প্রাকৃতিক উপায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে ক্ষমতাধরেরা আরও ধুরন্ধর হয়েছে। হিটলার থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ক্ষমতাধরেরা শুধু দুর্ভিক্ষের আশায় বসে না থেকে, হয় নিজেরাই পরোক্ষভাবে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছে। নয় তো নিজের ক্ষমতা দিয়ে দুর্বল জনগোষ্টীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরেছে। সবই দুর্বলকে সংখ্যায় আরও দুর্বল করে ম্যালথাস বা ডারউইনের তত্ত্বে বিশ্বাসী সবল জাতিকে আরও শক্তিশালী করে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পৃথিবীর আধিপত্য দিয়ে রাখার পাঁয়তাড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবের সঙ্গে আমার শাস্তি পাওয়ার যোগসূত্রটা কোথায়?
১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫। এই ২০ বছরে ভিয়েতনামে কত মানুষ মারা গিয়েছেন, জানেন? দক্ষিণ আফ্রিকার ভিয়েতনাম দূতাবাসের সুত্র মতে, শুধু সাধারণ মানুষই মরেছে ২০ লক্ষের চেয়ে বেশি। সেই ১৯৬৪ সাল থেকে দুর্বল প্যালেস্টাইনে চলছে লাশের শোভাযাত্রা। ১৯৭১-এর ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে খুন করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে পরাশক্তিগুলোর সামনে মানুষ মরেছে কুকুরের সঙ্গে খাবারের লড়াইয়ে। ইরান-ইরাক যুদ্ধে শুধু মাত্র নিহতই হয়েছে ৩ থেকে ৫ লক্ষ লোক। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকাতে ৩ হাজার প্রাণ সংহারের জের ধরে গত ১৮ বছরে চোখের সামনে দিয়ে ইরাক-আফগানিস্তানে ঝরে গেছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনে মানুষ হয় মরছে গুলি আর বোমায়। নয় পালাতে গিয়ে মরছে জলে ডুবে। এ যেন কোন উপায়ে মারা যেতে চাও, তার লটারি! মনে আছে সেই সিরিয়ান শিশুটির ভেসে আসা মৃতদেহের কথা? একটি সূত্র মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জাতিগত সংঘর্ষ বা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৮০ লক্ষেরও বেশি। আমার ধারণা, এ সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। ভিটে হারানো লোকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ৮০ লক্ষ প্রাণ হারানোর দায় কার? এ সভ্য (?) মানবজাতির নিশ্চয়ই। সেই সভ্য জাতির একজন সদস্য হয়ে এর দায় থেকে তো আমি মুক্তি পেতে পারি না। পারি কি?
করোনার দাপটে বিপর্যস্ত এ বিশ্বের মহাশক্তিধর এক রাষ্ট্রের গ্রাম এলাকার একটি ঘরের ভূতলে লুকিয়ে আছি। লুকিয়ে থেকে ভাবছি, সমুদ্রতীরে উপুড় হয়ে থাকা মৃত সিরিয়ান শিশুটির কথা। ভাবছি মৃত বাবার পিঠে রিও গ্রান্ডে ভেসে আসা দু’বছরের সালভাদরিয়ান শিশুর অসাড় দেহটির কথা। কী অবলীলায় আমরা ভুলে যাই ওদের। যেন কিছুই হচ্ছে না কোথাও। ঘণ্টা পর ঘণ্টা ধরে মুখে অন্ন তুলে যাই। সৌদি-মার্কিন বোমায় ক্ষত-বিক্ষত ইয়েমেনির লাশ পড়ে থাকে আমার চোখের সামনে। একটু জলের জন্য হাহাকার করে মরে আহত স্বজন তার। আর আমি কমলার রসে ঠোঁট ভিজাই। তুরস্কের নিক্ষিপ্ত গোলায় কুর্দি পরিবার মিশে যায় সৃষ্টিকর্তার জমিনে। ধুলোবালি আর ধোঁয়ার বহর ওড়ে। আমি কফির মগে ধোঁয়া তুলি। ইজরায়েলি বিমান হানায় গাজায় জ্বলে দাউ দাউ আগুন। আদিম মানবের আগ্রাসী ফলায় ছিটকে পড়ে কারও হাত, কারও মাথা আর কারও উরু। আমি মুরগির রানে কামড় বসাই। আমি ধরে নিয়েছি, এ সব স্বাভাবিক। আমি, আমি আর আমি। সারা দিন শুধু আমি ছুটি, আমার পিছনে। তাই এটা আমার শাস্তি। এ শাস্তি আমাকে ভোগ করতেই হবে।
আমি-আমি, আমার-আমার করতে গিয়ে এ বিশ্বকে বাসের অযোগ্য করে ফেলেছি আমরা। ভিয়েতনামে যে পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার ধংসলীলা হিরোশিমা-নাগাসাকির থেকে ৭০০ গুণ বেশি। ফাটেনি এমন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ওদের লাগবে ৩০০ বছর। ফসলি জমির বিনাশ হয়েছে বেশুমার। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অন্য দেশগুলো সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন আজ শ্মশানের মতো। যেন মৃত্যুপুরীর ভাস্কর্য। মায়ানমারের খাঁ খাঁ করা রোহিঙ্গা বসতিগুলো, দক্ষিণ আমেরিকার দুর্ভিক্ষপীড়িত বুভুক্ষু জনগোষ্ঠী, মেডিটেরিয়ানের তীরে ভেসে আসা কৃশকায় লাশের সারি, এ সবই হচ্ছে সভ্য মানবজাতির অসভ্য লালসার ফসল। সে লালসার চূড়ান্তে পৌঁছেছে। আমরা পৃথিবীর বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছি সিএফসি, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড। সমুদ্রের লোনা জলে হারিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, কৃষকের ভিটে, আর জেলেদের সংসার। লাল নীল কাঁকড়ারা আজ আমাদের সৈকতে আসে না। কচ্ছপেরা হারিয়ে গেছে দূর সমুদ্রে। ঘন কুয়াশার চাদর আজ বিলীন হয়েছে ধুলোর আস্তরণে। প্রকৃতি কি এর শোধ নেবে না?
মানুষ যেমন প্রকৃতির অংশ, অন্য সৃষ্টিও তাই। করোনার প্রকোপে অন্য সৃষ্টি মেতেছে জীবনের জয়গানে। লাল নীল কাঁকড়ারা নৃত্যে মেতেছে বালুচরে। ঢাকার বাতাসে আজ বিশুদ্ধতার হাতছানি। কাজের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আমরা। আজ পরিবার-পরিজন নিয়ে একঘরে।
ভিক্টর হুগো বলেছিলেন, রাত যত ভয়াল আর অন্ধকারময় হোক না কেন, সকালে সূর্যের দেখা মিলবেই। আমিও আশাবাদী মানুষ। এ সঙ্কট এক দিন চলে যাবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সঙ্কটের সময়ে আমরা কী আচরণ করেছি ও কী শিক্ষা নিয়েছি, সেটাই বড় হয়ে থাকবে।
আবদুস শাকুর ওয়াহেদ
অধ্যাপক, প্রাণ পরিসংখ্যান বিভাগ
ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ, যুক্তরাষ্ট্র