ভারতীয়রা ভাল থাকলেও, খাবার নিয়ে সমস্যায় ভ্যাঙ্কুভারের ফুটপাতবাসীরা

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২০ ১৭:১৩
Share:

ভ্যাঙ্কুভারের দৃশ্য। নিজস্ব চিত্র।

গত বছর ডিসেম্বরে এসে জানুয়ারির শেষে দেশে ফিরেছিলাম। শীতটা তেমন মালুম হয়নি। এ বার এসেছি সপরিবারে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় এর পড়াশুনো দিব্যি চলছে। গিন্নি চাকরি করছেন। কন্যাও স্কুলে যাতায়াত করছে। নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করার প্রাথমিক অভিঘাতটা প্রায় কাটিয়ে উঠেছি। ভ্যাঙ্কুভার শহরটা বড্ড সুন্দর। উত্তরের আকাশ জুড়ে নর্থ সোর পাহাড় যেন সদা জাগ্রত অভিভাবক। পশ্চিমে রয়েছে পুলিন সাগর। শহরকে ত্রিধাবিভক্ত করে বয়ে চলেছে ফ্রেজার নদী।

Advertisement

আমরা থাকি পশ্চিম প্রান্তে রিচমন্ডে। এখানে মূলত চীন আর হংকংয়ের অভিবাসীদের বাস। এটি সম্ভবত কানাডার সবচেয়ে শান্ত পাড়া। আমর বাড়ি থেকে আমেরিকার সীমান্ত মিনিট পনেরোর ড্রাইভ। অনেকেই গাড়ির তেল ভরতে ওপারে ঘুরে আসে। এ বারে শীতটা ভালই পড়েছিল। রাস্তায় প্রায় কোমর সমান বরফ। মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তুষার যুগ চলেছে। ন্যাড়া গাছগুলোতে মুকুল ধরা শুরু হতেই প্রাণে বসন্ত এল। তখনও এ দেশে করোনা তেমন থাবা গেড়ে বসেনি।

আমাদের পাহাড় এক বৃহস্পতিবার উহানের মানুষদের জন্য প্রার্থনা হল। আর তার পরের দিনই আমার সর্দি কাশী জ্বর। সামান্য গা গরম। সেই নিয়েই ক্লাসে গিয়েছিলাম। আমার জ্বরের কথা জানাজানি হতেই হুলস্থুল পড়ে গেল। প্রিন্সিপাল থেকে ছাত্র সবাই এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল— আর ইউ ওকে। আমাদের কলেজটা থিওলজিক্যাল কলেজ। উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার চার্চের যাজক যাজিকাদের ট্রেনিং সেন্টার বলা যায়। আমি ভিন্ন আর সবাই আকণ্ঠ ধার্মিক। স্বভাবতই কোমলপ্রাণ। প্রিন্সিপাল বললেন আগামী দুসপ্তাহ আমার কলেজে আসার দরকার নেই। কোন কিছুর দরকার হলে যেন হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে জানালেই চলবে।

Advertisement

আমি ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রথম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া মানুষদের একজন। এ দেশে হেল্থকেয়ার প্রায় ফ্রি। আমার ডাক্তার বাবু পাকিস্তানি। তিনি আশ্বস্ত করলেন। আমারটা সাধারণ সর্দি জ্বর। দিন চারেক ভুগে সেরে উঠলাম। তত দিনে মহামারি শুরু হয়ে গেছে। প্রথম করোনা আক্রান্ত ধরা পড়ার চারদিনের মাথায় সংখ্যাটা একশো ছাড়াল। তার পর প্রতিদিন আক্রন্তের সংখ্যা পঞ্চাশ করে বাড়ছে। বেশীরভাগ আক্রান্ত ভ্যাঙ্কুভারের। সাত লক্ষ জন সংখ্যার শহরে এখনও অবধি মৃত সাতাশি।

এর মধ্যে দু’বার সুপারমার্কেটে গিয়েছি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টয়লেট পেপার অপ্রতুল। মার্কেটের বিশাল তাকগুলো খাঁ খাঁ করছে। প্রথমদিকে পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যাচ্ছিল না দুধ, ডিম, মাংস, রুটি। এখন অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। ভারতীয় দোকানে শাক সব্জী এখনো পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম হয়েছে দ্বিগুন।

ভ্যাঙ্কুভারে মহামারী এতটা ছড়াতো না। এরা প্রথমদিকে একে বারেই গুরুত্ব দেয়নি। কাউকেই মুখাবরণী ব্যবহার করতে দেখিনি। বসন্তের রোদ্দুরে সকাল বিকেল পার্কে, সৈকতে ভিড় হচ্ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশ। লক ডাউন ঘোষণা করা হয়নি। মেয়ের স্কুল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে অন লাইনে। এ দিকে দিন দশেক আগেও ইংলিশ বে তে প্রায় হাজার খানেক মানুষ বেড়াতে গিয়েছিল। এখন সরকার কঠোর হয়েছে। সৈকত, পার্ক, বন্ধ করা হয়েছে। মানুষও আগের চেয়ে সচেতন। স্কাই ট্রেন, বাস, ফেরি চলছে। কিন্তু প্রায় যাত্রী শূণ্য। রিচমন্ডের এক বাস ড্রাইভারের মৃত্যু হওয়ার পর থেকে বাসের সামনের গেট বন্ধ। অফিস খোলা আছে। গিন্নি যাচ্ছেন কাজে। ওর অফিসে থার্মাল চেকিং হচ্ছে এই যা ভরসা।

ভ্যাঙ্কুভারে প্রচুর গৃহহীন মানুষ থাকেন। এদের পক্ষে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানা অসম্ভব। মানুষগুলোর থাকার ব্যবস্থা এখনও হয়নি। দিন তিনেক আগে প্রায় তিরিশজন গৃহহীন একটি বন্ধ প্রাইমারি স্কুলে তালা ভেঙে ঢুকেছিলেন আশ্রয়ের আশায়। পুলিশ বের করে দিয়েছে। আমার সহপাঠীরা বিভিন্ন চার্চের তরফ থেকে ত্রাণ বিলি করছেন, তাঁদের পরিচর্যা করছেন। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সামান্য। সরকার নাগরিকদের জন্য আর্থিক সাহায্য ঘোষণা করেছেন। যদিও তা বেশিরভাগের কাছেই পৌঁছয়নি। দ্রুত সাহায্য না এলে বহু মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে।

পাশাপাশি করোনার জেরে হাসপাতাল কানায় কানায় ভর্তি। টেস্ট যে খুব বেশি হচ্ছে তা বলা যাবে না। স্বাস্থ্য বিভাগ অন লাইন অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু কেউ অসুস্থ হলে টেস্ট করাতে সমস্যায় পড়ছেন। হেল্পলাইনে ফোন করলে লাইনই পাওয়া যাচ্ছে না। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কাজে যাচ্ছেন। কিছু জায়গায় বাড়ি থেকে কাজও চালু হয়েছে।

এখানে ভারতীয়দের অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভালো। আক্রান্তের হার অন্যদের চেয়ে কম। ভ্যাঙ্কুভারে ভারতীয় আর ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রচুর। হোয়াটস্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে যোগাযোগ থাকছে। বাঙালি বন্ধু বান্ধবরা খোঁজ নিচ্ছেন রোজই । দেশে রয়েছেন বাবা মা। প্রতিদিন কথা বলছি। কিন্তু সেখানকার অবস্থা শুনে দুশ্চিন্তা প্রতিদিন বাড়ছে।

আমাদের ব্যাক ইর্য়াডে চেরি গাছগুলো ফুলে ভেঙে পড়ছে। এখন সন্ধ্যে আটটা। সাতটার থেকে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছি। মৃদু আলো এখনো আছে। ঠিক সাতটায় সবাই মিলে হাততালি দিলাম ফ্রন্ট লাইন কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে। তারপর আমাদের পাশের বাড়ির বৃদ্ধ স্যাক্সোফোনে সুর ধরেছেন। বারান্দায় আর ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে তাল দিচ্ছি প্রতিবেশীরা। চাঁদ উঠেছে। শুভ্র চেরী ঝরে পড়ছে ঘাসে। মহামারির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই আমাদের বসন্ত উদ্‌যাপন।

ভ্যাঙ্কুভার থেকে নির্মাল্য দাস

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement