লকডাউনে সুনসান নাইজিরিয়ার রাজধানী আবুঝার রাস্তাঘাট। ছবি-লেখক।
কর্মসূত্রে আমি এ বার নিয়ে তৃতীয় বার নাইজিরিয়াতে। অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভালো-মন্দ দু’টোই রয়েছে। তবে সে সব অন্য সময় অন্য জায়গায় বলব। এখন তো লকডাউন, তার কথাই বলি। আমি এসেছিলাম অগস্টে। জোস্ বলে একটা শহরে। নাইজিরিয়ার ‘দার্জিলিং’। ছোট্ট জনপদ, সারা বছরই ঠান্ডা। একটু ঢিমেতালের জীবনযাপন। সঙ্গে একটু তিক্ত জঙ্গি আক্রমণের ক্ষতচিহ্নের ইতিহাস।
জানুয়ারিতে বদলি হলাম রাজধানী আবুজাতে। ঝাঁ চকচকে পরিকল্পিত শহর (‘প্ল্যান্ড সিটি’)। একদমই নতুন। বয়স ৪০ বছরেরও কম। রাস্তাঘাট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্য, সবুজায়ন এবং আমোদপ্রমোদে আমাদের দেশের সব ক’টা শহরকে দশ গোল দেবে। আবুজায় দূতাবাস, ধনকুবের ও মন্ত্ৰীদের আবাস দেখে বোঝা যায় না, এটা কোনও তৃতীয় বিশ্বের দেশের শহর। দেশের বাকি অংশ অবশ্য একেবারেই অন্য রকম।
চিনে করোনা যখন প্রথম ভয়ঙ্কর আকার নিল, ধীরে ধীরে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ভারতবর্ষেও থাবা বসাল, অনলাইন আনন্দবাজারের সৌজন্যে সে বিষয়ে সব খোঁজখবরই পাচ্ছিলাম। তবে বাকি সবার মতোই এর ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের আন্দাজ আমারও ছিল না। নাইজিরিয়াতে তখনও কোনও আক্রান্তের খবর নেই। নাকে মাস্ক চাপিয়ে আর স্যানিটাইজারের বোতল হাতে তখনও দেশ পারাপার চলছে।
এমন সময় প্রথম খবরটা এল। ইটালি থেকে ফেরা এক জন লাগোস বিমানবন্দর হয়ে ওসুন রাজ্যে কাজে যোগ দিয়ে জ্বর বাধালেন। তার পর পরীক্ষা, পরীক্ষায় ডাহা পাশ। এটা এমন পরীক্ষা, যেটা ফেল মারলেই লোকে হাফ ছেড়ে বাঁচে! নড়েচড়ে বসল সরকার। বন্ধ হল আন্তর্জাতিক সীমানা। শুরুতে অবাকই হয়েছিলাম, আমেরিকার সীমান্ত খোলা, তা সত্ত্বেও আগেভাগে ব্যবস্থা! পরে মনে পড়ল, কয়েক বছর আগেই আর এক মারণ রোগ ইবোলার হাত থেকে নাইজিরিয়া খুব সামান্যর জন্যে রক্ষা পেয়েছিল ঠিক সময়ে ঠিক ব্যবস্থা নিয়ে। সেই অভিজ্ঞতাই কাজে লেগেছে। এয়ারপোর্টে অনেক আগে থেকেই মজুত থার্মাল স্ক্রিনিং মেশিনে দেহের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা। প্রতিটি আগন্তুকের ঠিকুজি-কুষ্ঠি আর যাত্রাপথের বিবরণ-সহ যাত্রাপথের ইতিহাসের মুচলেকা নেওয়া। শপিং মলগুলোর প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোওয়ার ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন: চিনের ‘ব্যর্থ’ ওষুধেই দিশা দেখাচ্ছেন মার্কিন বিজ্ঞানী
আরও পড়ুন: সংক্রমণ সাগর দত্ত হাসপাতালে, ১৭ চিকিৎসক-সহ কোয়রান্টিনে ৩৬
কয়েক দিন পরে আস্তে আস্তে আরও খবর আসতে থাকল। বাড়তে লাগল আক্রান্তের সংখ্যা। আমাদের দেশের কায়দায় হঠাৎ করেই ঘোষণা হল লকডাউন। সব থেকে বড় দু’টো শহর আবুজা আর লাগোসে, দুই সপ্তাহের জন্য। তার পর বন্ধ হল আন্তঃরাজ্য সীমানা। পরে মোটামুটি সারা দেশেই। এতো কিছুর ফলাফল বেশ হাতেনাতে পাওয়া গিয়েছে। যেখানে বিশ্বের নামীদামি দেশ জর্জরিত, সেখানে গরিব আর পিছিয়ে পড়া দেশ নাইজিরিয়াতে করোনা সে ভাবে কায়দা করতে পারেনি।
লকডাউনে আবুঝার বাজার। ছবি-লেখক।
স্থানীয় বাজার খুলছে সপ্তাহে দু’দিন, ৪-৫ ঘন্টার জন্য। তা-ও শুধু মুদিখানা, কাঁচা সব্জি আর মাছ-মাংস। বাকি বিনোদন আর শপিং মল পুরোপুরি বন্ধ। রাস্তাঘাট ধু ধু করছে। জরুরি কাজে চলছে দু’-একটা গাড়ি। তা-ও একসাথে দু’জনের বেশি থাকলেই পুলিশি চোখরাঙানি। গণপরিবহনের মূল স্তম্ভ উবের, বোল্ট আর গ্রিন ট্যাক্সি পুরোপুরি বন্ধ। এক সময় বাইক ট্যাক্সি, স্থানীয় ভাষায় ‘ওকাডা’, বেশ সস্তার আর সময় বাঁচানোর পরিবহণ ছিল, তার পাটও চুকেছে অনেক দিন।
এরই মধ্যে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইনের নামমাহাত্ম্য শুনে কেনা আর খাওয়ার হিড়িক লেগেছিল। তা থমকাল লাগোসে বেশ কিছু মানুষের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় হাসপাতালমুখো হওয়ার পর।
নাইজিরিয়ার বাজার আমাদের দেশের মতো ক্রেতা-নিয়ন্ত্রিত নয়। যে কোনও সময় যে কোনও কিছু বাজার থেকে গায়েব হয়ে যেতে পারে বা দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যেতে পারে। তাই লকডাউনের আভাস পেয়েই এক মাসের প্রয়োজনীয় সব কিছুই মজুত করে রেখেছি ঘরে। তা-ও শেষ মুহূর্তে খাওয়ার জল মজুত করতে বেশ কিছু বাড়তি মাশুল গুনতে হয়েছে।
লাগোস বরাবরই চুরি-ডাকাতির কেন্দ্র। লকডাউনে পেটে টান পড়ায়, তা যেন আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। আমাদের দেশের পুরনো ডাকাতির কায়দায় চিঠিতে হুমকি দিয়ে, তার পর ডাকাতি শুরু হয়েছে। একসাথে শতাধিক লোকের কুখ্যাত গ্যাং, অস্ত্র-সহ আক্রমণ করছে সোসাইটিগুলোতে। টাকা, খাবার লুটপাট চলছে। রেহাই পাচ্ছে না ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকাও। পিওএস কার্ড সোয়াইপ মেসিন নিয়ে এসে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ্কের টাকাও। বাধ্য হয়ে মানুষ বেসরকারি সশস্ত্র সিকিউরিটি বা এলাকার যুবকদের নিয়ে গণপ্রতিরোধ শুরু করলেন, রাত জেগে টায়ার জ্বালিয়ে পাহারা দিয়ে।
দু’-দু’বার দু’সপ্তাহ করে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ার পর পরিস্থিতি দেখে ও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কথা ভেবে শর্তসাপেক্ষে লকডাউন তুলে নেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে ২ মে থেকে। তবে রাত ৮টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কার্ফু বলবৎ থাকবে। আন্তঃরাজ্য ভ্রমণের উপরেও জারি থাকবে নিষেধাজ্ঞা।
আমি আইটি সেক্টরে কাজের সুবাদে এখন ঘরে বসেই কাজের পাশাপাশি হোয়াটস্যাপে ভিডিও কল, আনন্দবাজার, ফেসবুক, নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইমের ভরসায় দিনযাপন করছি। যাঁদের ছেড়ে এত দূর দেশে পড়ে আছি, তাঁদের জন্য উদ্বেগ আর অপেক্ষা- কবে সব কিছু আবার আগের মতো হবে?
অরিন্দম বন্দোপাধ্যায়, আবুজা, নাইজিরিরা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)