শিলাদিত্য সেনের ‘পুরুষরা ঠিক যে নারীকে চায়’ (৭-৪) পড়ে ভাল লাগল। শিলাদিত্যবাবু পণ্ডিত মানুষ, চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি করছেনও অনেকদিন। লেখক লিখেছেন, সুচিত্রা সেনের স্বেচ্ছানির্বাসনের পিছনে ‘দায়ী বাঙালি পুরুষরা’। সত্যিই কি তাই? তথ্যপ্রমাণ কি সে কথা বলে? শ্রীমতী সেন কেন স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়েছিলেন, আমি জানি না। তবে আবেগে ভেসে না গিয়ে যুক্তিনিষ্ঠ আন্দাজ করতে পারি।
সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়েছিলেন ১৯৭৯-তে। তাই নিয়ে বাঙালির বিস্তর গর্ব। কিন্তু সঙ্গে এটাও রূঢ় বাস্তব যে, ১৯৭৩-১৯৭৮ এই ছ’বছরে সুচিত্রার হিট বাংলা ছবি একটিই, দেবী চৌধুরানী। ফ্লপ পর পর চারটি: শ্রাবণসন্ধ্যা, প্রিয় বান্ধবী, দত্তা, প্রণয় পাশা। প্রতিতুলনায় ওই সময়কালে অপর্ণা সেন করেছেন ২৪টি বাংলা ছবি; যার মধ্যে আছে সোনার খাঁচা, এপার ওপার, বসন্ত বিলাপ, ছুটির ফাঁদে, রাগ অনুরাগ, অসময়, অজস্র ধন্যবাদ, প্রক্সি-র মত সর্বকালীন হিট বাংলা ছবি। আর এক নায়িকা সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় ওই সময়কালে করেছেন ১৩টি বাংলা ছবি; যার মধ্যে আছে বসন্ত বিলাপ, বিকেলে ভোরের ফুল, অগ্নীশ্বর, সুদূর নীহারিকা, নয়ন-এর মত হিট বাংলা ছবি। খুব অযৌক্তিক হবে কি, যদি ভেবে নিই, উপর্যুপরি ফ্লপ ছবির ভিড়ে এবং দুই নতুন নায়িকার উল্কাবেগে উত্থানের সূত্রে, শ্রীমতী সেনের মত বুদ্ধিমতী নারী বুঝেছিলেন যে শেষের সে দিন সমাগত? নিজের গরিমা, ক্যারিশমা বজায় রাখতে হলে আত্মনির্বাসন ছাড়া পথ নেই! রোল মডেল ছিলেন হাতের কাছেই, ‘সুইডিশ স্ফিংক্স’ গ্রেটা গার্বো (১৯০৫ -১৯৯০; আত্মনির্বাসন চল্লিশের দশকে)। তবে শ্রীমতী সেনের এই আত্মনির্বাসনের সিদ্ধান্তে কি মিশে ছিল না কিঞ্চিৎ অভিমানও?
চামেলি পাল
বাটানগর
সফল তাইওয়ান
জানুয়ারির ৯ তারিখে যখন কলকাতা থেকে তাইপে-এর প্লেন ধরি, পৃথিবীটা তখনও অন্য রকম ছিল। উহানের দৈত্য এমন ভাবে মানবজাতিকে খাদের ধারে নিয়ে আসেনি। যে দেশটায় এই মুহূর্তে আমি রয়েছি, সেই তাইওয়ান এখনও অবধি বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ অঞ্চলের একটি। তাইওয়ানের আয়তন ৩৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার, পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকেরও কম, আর লোকসংখ্যা মেরেকেটে আড়াই কোটি। এই ছোট দেশটিতে শুধু ২০১৯ সালেই এসেছিলেন এক কোটির ওপর পর্যটক। এই সে দিনও ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতায়াত, রাজধানী তাইপে আর চিনের মধ্যে। সেই হিসেবে এত দিনে কোভিডের বিধ্বংসী হয়ে ওঠার কথা ছিল এ দেশে।
কিন্তু ৯ এপ্রিল, যখন সারা পৃথিবীতে ১৫ লক্ষের বেশি লোক সংক্রমিত, মৃত প্রায় ৮৮ হাজার, তাইওয়ানে সংক্রমিত মোটে ৩৮০ জন আর মৃত ৫! পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ তাইওয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তাইওয়ানের মডেল অনুসরণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাইওয়ানের এই সাফল্যের পিছনে আছে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যের দিকে নজর আর নিখুঁত পরিকল্পনা।
তাইওয়ানের নাগরিক তো বটেই, আমার মতো বহিরাগত অধ্যাপকদেরও দেওয়া হয় জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা কার্ড, যাতে অতি কম খরচে অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুবিধে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, তাইপেই শহরের স্বাস্থ্য সূচক পৃথিবীতে এক নম্বর। তা সত্ত্বেও তাইওয়ান কিন্তু ঘরপোড়া গরু। ২০০৩ সালে সার্স কোভ (SARS-CoV, করোনার সমগোত্রীয়) রোগে ৭৩ জন মারা যায়, যাতে মৃত্যুহার ছিল ২১ শতাংশ। তা থেকেই শিক্ষা নিয়ে তাইওয়ান ঢেলে সাজিয়েছিল তার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিসি)।
তাই উহানের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাইওয়ান সিডিসি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-কে ৩১ ডিসেম্বর একটি চিঠি লিখে এই অজানা ভাইরাসের ব্যাপারে জানতে চায়। বিশেষ করে এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় কি না, সে ব্যাপারে। হু সেই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করলেও কোনও উত্তর দেয়নি, কারণ তাইওয়ান হু-র সদস্য রাষ্ট্র নয় এবং চিন তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র বলে মনে করে না।
জানুয়ারির প্রথমেই তাইওয়ানের সিডিসি আগের ১৪ দিনে উহান ভ্রমণকারী সমস্ত ব্যক্তি— যাদের জ্বর বা শ্বাসনালীর সংক্রমণের লক্ষণ ছিল এবং কোভিড পজ়িটিভ ধরা পড়ে, তাদের আলাদা করে রেখে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিল। দ্রুততার সঙ্গে সিডিসি সক্রিয় করেছিল সেন্ট্রাল এপিডেমিক কমান্ড সেন্টার (সিইসিসি)। সরকারি সাহায্যে ব্যাপক ভাবে চালু করেছিল মাস্কের উৎপাদন, সামরিক কর্মীদের একত্রিত করে তাদের কাজে লাগাতে শুরু করেছিল।
ফেব্রুয়ারির প্রথমেই সারা দেশব্যাপী মাস্কের রেশনিং শুরু করা হয়, যাতে কেউ তা মজুত না করতে পারে। জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা কার্ড, বা এলিয়েন রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট (বহিরাগত কর্মীদের যা দেওয়া হয়) দেখিয়ে সকলেই বিভিন্ন ফার্মাসিগুলি থেকে এই মাস্ক কিনে ব্যবহার শুরু করেন। প্রতিটি ফার্মাসিকে জিপিএসের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয় এবং যে কেউ একটি মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে, কোথায় কত মাস্ক পাওয়া যাবে, জানতে পারছিলেন।
এই সবই এমন সময়ে, যখন হু কোভিডকে অতিমারি হিসাবে ঘোষণাই করেনি। তাইওয়ান এটা করেছিল অত্যন্ত সচেতন ভাবে, নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করে। অদ্ভুত যে, এই কিছু দিন আগে অবধি হু মাস্ক পরাকে, বিশেষ করে জনবহুল জায়গায়, অত্যাবশ্যক বলে ঘোষণা করেনি।
ফেব্রুয়ারি থেকেই তাইওয়ানের প্রতিটি জায়গায় শুরু হয়ে যায় থার্মাল স্ক্যানিং। ভারত সমস্ত আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করে ২২ মার্চ থেকে, তাইওয়ান করে ২৪ মার্চ থেকে। কিন্তু বিদেশ থেকে আগত প্রতিটি যাত্রীকে বাধ্যতামূলক স্ব-পৃথকীকরণ (সেলফ কোয়রান্টিন) করা হয়। এবং তা করা হয় এক অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে।
সিইসিসি এবং সিডিসি ইমিগ্রেশন এবং শুল্ক বিভাগের ডেটাবেসকে জাতীয় স্বাস্থ্য ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলে। বিমানবন্দরে অবতরণের পরেই যাত্রীর মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি সিম কার্ড। অ্যাপের মাধ্যমে সিইসিসি শুরু করে সক্রিয় যোগাযোগের সন্ধান, পৃথকীকরণ এবং পরীক্ষার। সরকার জারি করে জরিমানা— কোয়রান্টিন ভেঙে বাইরে বেরলেই এক মিলিয়ন তাইওয়ানিজ় ডলার।
তাইওয়ানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবেগপ্রবণ মানুষ। ফেব্রুয়ারি মাসে সাংবাদিক সম্মেলনে ১১তম কোভিড রোগীর কথা জানাতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। আজ অবধি প্রতি দিন তিনি নিজে সাংবাদিকদের সামনে কোভিডের সমস্ত তথ্য নিয়ম করে দিয়ে যাচ্ছেন: প্রতিটি রোগীর তথ্য, তার উৎস, সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ তাইওয়ান বিশ্বাস করে, তথ্যের স্বচ্ছতাই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র উপায়।
ভারতের তুলনায় তাইওয়ান অনেক ছোট এবং সমৃদ্ধ দেশ। হয়তো ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে এত কিছু সঠিক সময়ে করা সম্ভব না-ও হতে পারে। কিন্তু তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নিরন্তর আর তাতেই গড়ে ওঠে সরকারের ওপর নাগরিকের বিশ্বাস।
লকডাউনের কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত তাইওয়ানে নেই। এই লেখা শেষ করা অবধি তাইওয়ানে সংক্রমণের সংখ্যা দিনপ্রতি ১৫ থেকে নেমে এসেছে ২-৩’এ। এখনও স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি খোলা। প্রতি দিনের জিনিসপত্র কেনার কোনও আতঙ্ক নেই, স্টোর এবং সুপারমার্কেটগুলোতে দৈনন্দিন জিনিসপত্র ভাল ভাবেই মজুত রয়েছে।
তবে কোভিডকে আটকাতে এ বার হয়তো কম চলবে মেট্রো। বাইরে মাস্ক পরে না বেরলেই ১৫ হাজার ডলার জরিমানা।
কিন্তু সবই হচ্ছে খুব নীরবে, কোথাও উচ্চগ্রামের শব্দ নেই, নেই হাজার অনুযোগ।
অনিন্দ্য সরকার
অ্যাকাডেমিয়া সিনিকা, তাইপে
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।