লকডাউনের জেরে শান্ত জনমানবহীন কারনাল শহর।
আজ ১৮ দিন নিজের কোয়ার্টারে বসে বসে মোবাইলে আঙুল চালাতে চালাতে মনটা হঠাৎ করে ছ’মাস আগে চলে গেল। হ্যাঁ, আমি এখন দেশেই, হরিয়ানার কারনাল শহরে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান সংস্থায় বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। গত ২৫ নভেম্বর আমেরিকা থেকে দেশে ফিরেছি। আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে ২৬ মার্চ ২০১৯-এ আমরা মিশিগান স্টেটস-এর ‘অ্যান আর্বর’ শহরে যাই— ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে আমার স্বামীর ফুলব্রাইট ফেলোশিপের গবেষণার জন্য। আমার জীবনে অ্যান আর্বর একটা স্বপ্নের শহর। আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে মাত্র দেড় মাইল দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম। আমার কাছে সত্যি এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। এক দিকে আমার ছেলের মার্কিন স্কুলে (ব্রায়ান্ট এলিমেন্টারি স্কুল) পড়াশোনা আর স্বামীর ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের কর্মব্যস্ত জীবন। ঋতুর মেলা নিয়ে অ্যান আর্বর যেন সব সময় মেতে থাকত। বসন্তের ফুলের বাহার, গ্রীষ্ম যেন খুশির মেলা। শরৎ নিয়ে এল নানা রঙের ডালি আর নভেম্বর থেকেই তুষার রানি। আজও আমি চোখ বন্ধ করলে দু’চোখ ভরে দেখতে পাই। রোজ ট্রেডস জো থেকে খাবার কেনা আর লোকাল পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে পাবলিক লাইব্রেরিতে কফি খাওয়া।
কিন্তু আজ যখন কোয়ার্টারে বসে ওখানকার বন্ধুদের আতঙ্কিত গলা শুনি, তখন মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। যখন শুনি, অ্যাপার্টমেন্টের আমাদের ইউনিট এর একজন পজিটিভ এবং অ্যাম্বুল্যান্স এসে তাঁকে নিয়ে গেছে। সদাচঞ্চল অ্যান অর্বর-এ এখন শুধুই নিস্তব্ধতা। ভাবলেই মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে যায়। এখন আমি অবসর সময়ে আমাদের মাত্র ৬-৭ মাস আগে তোলা স্ট্যাচু অব লিবার্টি আর টাইম স্কোয়ারের ছবিগুলো দেখি। তখনকার আর এখনকার ছবির সঙ্গে একদম মেলাতে পারি না। ভাবতে পারি না, ডিজনি ওয়ার্ল্ডের ম্যাজিক দুনিয়া আর কেপ ক্যানাভেরলে নাসার ভিজিটর প্যাভিলিয়ন আজ জনশূন্য।
আমার মা-বাবা পূর্ব বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম দেবশালায় থাকেন। আজ বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বাবা খুব ভারাক্রান্ত গলায় বলল, ‘সম্ভবত এই প্রথম গ্রামের গাজন উৎসব হল না’।
আরও পড়ুন: ভিনরাজ্যের শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা করুন, রাজ্যগুলিকে নির্দেশিকা কেন্দ্রের
গত এক মাসে আমি ক্যাম্পাসের বাইরে যাইনি। আমার এই প্রিয় ক্যাম্পাসের এই রূপ কখনও দেখিনি। এই তো এক মাস আগেও আমাদের ‘মিল্ক পার্লার’-এ খুব ভিড় হত লস্যি, ফ্লেভার্ড মিল্ক আর বরফির জন্য। অসম্ভব সুন্দর আমার ক্যাম্পাসে কারনালের লোকজন সকাল-সন্ধ্যা একটু নির্মল হাওয়ার জন্য এত ভিড় করত যে, গাড়ি চালাতে খুবই অসুবিধা হত। ছাত্রদের খেলাধুলো আর কলকাকলিতে ক্যাম্পাস সব সময় গমগম করত।
লকডাউনের আগে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন: ৩ মে-র পরেও ট্রেন ও বিমান চলার সম্ভাবনা কম: রিপোর্ট
এখন সারাদিন চার দিকে শুধুই নিস্তব্ধতা আর মাঝে মাঝে শুধুই সব্জি, ফল ও দুধওয়ালার ডাক। পশুশালা আর কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় ল্যাবরেটরি ছাড়া সব কিছুই বন্ধ। ঘরে বসে গবেষণার কিছু লেখালেখি আর অনলাইনে ক্লাসের সময় ছাড়া মনটা আজ ভীষণ চঞ্চল। আজ এক হঠাৎ দরকারে ল্যাবে যাওয়ার পথে শুকনো পাতা মাড়াতে মাড়াতে বসন্তের কচি পাতা আর ফুল দেখে মনে আবার আশার সঞ্চার হল। আমার পৃথিবী আবার করোনামুক্ত হবে। মানব সভ্যতা জয়লাভ করবে। শিশুরা আবার বাইরে খেলবে। আমার সাত বছরের ছেলে আর বলবে না, ‘মা এ বার করোনার কথা ছাড়’।
হরিয়ানার কারনালে রাষ্ট্রীয় ডেয়ারি অনুসন্ধান সংস্থার বিজ্ঞানী
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)