coronavirus

ইটালি, ফ্রান্স থেকে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য তুলে আনছে জার্মানি

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা মনোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।প্রতিবেশী দেশ ইতালি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড থেকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক রোগীদের দ্রুত জার্মানির হাসপাতালগুলোতে স্থানান্তরিতও করা হচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ১৭:৫৯
Share:

জার্মানির আখেন শহর।

করোনা সংক্রমণে জার্মানির যে স্টেট সবচেয়ে বেশি জেরবার, তার নাম- ‘নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়া’। সংক্ষেপে, ‘এনআরভি’। এখনও পর্যন্ত শুধু এই স্টেটেই আক্রান্তের সংখ্যাটা ১৫ হাজার ৪২৭। রূঢ় শিল্পাঞ্চল এনআরভি স্টেটটি রাইন নদীর উপত্যকায়। জার্মানির সবচেয়ে বড় ৯টি শহরের মধ্যে ৪টিই রয়েছে জনবহুল এই স্টেটে। যেখানে আমি এখন থাকি কর্মসূত্রে, সপরিবারে। এই স্টেটটি জার্মানির একেবারে পশ্চিমে। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের সীমান্ত সংলগ্ন শহর আখেনে আমার বাড়ি। পাশেই রয়েছে জার্মানির হাইন্সবার্গ শহর, যা এখন জার্মানির ‘উহান’ অর্থাৎ, করোনা সংক্রমণের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

Advertisement

আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনেই আখেন থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে হেলমহোলৎজ ফাউন্ডেশনের সর্ববৃহৎ রিসার্চ-ল্যাব ‘জুলিখ রিসার্চ সেন্টার’-এ পোস্টডক্টরাল রিসার্চার। এলাকাটি হাইন্সবার্গ শহরের আরও কাছে। তাই খুব কাছ থেকে দেখেছি কী ভাবে কোভিড-১৯ সুনামির মতো আছড়ে পড়ল জার্মানিতে।

জানুয়ারির শেষাশেষি মিউনিখ শহরে প্রথম ধরা পড়ল করোনাভাইরাস পজ়িটিভ রোগী। তার পর জার্মানির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এক জন/দু’জন করে করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলতে শুর করল। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বেশ কিছু প্রান্তিক খবর আসতে শুরু করল। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যা ব্যাপক আকার নিল এনআরভি-সহ গোটা জার্মানিতে।

Advertisement

যার শুরুটা হয়েছিল একটি উৎসবকে কেন্দ্র করে। জার্মানি তথা ‘রাইনল্যান্ড’-এর সবচেয়ে বড় উৎসব ‘কোলন কার্নিভাল’। যা কি না জার্মানির ‘পঞ্চম ঋতু’ হিসাবে বিবেচিত হয়। কথায় আছে, রোমানরা কার্নিভালকে রাইনল্যান্ডে এনেছিল। স্যাটার্নালিয়া উত্সব চলাকালীন। এটি এখন এনআরভির সমস্ত ছোট-বড় শহরেই পালিত হয়। সপ্তাহব্যাপী কার্নিভালের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হয় বর্ণাঢ্য এক শোভাযাত্রা দিয়ে। আমরাও ছিলাম এ বার ‘আখেন কার্নিভাল’-এর শোভাযাত্রায়। অন্যান্য বারের মতো এ বারেও অসংখ্য দেশি-বিদেশি দর্শক জমায়েত হয়েছিলেন এই কার্নিভালকে কেন্দ্র করে। থিম-কেন্দ্রিক ওই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার পাশাপাশি জার্মানরা সে দিন বিভিন্ন রং-বেরঙের কস্টিউম পরে একে অন্যকে কোলাকুলি, নাচনাচি করছিল। আর আমাদের মতো দর্শকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন স্থানীয় কাল মিষ্টি ও বিয়ার বিনিময়ের মাধ্যমে।

জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামে করোনার এমন দ্রুত হারে ছড়িয়ে পড়ার সূত্রপাত হাইন্সবার্গ শহরের কার্নিভালকে কেন্দ্র করেই। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে অফিস থেকে ই-মেল পেলাম, আমাকে ‘হোম কোয়রান্টিনে’ যেতে হবে। কারণ, আমার এক সহকর্মী ওই কার্নিভালে অংশ নিয়েছিলেন। যাঁর থেকে বেশ কয়েক জনের করোনা পজ়িটিভ পাওয়া গিয়েছে। এরই মধ্যে কিন্তু সেই সহকর্মীর সঙ্গে আমার দু’দিন মিটিং হয়ে গিয়েছে। দু’দিন বাড়িতে থাকার পর সেই সহকর্মীর রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ শুনে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম!

জীবন এখন যে রকম। জার্মানির এনআরভি স্টেট।

হাইন্সবার্গে এখন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৪০০। সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ৩৭ জনের। আমার শহর আখেনে সংক্রমণের সংখ্যা ১১০০ ছুঁইছুঁই। সংখ্যার নিরিখে জার্মানি চিনকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে মৃত্যুর হার অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের তুলনায় অনেক কম থাকলেও, এখন সেই সংখ্যাটা ১২০০। দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

সংক্রমণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় দেরিতে হলেও, গত ২২শে মার্চ জার্মান সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের মতো কঠোর কার্ফু জারি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার পথে হাঁটেনি অবশ্য। বিশ্বাস রেখেছে জনগণের সচেতনতা ও সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রার উপর। কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলেও আমাদের মতো বিজ্ঞানের গবেষণাগার আর বেসরকারি কোম্পানিগুলো কিন্তু এখনও খোলা রয়েছে। গণপরিবহণও স্বাভাবিকই। সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান, ব্যাঙ্ক এবং পোস্ট অফিস ছাড়া বাকি সবই (রেস্তোঁরা, মল, পাব, সেলুন ইত্যাদি) বন্ধ। শহর এক রকম নিশ্চল, নিস্তব্ধ। কফিশপে ভিড় নেই, যাত্রীহীন বাস। শহরের ঐতিহাসিক টুরিস্ট স্পটগুলো ফাঁকা। আবার অন্য দিকে, পার্কে ভিড় কম থাকলেও শরীরসচেতন জার্মানরা হাঁটতে, দৌড়োতে বেরচ্ছেন নিয়মিত। সরকারের তরফে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করা হয়েছে, ‘এক সঙ্গে দু’জনের বেশি বাইরে বেরনো যাবে না।’ নির্দেশ লঙ্ঘন করলে মোটা অঙ্কের জরিমানারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

গত তিন সপ্তাহ ধরে আমরা ‘হোম অফিস’-এ আছি। নিত্যসামগ্রীর প্রয়োজনে সুপারমার্কেট যেতে হয় অবশ্য। সেখানে টিস্যু পেপার আর পাস্তা ছাড়া প্রয়োজনীয় সব কিছর জোগান রয়েছে। শৃঙ্খলা মেনে ক্রেতারা সেখানে এক মিটার দূরত্ব বজায় রেখে লাইন দিয়ে বাজার করেন। তরুণদের দল অবশ্য করোনা-ভয়কে উপেক্ষা করেই নেমে পড়েছে প্রবীণ ও হোম কোয়রান্টিনে থাকা মানুষদের কাছে দৈনন্দিন সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজে।

যাত্রী নেই, রয়েছে যানবাহন। জার্মানির এনআরভি স্টেট।

করোনা মোকাবিলায় প্রশাসনের চেষ্টায় কোনও খামতি নেই। রোজ যতটা সম্ভব টেস্ট করে সংক্রমিতদের আইসোলেট করা হচ্ছে। ইমিউনিটি সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। বেসিক ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মাস্ক উৎপাদন দ্রুত বাড়ানোর পদক্ষেপ করা হচ্ছে। অটোমোবিল কোম্পানিগুলোকে ভেন্টিলেটর বানাতে উৎসাহিত করছে। এরই মধ্যে সরকার থেকে বহু আর্থিক অনুদানও ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানি ৬০০ বিলিয়ন ইউরো ভর্তুকি দেবে দেশের সবক’টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানিকে। ক্ষুদ্র ব্যবসার দ্রুত সহায়তার জন্য মোট ৫০ বিলিয়ন ইউরো দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে আলাদা ভাবে।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরোর সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদন করেছে জার্মানির সরকার। বিশাল অঙ্কের স্বাস্থ্য প্যাকেজও ঘোষণা করা হয়েছে হাসপাতালগুলির জন্য। শুধু তাই নয়, এই অবস্থায় প্রতিবেশী দেশ ইতালি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ড থেকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক রোগীদের দ্রুত জার্মানির হাসপাতালগুলোতে স্থানান্তরিতও করা হচ্ছে।

১৩০ কোটি জনসংখ্যার আমার দেশ ভারতের কথা ভাবছি। সেখানে ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষ কী ভাবে লড়বেন এই ব্যাধির বিরুদ্ধে? যে রোগের একমাত্র ওষুধ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সরকার বার বার সচেতন করা সত্ত্বেও দেখছি ভারতে হাজারো মানুষের সমাবেশ ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে! এ যেন আগুন নিয়ে খেলা, যা সব কিছু শেষ করে দিতে পারে! তাই ভারতের নাগরিকদের আরও সতর্ক ও প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য।

শান্তনু মাইতি, ডি-৫২৪২৫, জুয়েলিখ, জার্মানি

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement