Crisis of Bengali Language

সম্পাদক সমীপেষু: ভাষাকে বাঁচাতে

সরকারি কাজ-সহ সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আয়োজন করতে হবে। শুধু সাহিত্য রচনা নয়, বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার জন্যও বাংলার ব্যবহার করতে হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫৬
Share:

অনুরাধা রায় ‘বদনখানি মলিন হলে’ (২১-২) প্রবন্ধে ঠিকই বলেছেন, আজ বাংলা ভাষার দুর্দিন। মাতৃভাষা বাংলা এখন অযত্নে, অনাদরে মলিন, বিবর্ণ। কাজের ভাষা (প্রাবন্ধিকের মতে ক্ষমতার ভাষা, আমি সহমত নই) ইংরেজি ও হিন্দির পাশে সে ব্রাত্য। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মায়ের বদন মলিন দেখেও নয়নজলে আজ আমাদের বুক ভাসে না। অথচ, জার্মান মনীষী হামবোল্টের মতে, মানুষের ভাষাই হল তার আত্মা, আর তার আত্মাই হল তার ভাষা। আজ আমরা ভুলতে বসেছি ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের প্রতীক। ভুলেছি ভাষা শুধু ভাবের বাহন নয়, জাতির সাহিত্য, সভ্যতা, সংস্কৃতিরও প্রাণ। ব্যক্তির ব্যক্তি হয়ে ওঠারও মাধ্যম। ভাষার সাহায্যেই ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিজীবনের বিকাশ ঘটে। তাই মাতৃভাষার সম্মান ও অস্তিত্ব নিয়ে আপস চলে না। এ জন্যই মাতৃভাষার সম্মানরক্ষার্থে ঝরেছিল প্রাণ। বাংলা ভাষার সমস্যাকে শুধু জীবিকার সমস্যা হিসাবে দেখলে ছোট করে ভাবা হবে। মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে বাঙালির শিল্পসংস্কৃতিকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধতর পথে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন।

Advertisement

সরকারি কাজ-সহ সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আয়োজন করতে হবে। শুধু সাহিত্য রচনা নয়, বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার জন্যও বাংলার ব্যবহার করতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে আজ শিক্ষিত বাঙালিও বাংলা ভাষাকে জ্ঞানচর্চার প্রয়োগে অনীহা প্রকাশ করেন। মাতৃভাষায় ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। ইংরেজি মেশানো বাংলা বলে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে ইংরেজি, হিন্দি বা অন্য ভাষা শেখার দরকার ঠিকই, নিজেকেও তাতে সমৃদ্ধ করা যায়। তা বলে মাতৃভাষা বাংলাকে অবহেলা ও অমর্যাদা করে কেন! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, দীনবন্ধু, নবীনচন্দ্রের মতো ইংরেজি শিক্ষিত সমাজসংস্কারক, কবি-সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষার জন্য ভেবেছিলেন, লিখেছিলেন। শুধু সাহিত্য সৃষ্টি নয়, বাংলা ভাষাকে ভাবের পাশাপাশি জ্ঞানের ভাষাও করে তুলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন নানা বিষয়ের জ্ঞান প্রকাশের এক উপযুক্ত পত্রিকা ছিল। বাংলা ভাষার মর্যাদাবৃদ্ধি ও প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির জন্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেনের অবদান অবশ্য স্বীকার্য। মনে রাখতে হবে নানা পদাবলি, পল্লিগাথা ও গীতি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক ঐতিহাসিক দলিল। বংশকৌলীন্যেও বাংলা পৃথিবীর এক মহান ভাষা পরিবারের (ইন্দো-ইউরোপীয়) উত্তরাধিকারী। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রসাহিত্য আজও সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেরই সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। তাই বাংলা ভাষার সম্মানরক্ষার্থে আজ সর্বস্তরে এর প্রয়োগে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ তরুণ প্রজন্মের পার্থিব উচ্চাশার পাশে মাতৃভাষাপ্রীতি ফিকে হয়েই থাকবে।

সুদেব মাল, তিসা, হুগলি

Advertisement

সরকারেরও দায়

অনুরাধা রায়ের ‘বদনখানি মলিন হলে’ প্রবন্ধে অমর একুশ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে মাতৃভাষা বাংলার অবমাননার কথা। এই সূত্রে কিছু কথা। ভারত জুড়ে হিন্দির আস্ফালন আর ক্ষমতার ভাষা ইংরেজি হলেও মাতৃভাষা বাংলা আজ কতটা অপাঙ্‌ক্তেয় সে প্রশ্ন চার দিক থেকে ধেয়ে আসছে। আসলে মাতৃভাষা বাংলার এই অমর্যাদার মূলে আছে অখণ্ড বাঙালি সত্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাঙালি জাতির ধর্মীয় কোন্দল।

প্রশ্ন উঠেছে, আজ বাংলা ভাষার এই অধঃপতনের জন্য কারা দায়ী? আজ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ-এর বিরুদ্ধে বাঙালিরা ঠিক কতটা সরব? উত্তর ভারতে প্রবাসী বাঙালিরাই উর্দুভাষী মুসলিমদের নাকাল করতে হিন্দি ভাষা আন্দোলনের পথকে সুগম করেছিল। আবার দক্ষিণ ভারত আজও হিন্দি ভাষাকে অপছন্দ করে। তারা মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি উচাটন, আগ্রাসী। কেন্দ্রীয় সরকার জানে সেখানে আঘাত করা যাবে না। সেই এলাকার ছেলেমেয়েরা হিন্দি, ইংরেজি জানলেও সে ভাষাগুলিতে সংলাপ বিনিময় করে না। আর আমার বঙ্গে সম্ভ্রান্ত ছেলেমেয়েরা মাতৃভাষা বাংলায় কথোপকথনে লজ্জা বোধ করে। এখানে ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে আঞ্চলিক ভাষা শেখার কথা। বঙ্গে এ কথা জানা থাকলেও বিষয়টি নিয়ে সে ভাবে বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে ইংরেজির পর বাংলা অথবা হিন্দি শেখার সুযোগ থাকলেও সকলেই দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি রাখতে তৎপর। আজ মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরও ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যমে। এর প্রধান কারণ জীবন-জীবিকা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া, ইংরেজি জানা ছেলেমেয়েদের সামনে ভাব বিনিময়ের সময় বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা বিষণ্ণতায় ভোগে। কিন্তু বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়ারা আজও বেশ ভালই ইংরেজি লিখতে পারে।

আজ মাতৃভাষাকে বাঁচাতে হলে সবার আগে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য এক সময় প্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনেক চেষ্টা করেন। চেষ্টা করেন কবি-সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেকেই। তবে বাংলা ভাষাকে আজ স্বর্ণাসনে বসাতে অনুবাদ সাহিত্যের বিস্তারের পাশাপাশি বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায়ও মন দিতে হবে। এতে বিশ্ব দরবারে আরও এক বার বাংলার জয় প্রচারিত হবে। নিজ বাঙালি সত্তা নিয়ে গৌরব প্রদর্শন করলে ভাষার মর্যাদাও পুনরুদ্ধার করা যাবে।

তবে সকলকে অন্য ভাষার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল, সহনশীল হতে হবে। তাচ্ছিল্য নয়, অন্য ভাষা-ভাষীরাও আমার সহযাত্রী— এই বোধকে সঙ্গী করে অন্য ভাষাও শিখতে হবে। কিন্তু, কবির আক্ষেপ মতো মা-বাবা যদি বলে চলেন, “স্কুলে কেন বেঙ্গলিটা পড়ায় না ইংলিশে?”— তা হলে যন্ত্রণা বেড়েই চলবে নিশ্চিত।

সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪

সমন্বয়ের ভাষা

দুই উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ অনুরাধা রায়ের ‘বদনখানি মলিন হলে’ ও মানস ভট্টাচার্যের ‘সাহিত্যের যুক্তিনির্ভর ইতিহাস’ (২১-২) পড়লাম। ধর্মের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক যা বাঙালি স্পর্শকাতর মনে করে এড়িয়ে চলে, তা স্পষ্ট ভাবে উচ্চারিত হতে দেখলাম।

ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ভারত ও বাংলা ভাগ করল। বাংলা ভাষাও জ্ঞানত, অজ্ঞানত ভাগ হল। অন্তত তিনটি অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করেছি। এক, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা সংস্কৃত-হিন্দুত্ব প্রধান। দুই, পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাংলাদেশের বাংলা উর্দু-ইসলামি প্রধান। তিন, বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। আপাতত তা দূর অস্ত্।

এখন ভরসা বাকি জীবনচর্যা যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ক্রীড়া, বিনোদন, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সব বাঙালি অনেকটাই অভিন্ন। বলা যায় অনেকটাই ধর্মনিরপেক্ষ। বিশ্বের অন্যত্র এই সব বাঙালি একটি সম্প্রদায় হিসাবে সমবেত ভাবে অনেকটাই এক ধারার জীবনচর্যায় অভ্যস্ত। বিভেদ মেটাতে হিন্দু ও মুসলিম বাঙালিরা পূর্ব ও পশ্চিমের সমন্বয়বাদী সাহিত্যে ব্যবহৃত ভাষার সাহায্য নিতে পারেন। তবে সতর্ক হতে হবে— ভারতের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান মৌলবাদ যেন বাংলা ভাষার ধর্মনিরপেক্ষতার লক্ষ্যকে আঘাত না করে, পৃথিবীজোড়া ইসলাম-রাজত্বের আকাঙ্ক্ষাও যেন বাংলা ভাষার ভৌগোলিক চরিত্রকে আঘাত না করে। এ কাজ অসাধ্য নয়। আমাদের সামনে বড় উদাহরণ ডিজিটাল জগতের ভাষা। কম্পিউটারের ভাষার প্রায় আশি বছর বয়স। ধর্ম চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি তাকে।

ভাষার বিবর্তনের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাঙালির শুধুমাত্র হিন্দু ও মুসলিম, সংস্কৃত-উর্দু নিয়ে পুতুলের যুদ্ধ নেহাত ছেলেখেলা। আর ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা শিখতে গেলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে। কৃত্রিম মেধার ভাষা শেখার জন্যও বাংলা ভাষা নতুন ভাবে তৈরি হোক।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement