জয়া মিত্রের ‘পরিবেশ, তোমার উন্নয়ন নাই?’ (২১-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটি উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের মহাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব অনুসারে, উন্নয়নের সেই অসাধারণ পথে একটা বড় বাধা কাটানো গেল, জঙ্গল কেটে ফেলতে হলে আর জঙ্গলবাসী মানুষের থেকে অনুমতি নিতে হবে না। রাস্তা, শহর বা শিল্প স্থাপনের জন্য জঙ্গল কাটতে হলে এখন থেকে সেখানে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অনুমতি নেওয়ার কোনও দরকার হবে না। তার জন্য স্রেফ ‘মূল্য ধরে দিলেই’ ল্যাঠা চুকে যাবে। অর্থাৎ, বড়সড় উন্নয়নের কাজ করার আগে ‘পরিবেশের উপর তার ফলাফল বিচার’ নামক হ্যাপা আর পোহাতে হবে না। অতএব পাহাড়, জঙ্গল, নদী অথবা মাটির সম্পদ লুটপাট করে এবং বাস্তুতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে মুনাফা বৃদ্ধির জন্য যে খেলা আগে থেকেই শুরু হয়েছিল, এ বার তার চূড়ান্ত পর্ব শুরু হল। জ্ঞানপাপী শাসকবর্গ সমুদ্রতটে, সক্রিয় ব-দ্বীপে, গভীর অরণ্যে, পাহাড়-পর্বতে, অথবা জলাভূমিতে বহুতল নির্মাণ করবেই। না হলে পৃথিবী ‘বাসযোগ্য’ হবে কী ভাবে? আর এই কাজে চাই প্রাকৃতিক কাঁচামাল এবং তা যেন তেন প্রকারেণ আহরণ করলেই মুনাফা মিলবে। আদিবাসীদের ‘মূল্য ধরে’ দেওয়ার পরেও দু’চার জন পরিবেশবিদ যদি বিরোধিতা করেন, তবে তাঁদের আইনের প্যাঁচে ফেলার ব্যবস্থা তো রয়েইছে। অতএব, বিশ্ব উষ্ণায়ন, বৃষ্টিপাতের শৃঙ্খলা কিংবা ভূমিক্ষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
উন্নয়নের কাজ করতে হলে জঙ্গল তো একটু কাটতেই হবে। আর এই ‘একটু একটু’ ধ্বংস ধীরে ধীরে দৈত্যের আকার নেওয়ার ফলে সবুজ জঙ্গলের পরিসর এখনই বিপজ্জনক রকম ভাবে কমে গিয়েছে। আমরা সবুজের গোরস্থানে তৈরি ‘সি ভিউ’ বা ‘মাউন্ট ভিউ’ বহুতলে বসে আছি। কয়েক বছর আগে ঘটে-যাওয়া কেদারনাথে ধসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিহরন-জাগানো ভিডিয়ো ভাইরাল করার সুযোগের অপেক্ষারত পর্যটক আমরা!
তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
অব্যাহত ধ্বংস
‘পরিবেশ, তোমার উন্নয়ন নাই?’ প্রবন্ধটি পড়ে কতকগুলি বিষয় উল্লেখ করার তাগিদ অনুভব করলাম। অরণ্যের অধিকার নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার প্রয়াস সফল হয়নি। জয়া মিত্র যথার্থ বলেছেন, বৃক্ষরাজি উন্নয়নের পথে বাধা, সে হেতু তাদের ধ্বংস অবধারিত! অরণ্যবাসীদের অরণ্যের অধিকার আইনে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও, আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে অরণ্য নিধন অব্যাহত। এখন আবার রিসর্ট ব্যবসার কল্যাণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করানোর নামে যথেচ্ছ ভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করা হচ্ছে। অনেক বনাঞ্চলে পরিযায়ী পাখির কলতান আর শোনা যায় না। আমাদের রাজ্যে সুন্দরবন সঙ্কুচিত হচ্ছে। বড় সুন্দর শেষ করেছেন লেখক— শিল্পের স্বার্থে সবুজ শেষ হয়ে যাক, ভবিষ্যতের প্রকৃতির প্রতিশোধ তো আমরা দেখতে আসছি না! বিদ্রুপাত্মক হলেও কঠোর বাস্তব। আয়লা, আমপান থেকেও আমরা শিক্ষা নিলাম না। নদী বাঁধ তৈরি করার অপপ্রয়াস থেকেও আমরা বিরত থাকব না, আর বন্যাপ্রবণ এলাকা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে দেব! এই তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধটি দেশের হর্তাকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হবে কি?
সুবীর ভদ্র , ডানকুনি, হুগলি
রন্ধনকর্মীর দাবি
‘দ্রুত ভাতা বৃদ্ধির দাবি স্কুলের রন্ধনকর্মীদের’ (১৯-৭) সংবাদের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, সিটুর নেতৃত্বের ৩০ বছর পর বোধোদয় হল। সিটু অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন’-এর সাধারণ সম্পাদিকা মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় রন্ধনকর্মীদের দুরবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বর্তমানে রন্ধনকর্মীরা মাসে সাম্মানিক ভাতা হিসাবে মাত্র ১৫০০ টাকা পান। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা যেখানে রন্ধনকর্মীর কাজ করেন, সেখানে এই ১৫০০ টাকা ভাগ হয়ে গিয়ে মাসে এক-এক জন রন্ধনকর্মী পাচ্ছেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তাঁর এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েও কয়েকটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। রন্ধনকর্মীদের কেন এই দুরবস্থা? জানতে হলে একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক।
‘মিড-ডে মিল’ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় পুষ্টি সহায়তা প্রকল্প’-এর অধীনে ১৯৯৫ সালে চালু হয়। সেই সময় রান্না করা খাবার দেওয়ার পরিবর্তে বেশির ভাগ রাজ্যে শিশুদের মাথাপিছু মাসে তিন কেজি চাল ও তিন কেজি গম দেওয়া হত। ২০০১ সালে একটি অসরকারি সংস্থার দায়ের করা মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট রান্না করা খাবার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পশ্চিমবঙ্গে মিড-ডে মিল চালু হয় ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে।
বামফ্রন্ট সরকার আর্থিক ভাবে ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে গ্রাম ও শহরে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলে। কিছু দিন চলার পর দেখা গেল এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, এমনকি এই গোষ্ঠীগুলোর তৈরি পণ্যের বিপণনের ব্যবস্থাও করা হল না। ইতিমধ্যে সারা দেশে মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর হাজার হাজার মহিলাকে মিড-ডে মিল প্রকল্পে ঢুকিয়ে দিল। ফল দাঁড়াল, প্রয়োজনের বেশি মহিলা স্কুলে রান্নার কাজে যুক্ত হলেন। এবং মাসের সাম্মানিক টাকা বহুর মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এই মহিলাকর্মীদের কাজে নিয়োগের জন্য কোনও নিয়োগপত্রও দেওয়া হল না। গ্রুপের নামেই কাজ চলতে থাকল। অন্য কোনও রাজ্যে এই নিয়ম চালু নেই। এই অনিয়মের জন্য সিটু পরিচালিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন’ নেতৃত্বের জবাবদিহি করা উচিত। বামফ্রন্ট সরকারের সেই সময়কার ভুল সিদ্ধান্তে হাজার হাজার রন্ধনকর্মীর জীবিকা অনিশ্চিত। ফলে, রন্ধনকর্মীদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমান রাজ্য সরকার এই নিয়ম পরিবর্তনের কোনও সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না।
রাজ্য রাজনীতি পরিবর্তনের পর থেকে রাজ্যে বেশ কয়েকটি মিড-ডে মিল কর্মী ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। এগুলি সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি-সহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত দাবিপত্র পেশ করেছে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, মিড-ডে মিলের কাজকে ১০০ দিনের কাজের সঙ্গে যুক্ত করবেন। কর্মীরা আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু ঘোষণাই সার। বাজেটে মিড-ডে মিলের জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ হল না। গত ৭-৮ জুন কয়েক হাজার রন্ধনকর্মী ধর্মতলায় বিক্ষোভ দেখালেন। তাঁদের দাবি— ১) শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, ২) ন্যূনতম মজুরি, ৩) ন্যূনতম পেনশন ৬০০০ টাকা, ৪) ১২ মাসের বেতন, ৫) বোনাস, ৬) চিকিৎসা বিমা, ৭) ১৮০ দিনের মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রভৃতি।
এই প্রকল্পে আর্থিক দায়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুপাত ছিল ৭৫:২৫। বর্তমানে তা ৬০:৪০ হয়েছে। এই ভাবে মোদী সরকার ক্রমশ মিড-ডে মিল থেকে কেন্দ্রকে গুটিয়ে নিচ্ছে। এখন তো মিড-ডে মিলের নামই পাল্টে দিয়ে ‘পি এম পোষণ’ নামকরণ হয়েছে।
প্রায় দুই দশক রাজ্যের ২ লক্ষ গরিব ঘরের মহিলা, যাঁরা বেশির ভাগ তফসিলি জাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ, নামমাত্র সাম্মানিকে কাজ করে চলেছেন। বেশ কয়েকটি রাজ্য নিজেদের রাজ্যের গণ শিক্ষা প্রসারের দায় থেকে রাজ্যের তহবিল থেকে অতিরিক্ত সাম্মানিক দিচ্ছেন। যেমন— কেরল ৭৬০০ টাকা, পুদুচেরি ৬৪৫৮ টাকা, অন্ধ্রপ্রদেশ ৩০০০ টাকা, মহারাষ্ট্র ৩০০০ টাকা, ওড়িশা ৩০০০ টাকা, ঝাড়খণ্ড ২০০০ টাকা, বিহার ১৬৫০ টাকা এবং পশ্চিমবঙ্গ ১৫০০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গের সাম্মানিক ভাতার হার সবচেয়ে কম। রন্ধনকর্মীরা অতি সামান্য ভাতায় হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছেন। এই সামান্য টাকাও প্রতি মাসে ঠিক সময় কর্মীরা হাতে পান না। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলারা কঠিন পরিস্থিতিতে মিড-ডে মিল প্রকল্পে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
নবেন্দু দাশগুপ্ত, সম্পাদক, এআইসিসিটিইউ