উত্তরপ্রদেশের আমরোহার এক বেসরকারি স্কুল থেকে পাঁচ বছরের একটি শিশুকে টিফিনে নিয়মিত বিরিয়ানি-সহ আমিষ খাবার আনার অপরাধে বরখাস্ত করা হয়েছিল। অভিযোগ, ওই শিশুটি নাকি ভিন ধর্মের সহপাঠীদের ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিত। পাঁচ বছরের একটি শিশুর বিরুদ্ধে এই অভিযোগের সত্যতা কতখানি, সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে! এই ঘটনার সূত্রে ‘আমিষে অন্যায়?’ (১৩-৯) শীর্ষক সম্পাদকীয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কিছু দিন আগেই আমরা দেখেছি, সাবির মল্লিক নামে পশ্চিমবঙ্গের এক পরিযায়ী শ্রমিককে হরিয়ানায় গোমাংস রাখার সন্দেহে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল। এর আগে এই হরিয়ানাতেই ফরিদাবাদের কাছে ১৯ বছরের আরিয়ান মিশ্রকে স্রেফ মুসলমান সন্দেহে ৪০ কিলোমিটার গাড়িতে ধাওয়া করে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, এই নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পর বৃহত্তর ভারতীয় জনসমাজের মধ্যে কোনও প্রতিবাদ বা আন্দোলন দেখা যায় না। মনে হয়, এই সব ঘটনায় কারও হৃদয় আর বিচলিত হয় না। সব যেন কেমন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনাগুলো দেখে মনে হয়, সত্যিই কি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে বসবাস করছি?
সরকারের প্রশ্রয় না থাকলে এই সব যে ঘটা সম্ভব নয়, সেটা সবাই জানে। ঘটনাগুলি ভারতের উদার আকাশে যে রক্তমেঘের সঞ্চার করছে, তার পরিণতি এক দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে, সেটা কি শাসক দল বুঝতে পারছে না? ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে মূলধন করে রাজনৈতিক দলসমূহ ন্যূনতম মানবতাবোধ ও বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে যে সব কাজ করে চলেছে, তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে কালিমালিপ্ত করা ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।
স্বামী বিবেকানন্দকে অনুসরণ করে বলা যায়, যারা সাম্প্রদায়িক তারা ঈশ্বরকে ভালবাসে না, মানুষকেও ভালবাসে না। হীন রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের জন্য যাঁরা হিংস্রতাকে মদত দিচ্ছেন, তাঁরা বিজ্ঞানের আলোকিত যুগেও ভারতকে তমসাচ্ছন্ন যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেন, সেটা বোধগম্য হচ্ছে না।
রতন চক্রবর্তী
উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
জোটধর্ম
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘সেই দৃঢ় প্রত্যয় আর নেই’ (৫-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়লাম। কয়েকটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জোট সরকারের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকবেই। জোটে পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াই স্বাভাবিক, এবং এ ক্ষেত্রে নিজ দলের অ্যাজেন্ডা জোর করে চাপানো রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেন্দ্রের বর্তমান সরকার কয়েকটি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে। তা থেকে সরকারের ‘দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব রয়েছে’ বলা খুব তাড়াহুড়ো হবে বলে মনে করি। কারণ, এই সরকার এখনও ১০০ দিন সম্পূর্ণ করেনি। এই অল্প সময়ে কোনও সরকারের মূল্যায়ন করা উচিত নয়।
সম্পত্তির উপর মূলধনি করের বিষয়টি ছিল বাজেটে সরকারের একটি প্রস্তাব। সরকারের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত বাজেটে প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার অনেক উদাহরণ রয়েছে। মোদী সরকারই প্রথম বার নিজের প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছে, তা নয়। সুতরাং বাজেটে এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার থেকে সরকারের ‘দৃঢ় প্রত্যয়ের অভাব’ খোঁজা উচিত নয়। জনগণের স্বার্থে কোনও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত সরকার পুনর্বিবেচনা করতেই পারে।
প্রবন্ধকার বলেছেন, বিজেপির দুর্বলতার সুযোগে আরএসএস এই প্রথম সমন্বয় বৈঠক ডেকেছে, এবং বিজেপির সভাপতি জে পি নড্ডাকে এই বৈঠকে যোগ দিতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আরএসএস প্রতি বছরই তার পারিবারিক সংগঠনগুলির সমন্বয় বৈঠক নিয়মিত করে থাকে। এ বছরের বৈঠক নতুন নয়। তাই শুধুমাত্র বিজেপির বর্তমান স্থিতির কারণে এ বার বৈঠক হয়নি।
তা ছাড়াও প্রবন্ধকার আরএসএস-এর সর্বভারতীয় প্রধান মোহন ভাগবতের একটি বিবৃতির উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ক্ষেত্রে বিজেপি ও আরএসএস-এর মতান্তরের কথা তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, আরএসএস একটি অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সুতরাং এর কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা নেই। তাই কোনও রাজনৈতিক দলের সুবিধা-অসুবিধা অনুসারে সঙ্ঘ প্রধান কোনও মন্তব্য করেন না। সঙ্ঘ একটি নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল সংগঠন। সঙ্ঘ প্রধান যথার্থ বলেছেন, কোনও নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসনের পক্ষপাতী নয় সঙ্ঘ। বিজেপি একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল। উভয়েই নিজেদের সিদ্ধান্ত স্বতন্ত্র ভাবে নেওয়ার অধিকারী। এর মধ্যে আরএসএস-বিজেপি মতানৈক্য খুঁজে পাওয়া ঠিক নয়।
আনন্দ মোহন দাস
ভদ্রকালী, হুগলি
প্রতিবাদে পুজো
সেবন্তী ঘোষের আবেগমথিত প্রবন্ধ ‘বিষণ্ণ আগমনী’ (রবিবাসরীয়, ৮-৯) পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। বাংলা তথা বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। ভোরবেলায় শিউলিতলা ফুলে-ফুলে ঢাকা পড়ে যায়। রূপনারায়ণের পাড় বরাবর বসে কাশফুলের মেলা। কিন্তু আকাশের ঘন কালো মেঘ যেন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনের ছবি। আর বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের সকলের চোখের জল। আগমনীর বিষণ্ণতা প্রকৃতির বুকেও প্রতিফলিত। এ বছর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কারও চোখেমুখে পুজোর সেই আনন্দ ধরা পড়েনি। হাটেবাজারে, যানবাহনে এখন একটাই কথা, ‘আর জি কর’। তুষের আগুন যেমন ধিকিধিকি করে জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ এক দিন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তেমনই রাজ্যের বুকে দীর্ঘ দিন ধরে চলা অপরিসীম দুর্নীতি, অত্যাচার, অবিচার, ছলচাতুরির কথা শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে জনগণের পুঞ্জীভূত অবিশ্বাস, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আজ বিপ্লবের রূপ ধারণ করেছে। তাই একাধিক বার সমস্ত বয়সের নারী-পুরুষ রাস্তা দখল করেছেন। আর সেটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রাজ্যে, তথা দেশ ও বিদেশে।
নিহত তরুণী চিকিৎসকের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও তাঁর মৃত্যুর জন্য এক জন দায়ী না অনেক জন, এ নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা কাটেনি। যারা প্রমাণ লোপাটের জন্য অকুস্থলে নানা পরিবর্তন করেছে বলে অভিযোগ, পাশের ঘরটিও ভেঙে ফেলেছে— তারা সবাই অপরাধী। শুধু তা-ই নয়, এদের যারা মদত দিয়েছে, বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করেছে, নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, তারাও তিলোত্তমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এক জন প্রকৃত অপরাধীর সমান শাস্তি এদের প্রাপ্য। দুর্নীতিগ্রস্তদের, এবং তাদের মাথাদের চোখের ঘুম, মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ভাবতে পারা যায়, কড়া সার্কুলার জারি করেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন বন্ধ করা যায়নি? বিশেষ ভাবে সক্ষম, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যৌনকর্মী, বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা মিছিল হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ রকম আন্দোলন, রাজ্য তথা সমগ্র দেশে খুব বেশি দেখা যায়নি।
এ বছরও প্রথা মেনে দুর্গাপুজো হোক। কারণ এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু মানুষের সারা বছরের রুটি-রুজি। বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। কিন্তু জৌলুস, জাঁকজমক, হইহুল্লোড় কম হোক। সরকারি অনুদান না নিয়ে জনগণের দানে মায়ের আরাধনা হোক। প্রত্যেকটি পুজোমণ্ডপ থেকে প্রতি দিন আওয়াজ উঠুক, ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’। কেবল অহিংস প্রতিবাদই আনতে পারে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অভ্যাস মানুষকে মাথা উঁচু করতে ও মেরুদণ্ড সোজা রাখতে শেখায়।
গৌতম পতি
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর