‘কবে, কী ভাবে, প্রশ্ন সেটাই’ (২১-১১) প্রবন্ধে দেবাশিস ভট্টাচার্য ঠিকই বলেছেন, তৃণমূল ব্যক্তিনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করেই দলটি গড়ে উঠেছে। তবে তৃণমূল কংগ্রেসকে সুশৃঙ্খল দল বলা যায় না। এবং দলটি কোনও আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মমতার সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার ক্ষমতা অপরিসীম। এর মূল কারণ তাঁর লড়াকু মনোভাব এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা। ২০১১-য় বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই চেয়েছিলেন এ বার বামেদের পতন ঘটুক, রাজ্যে পরিবর্তন আসুক। মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেই রাজ্যে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু রাজ্যের মানুষ যে পরিবর্তন চেয়েছিলেন তা কি পেয়েছেন?
রাজ্যের মানুষ এক জন সৎ, নীতিনিষ্ঠ এবং আদর্শ রাজনৈতিক ব্যক্তির হাতে শাসনভার তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় জোটের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রাজ্যের ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। আর এখন তৃণমূলের বীজমন্ত্র কী? দুর্নীতি, দুরাচার, মিথ্যাচার আর পেশিশক্তির দাপট দেখিয়ে কেবলই গণতন্ত্রের হত্যা। বর্তমানে দলটির মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অস্বচ্ছ চরিত্রের লোকজনের ভিড় বেশি। সঙ্গে যাঁরা জন্মলগ্ন থেকে ছিলেন, বহু লড়াই আন্দোলন করলেন তাঁরা অনেকেই আজ ব্রাত্য। তৃণমূল কংগ্রেস ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দল বলেই এমনটা হয়েছে। তবে তৃণমূল মূলত আঞ্চলিক দল, দেশের রাজনীতিতে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদিও সম্প্রতি কালে বিরোধী জোটে মমতার নেতৃত্ব নিয়ে অনেকে আবার উৎসাহী হয়ে উঠছেন। এই পরিস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি কতটা জায়গা ছাড়বেন তা বলবে ভবিষ্যৎ।
মলয় মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১০
উল্কার বেগে
‘কবে, কী ভাবে, প্রশ্ন সেটাই’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু স্পষ্ট কথা। রাজনীতির ময়দানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেকের তুলনা হয় না। রাজনৈতিক কর্মী মমতা পরবর্তী কালে একটি দলের সুপ্রিমো, পরে প্রশাসনিক পদে মন্ত্রী থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ইন্ডিয়া জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মমতার রাজনীতি ও চরিত্র প্রায় আমূল বদলে গেলেও আসলে রাজনীতির পাঠশালায় মমতাই হলেন অভিষেকের গুরুমা। হতে পারে অভিষেক দিল্লিতে গিয়ে নিজেকে পালিশ করেছেন। তা বলে কি অভিষেক অন্য কিছু ভাবছেন? তৃণমূল বিপদে পড়লে তিনি অন্য নামে নব তৃণমূল গড়বেন? এ ইতিহাস জাতীয় কংগ্রেসের আছে ঠিকই, তবে এখনও তৃণমূল প্রসঙ্গে তা বিশ্বাস করা শক্ত।
মমতাই ভাইপো অভিষেককে জায়গা করে দিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে অভিষেকের জন্ম। ১৯৯৮-এ তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম। তখন অভিষেকের বয়স ১১। কলকাতায় নবনালন্দা হাই স্কুলে পড়েছেন। এমপি বিড়লা ফাউন্ডেশন থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হলেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করে কলকাতায় ফেরেন ২০১১-য়। কলকাতায় আসার আগে ছাত্র বা যুব রাজনীতিতে তাঁকে সে ভাবে পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের অভাবনীয় ও শোচনীয় ভাবে হারিয়ে শাসকের আসনে। অভিষেক রাজনীতিতে এলেন ২০১১-য়। সোনার চামচ মুখে দিয়ে সরাসরি ২০১২ সালে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি হলেন। ২০১৪-য় লোকসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। ২০১৪-য় সর্বভারতীয় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের জাতীয় সভাপতি, ২০২১ সালেই সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত। ভারতীয় রাজনীতিতে এত দ্রুত উত্থান ভাবা যায় না।
প্রবন্ধে ইঙ্গিত— ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দলে এ রকমই হয়ে থাকে, সর্বত্র। তা হলে কে থাকবেন? ব্যক্তি মমতা না ব্যক্তি অভিষেক? এঁদের মধ্যে ফারাক আছে না নেই? তৃণমূলের কিছু নেতা ঘোলাজলেই নেমেছেন, সাঁতারও কাটছেন, কিন্তু জল ছুঁতে চাইছেন না। তবে বিষয়টি জলের মতো সহজও নয়।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
এমনটাই হয়
রাজ্যের আগামী মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাবনা সম্পর্কিত যে কথাগুলি দেবাশিস ভট্টাচার্য তাঁর প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন, তা নেহাতই অমূলক নয়। দেখা গিয়েছে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির কর্ণধার রূপে এক জন নেতা বা নেত্রী থাকেন, তিনিই দলের সর্বেসর্বা। তাঁর কথায় দলের সমস্ত নেতা-নেত্রী ও ক্যাডাররা ওঠাবসা করেন। তাই তিনি যাঁকে যে পদে বসাতে চান বা আনতে চান তার অন্যথা হয় না। উত্তরসূরিদের দায়িত্ব দিয়ে ভবিষ্যতে তাঁর আসনে বসাতেও আগ্রহী থাকেন। কংগ্রেসের ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে আরজেডি-র লালুপ্রসাদ, সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিংহ যাদব, ডিএমকে-র করুণানিধি, এনসিপি-র শরদ পওয়াররা যদি তাঁদের ছেলে বা আত্মীয়-পরিজনদের আসন ছেড়ে দেন, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বংশপরম্পরা বা স্বজনপোষণ নীতি অনুসরণ করলে তা নিয়ে এত শোরগোল উঠছে কেন? তাই তিনি আগামী দিনে যদি তাঁর হাতে গড়া সোনার চামচ মুখে নিয়ে রাজনীতিতে আসা ভাইপো অভিষেককে তাঁর আসনে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিয়ে আসার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেন, তাতে ক্ষতি কী?
অধীর চৌধুরী রাজ্য সভাপতির পদ খোয়ানোর পর কংগ্রেস দলের নেতা বলে এখন এ রাজ্যে তেমন সুপরিচিত কে রইলেন? যিনি নিজ ক্যারিসমায় দলের মুখ হিসাবে উঠে আসবেন? বামপন্থীদের অবস্থাও তথৈবচ। সিপিএমের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রমোদ দাশগুপ্ত বা অনিল বিশ্বাসদের সমকক্ষ নেতারা কোথায়, যিনি সাংগঠনিক ভিত মজবুত করে রাজ্যে সিপিএমকে আবার চাঙ্গা করে তুলবেন? যে কয়েক জন তরুণ নেতা-নেত্রী উঠে আসছেন, তাঁরা কলকাতাটাকেই পশ্চিমবঙ্গ ভেবেছেন। সেখানেই সরকার-বিরোধী মিটিং, মিছিল, রাজপথে গান-বাজনা, কবিতা আর নাচ নিয়েই ব্যস্ত। এটাই নাকি অপশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যার মাধ্যমে গোটা বাংলার মানুষের সমস্ত রকম অভিযোগ, দুর্দশা ও সমস্যা ঘুচে যাবে! আর রাজ্যের বিজেপি গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত। বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে মমতা ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় মন দিতে পারছেন, আগামী মুখ্যমন্ত্রী-মুখ হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ভেবে রাখছেন। ফলাফল অবশ্য ভবিষ্যৎ বলবে।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
মুখ দেখেই
ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই আসলে ব্যক্তি-নির্ভর। ২০০৪ সালে ক্ষমতা হারানোর পর বিজেপির ক্ষমতায় আসতে আরও ১০ বছর লাগল কারণ তত দিন তারা নরেন্দ্র মোদীর মতো নেতা পায়নি। মোদী এই ভোটে মোদীর গ্যারান্টি, মোদী-৩ সরকার বলে প্রচার করেছিলেন। এক বারের জন্যও প্রচারে এনডিএ-৩ সরকার, বিজেপি সরকার, এনডিএ-র গ্যারান্টি, বিজেপির গ্যারান্টি বলেননি। সিপিএম ৩৪ বছর রাজত্ব করেছে অনেকটাই জ্যোতি বসুর ব্যক্তিগত ক্যারিসমার উপর নির্ভর করে। ‘জ্যোতি বাবু’র জন্যই বহু বাঙালি সিপিএমকে ভোট দিতেন। জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দিয়ে বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো জনপ্রিয় নেতাদের বহিষ্কার করে সিপিএম নিজেরই পতন ডেকে আনল।
ইন্দিরা গান্ধী বা রাজীব গান্ধীর জনআকর্ষণী ক্ষমতায় ভর দিয়ে কংগ্রেসও রাজত্ব করেছে এক সময়। নেতা বা নেত্রীর এই ব্যক্তিগত জনমোহিনী ক্ষমতার উপর নির্ভর করেই বার বার নানা দলের ভাগ্যে উত্থান-পতন চলেছে।
সপ্তর্ষি গুহ, কলকাতা-৪৭