‘আমাদের রক্ষক সেই ম্যানগ্রোভ’ (২৬-১০) শীর্ষক প্রতিবেদনটি আজকের দিনের একটি জরুরি শিক্ষা হয়ে উঠেছে। সচেতনতার এমন নিবিড় পাঠ আগামী পৃথিবীর জন্য একটি মাইলফলক এবং সতর্কবার্তাই বলা চলে। ঘূর্ণিঝড় আসার আগের দিনগুলিতে এই রাজ্য এবং ওড়িশার সাধারণ মানুষ তীব্র উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছেন। প্রশাসনও উদ্বেগে প্রহর গুনেছে। পরিবেশবিদরা জানিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃতির উপরে মানুষের অত্যাচার বাড়লে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। প্রতিবেদনটি বিজ্ঞানীদের সেই কথারই প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে। আশার কথা একটাই। এ যাত্রায় ওড়িশা এবং বাংলার সমুদ্র-উপকূল অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকটাই কম হয়েছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কল্যাণে।
উন্নয়নের নামে প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষ যখনই পদক্ষেপ করেছে, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই রাজপথ ভেসে যাচ্ছে। অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। তবু আমাদের হুঁশ ফিরছে কি? জলাভূমি ভরাট করে বিশাল ইমারত গড়ে উঠছে। ক্ষতিকারক প্লাস্টিকে ছেয়ে গেছে বাজার। যশোর রোডের ধারের বড় গাছগুলি কেটে ফেলা হচ্ছে। নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন এক শ্রেণির অসৎ লোক। ফলে লাখ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ছেন। জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। চাষি ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে চাষের কাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে চাষের জমি। অজানতেই আমরা নিজেদের খাদ্যভান্ডার শেষ করে ফেলছি। সাধারণ মানুষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে তো? এ সব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলে পরিবেশ ধ্বংস হবেই। আজ সময় এসেছে গাছ কাটা বন্ধের উদ্যোগ করার। ব্যক্তিস্বার্থে পরিবেশ ধ্বংস করলে সমষ্টি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সম্প্রতি দানা-সহ বেশ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস বুঝিয়ে দিচ্ছে অনাচারের ফলে প্রকৃতি রুষ্ট হচ্ছে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গড়পাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
রসনাপ্রিয়
দীপক দাসের ‘বাঙালি খাওয়াদাওয়ার দিনবদল’ (রবিবাসরীয়, ২০-১০) প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে সেই ছোটবেলার আনন্দঘন দিনগুলোর মধ্যে যেন হারিয়ে গেলাম। বাঙালি জাতির সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত-পালিত সেই বিশেষণটি— ‘রসনাপ্রিয় খাদ্যরসিক বাঙালি’। সেই চিত্র প্রকট হয়ে ওঠে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে দিয়েই।
যেমন, আগে দেখা যেত পুজো-পার্বণেই হোক কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠান, সর্বাগ্রে চাই ঘরে তৈরি পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে উদরপূর্তি করা এবং করানো। অর্থাৎ, লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, বোঁদে, মন্ডা-মিঠাই সহযোগে সকালবেলার খাওয়া চটজলদি সেরে ফেলার তাগিদ। এ ছবি চিরসত্য, চিরপ্রচলিত। অতীতে দেখা যেত, বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে মা-কাকিমা’সহ বাড়ির বৌ-মেয়েরা সকলে মিলে রান্নাঘরে ঢুকে অতিথি-সৎকারের জন্য রন্ধন প্রক্রিয়ায় ডুবে যেতেন। সেটা যেমন নির্ভেজাল আনন্দের, তেমনই তার মধ্যে ছিল আতিথেয়তা ও পরম তৃপ্তির ছোঁয়া। তাই অতীতে কোনও পুজো এলেই, সে দুর্গাপুজোই হোক বা লক্ষ্মীপুজো কালীপুজো-সহ ঘরোয়া যে কোনও অনুষ্ঠান, মাসাধিককাল ধরে দিনরাত এক করে চলত আয়োজন। তৈরি হত ঘি, দুধ, চিনি, ছানা, নারকেল, ময়দা, বেসন, চিঁড়ে, গুড়-সহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ঘরোয়া রকমারি মিষ্টি প্রস্তুতি-পর্ব। সেগুলি যেমন সুঘ্রাণযুক্ত, তেমন সুস্বাদু। নাড়ু, মুড়কি, গজা থেকে শুরু করে ঘরে ভিয়েনে তৈরি বোঁদে, রসগোল্লা, পান্তুয়া, লেডিকেনি, বরফি, জিলিপি-সহ হরেক রকম মিষ্টি। অম্লান বদনে সে সব মুখে পুরলেই মিষ্টি-মধুর সম্পর্কটা আরও গাঢ় হয়ে উঠত।
কিন্তু বর্তমানে সেই ট্র্যাডিশন পুরোপুরি থেকে না গেলেও শহরতলি, গ্রামগঞ্জ ও শহরে কিছু কিছু সাবেক বনেদি বাড়িতে পুজো-পার্বণে বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে আজও সেই ধারা দেখতে পাওয়া যায়। বিয়ে, উপনয়ন বা অন্নপ্রাশনের মতো অনুষ্ঠান হলে এখনও বাড়ির মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হাতে হাত লাগিয়ে, কোমরে কাপড় জড়িয়ে কাজ করেন। ও-দিকে ক’দিন ধরে বাড়ির ভিয়েনে তৈরি কুচো নিমকি, বোঁদে, মিহিদানা, রসগোল্লা, পান্তুয়া, রাজভোগ, সন্দেশ-সহ রকমারি মিষ্টিতে ছয়লাপ। বাড়ির ছোট থেকে বয়স্ক সদস্যরা, আত্মীয়স্বজনেরা ক’দিন ধরে অনবরত মুখ চালাতেন। সে সময় খেতে বসে সময় বাজি ধরে মাছ-মাংস-মিষ্টি খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলত। কোমরে গামছা বেঁধে কাঁসা-পিতলের বালতিতে বাড়ির পুরুষেরা নিমন্ত্রিত অভ্যাগতদের উদার হস্তে খাবার পরিবেশন করতেন। খেয়ে-খাইয়ে সবাই খুশি হতেন। কিন্তু এখন নতুন জমানা। বালতির জায়গায় এসেছে ট্রে-তে গুটিকতক মিষ্টি তুলে কেটারার মারফত পরিবেশন করানো। বিষয়টি সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে যে জিনিসটার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে, তা হল— আর্থিক সঙ্গতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা, আন্তরিকতা, সদিচ্ছা এবং মানসিকতার অভাব। ইদানীং শারীরিক কারণও এর সঙ্গে যুক্ত।
অবশ্য এটাও ঘটনা, আধুনিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে উত্থান ঘটেছে আধুনিক খাবারের। সেই কারণেই স্বামীজির মেজো ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত নিজের ছোটবেলায় দোকানে খাওয়া জিবেগজা, গুটকে কচুরির কথা লিখেছিলেন— “এখন সেসব জিনিস নিতান্ত প্রাচীন বলিয়া লোকে অবজ্ঞা করে।” বর্তমানে কালের নিয়মে ঘরের তৈরি নারকেলের নাড়ু বা নারকেলের তৈরি ছাপা সন্দেশের পরিবর্তে বিজ্ঞাপনের দৌলতে সশরীরে হাজির চকলেট, টিন-বন্দি মিষ্টি বা প্রসেসড ফুড। অতিথিদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ঘরোয়া রান্নার পরিবর্তে অন্দরমহলে ঢুকে গিয়েছে অনলাইনে অর্ডার দেওয়া খাবার। সেই কারণে এখন সর্বত্র তারই ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটে চলেছে। তাই প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন— সময় আমাদের শিখিয়েছে, সমকালীন খাবারদাবার খেয়ে নিতে হয় প্রাণ ভরে, না হলে তা কালের নিয়মে হারিয়ে গেলে আফসোস করতে হয়।
তবে পরিশেষে বলতেই হয়, এত কিছু সত্ত্বেও যেটার অভাব তা হল— নিজে রান্না করে অতিথি আপ্যায়ন করা। যার মধ্যে মিশে থাকা শ্রদ্ধা, ভালবাসা, অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও পরিতৃপ্তির যে ছোঁয়া ছিল, এখন তার অনুপস্থিতিটাই চোখ টানে।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নবদ্বীপ, নদিয়া
শ্যামাপোকা
শ্যামাপুজো এলেই চোখে পড়ে রাশি রাশি শ্যামাপোকা। কোথাও এর নাম কালীপোকা। কেউ বলে হৈমন্তী পোকা। শ্যামাপোকা দেখতে ফ্যাকাসে হলুদ সবুজ। ডানায় থাকে কালো দাগ। যুগ যুগ ধরেই এই পোকাদের দেখা যায়। আসলে এরা আলোর দিকে ধেয়ে আসে। শ্যামাপুজো বা দীপাবলি যে-হেতু আলোর উৎসব, তাই এদের বেশি আনাগোনা। বাংলায় এই পোকাকে তাই দীপাবলির বাহক-ও বলা হয়ে থাকে। বাংলা ছাড়াও সব ধান উৎপাদক রাজ্যেই এদের দেখাপাওয়া যায়।
শ্যামাপোকা ধান গাছের রস খেয়ে ক্ষতি করে। এরা আবার এক রকম রোগের বাহকও বটে, যে রোগে ধানগাছের পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়। গাছ শুকিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। শুধু তা-ই নয়, গাছের বৃদ্ধি বাধা পায়। তার ফলে কমে যায় ধানের উৎপাদন। প্রশ্ন উঠেছে, যে পোকা এত ক্ষতি করে সেই পোকা বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? আবার এটাও ঠিক, প্রকৃতিতে জীববৈচিত্রের ভারসাম্যে সব পতঙ্গের ভূমিকা থাকে। তবে এই পোকা নিজের দোষেই মরে যায়। যে-হেতু আলোর দিকে ধেয়ে আসে, তাই আলোর তাপে পুড়ে শেষ। তা ছাড়া কম বৃষ্টি, খামখেয়ালি আবহাওয়া ও জমিতে যথেষ্ট কীটনাশকের ব্যবহারে কমে যায় শ্যামাপোকা।
আমরা যারা প্রকৃতিপ্রেমী, চাইব না শ্যামাপোকা হারিয়ে যাক। প্রকৃতিতে কম হলেও বেঁচে থাকুক শ্যামাপোকা। অন্য দিকে, ধানগাছও থাকুক সুস্থ। বাড়ুক ধানের ফলন। কৃষকের মুখে ফুটুক স্বস্তির হাসি।
দীপংকর মান্না, চাকপোতা, হাওড়া