উৎপল সিংহের ‘পরাধীন দেশে গড়ে তুললেন স্বদেশি বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র’ (রবিবাসরীয়, ৩-৪) শীর্ষক প্রবন্ধসূত্রে কিছু কথা। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন প্রবল জ্ঞানানুরাগী ব্যক্তি, নব্যবঙ্গের শিক্ষাগুরু। ভারতে সুশৃঙ্খল প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎও ছিলেন তিনি। বিচক্ষণতা ও প্রতিভার গুণে তিনি শহরের নামকরা চিকিৎসকও হয়েছিলেন। এমডি উপাধিপ্রাপ্ত অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক ডা. সরকার এক সময় হোমিয়োপ্যাথিকেও বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেন। রাজেন্দ্রলাল দত্ত ছাড়াও তাঁর এই কাজে বিশেষ সহায় হন লোকনাথ মৈত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেই সঙ্গে ছিল তাঁর অদম্য জেদ, নির্ভীকতা ও সত্যপ্রিয়তা। তাঁর সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছিলেন— “বঙ্গদেশকে যত লোক লোকচক্ষে উঁচু করিয়া তুলিয়াছেন, এবং শিক্ষিত বাঙ্গালীগণের মনে মনুষ্যত্বের আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপিত করিয়াছেন, তাহাদের মধ্যে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি।” (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ)।
ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার চিকিৎসার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এর জন্য আজীবন টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। অধ্যাপকের অপ্রতুলতায় ক্ষোভও প্রকাশ করেছিলেন। এ সবের মধ্যেই তিনি কুষ্ঠরোগীদের জন্য বৈদ্যনাথে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘আশ্রয়-বাটিকা’ তৈরি করেন। প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মাঝেও স্বনামধন্য এই চিকিৎসক কী এক অমোঘ টানে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের কাছে প্রায়ই চলে আসতেন। তাঁর চোখে রামকৃষ্ণদেব ছিলেন অসাধারণ গুণবিশিষ্ট, জ্ঞানী মানুষ, যাঁর কথায় তিনি আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। মহেন্দ্রলাল তাঁর এই বিশেষ রোগীটিকে বলতেন— “তোমার সত্যানুরাগের জন্যই তোমায় এত ভাল লাগে। তুমি যেটা সত্য বলিয়া বুঝ, তার একচুল এ দিক ও দিক করে চলতে পার না। অন্যস্থানে দেখি, তারা বলে এক, করে এক। ঐটে আমি আদৌ সহ্য করতে পারি না।” আর ঠাকুরও লোক চিনেছিলেন।
সুদেব মাল
খরসরাই, হুগলি
সুসম্পর্ক
উৎপল সিংহ তাঁর প্রবন্ধে সে যুগের দুই মহান পুরুষ তথা ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রীর সুসম্পর্কের নজির তুলে ধরেছেন। বয়সে চোদ্দো বছরের কনিষ্ঠ ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী।
মহেন্দ্রলাল সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রীর উচ্চ ধারণা কিন্তু এক দিনে হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে মহেন্দ্রলালের চরিত্রের অনেক সত্যাসত্য যাচাই করে তবে শিবনাথ এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। শিবনাথ তখন সবে একুশে পা দিয়েছেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছেলে। বাবার বন্ধুতার সূত্রে বিখ্যাত এক উকিলের বাড়িতে থাকেন। কলেজে পড়েন। সেই উকিলবাবুর ডাক্তার হলেন মহেন্দ্রলাল।
উকিলবাবুকে দেখতে সে দিন তাঁর বাড়িতে এসেছেন মহেন্দ্রলাল। উকিলবাবু শিবনাথেরও চিকিৎসা করতে মহেন্দ্রলালকে অনুরোধ করেন। শিবনাথকে তাঁর অসুখের বৃত্তান্ত লিখে ডাক্তারবাবু তাঁর কাছে পাঠাতে বললেন। ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবু যখন উকিলবাবুর জন্য ওষুধ লিখছিলেন, তখন উকিলবাবুর ভাই এটা ওটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন— কী ওষুধ দিলেন? কেন দিলেন ইত্যাদি। অসন্তুষ্ট ডাক্তারবাবু বলে ওঠেন, “এমন আহম্মুকি করেন কেন? কী ওষুধ দিচ্ছি— আপনার জানার বিষয় কি? তা হলে আমাকে বিরক্ত করা কেন?”
ডাক্তারের এই রূঢ় ব্যবহারে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিবনাথ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। কারণ শিবনাথের কাছে উকিলবাবুর ভাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। পরের দিন শিবনাথ রোগের কেস-হিস্ট্রি ইংরেজিতে লিখলেন এবং অন্য একটা পত্র লিখলেন বাংলাতে। উকিলবাবুর ভাইয়ের প্রতি রুক্ষ ব্যবহারের জন্য ডাক্তারবাবুকে তিরস্কারে পূর্ণ ছিল বাংলা চিঠিটা। পত্র পাঠানোর পর শিবনাথের দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কাজটা কি ঠিক হল? মহেন্দ্রলাল লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। উকিলবাবুর কাছের মানুষ। শিবনাথ গ্রামের ছেলে। গরিব। উকিলবাবু বার করে দিলে তিনি কোথায় দাঁড়াবেন?
পরের দিন মহেন্দ্রলাল এসে হাজির। অথচ, আসার তো কথা নয়। খবর পেয়ে শিবনাথ ত্রস্ত হয়ে কুঁকড়ে গেলেন। এসেই ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “শিবনাথ ছেলেটা এ বাড়ির কে?” অন্যরা বিষয়টা হালকা করার অভিপ্রায়ে বললেন, ও এক পাগল ছেলে! মহেন্দ্রলাল বললেন, “ও রকম পাগল ছেলে যেন ঘরে ঘরে জন্মায়।” শঙ্কিত শিবনাথকে দেখেই ডাক্তারবাবু তাঁকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন দুটো চিঠির জন্য। তাঁর ইংরেজি ও বাংলা লেখার শব্দচয়নের খুব প্রশংসা করলেন। এর পর বোঝালেন কোনও মানুষের অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক কৌতূহল কোনও ব্যস্ত মানুষের যেন বিরক্তির কারণ না হয়। এতে সেই মানুষটির কাজে ভুল হতে পারে। তাতে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
প্রবীর চক্রবর্তী
জয়নগর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
অন্য ঘরানা
আমার শিক্ষিকা উমা দাশগুপ্তের লেখা মাস্টারমশাই অমলেশ ত্রিপাঠীর উপর প্রবন্ধটি (‘আমাদের মাস্টারমশাই’, ২-৪) একটি বিদ্যাবংশের স্মারক। ১৯৬৫-৬৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমি অধ্যাপক ত্রিপাঠী মহাশয়ের ছাত্র ছিলাম। পরে ১৯৭৭-৯০ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার নিজের গবেষণার অবেক্ষক অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য। মাস্টারমশাই সব্যসাচীর গবেষণার অবেক্ষক স্বয়ং অমলেশ ত্রিপাঠী, সে দিক থেকেও বিদ্যাবংশের দ্বিতীয় থাকের লোক আমি।
মাস্টারমশাই অমলেশ ত্রিপাঠীর শিক্ষণশৈলী নিজ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সব শিল্পের মতো শিক্ষণশিল্পেও ঘরানার তফাত আছে, সে দিনের প্রেসিডেন্সি কলেজে অশীন দাশগুপ্ত, দিলীপকুমার বিশ্বাস বা অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো শিক্ষকদের পড়ানোর ঘরানার পার্থক্য আমাদের মতো ‘অনপড়’ ছাত্রদের কানেও ধরা পড়ত। কলেজে পড়ার প্রথম বছরে তিন মাস ধরে অমলেশবাবু ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চার বিবর্তন পড়িয়েছিলেন, ইয়ুং, দ্য তকভেলি থেকে তেন, মিশেলে ওলার্দ, মাতিয়ে ও লেফেব্রে ধরে রাজনীতি ও সমাজচিন্তার পরিসরে কী ভাবে ইতিহাসচর্চার ঝোঁকে প্রতিসরণ ঘটে যাচ্ছে, তারই অনুপম বিবরণ সদ্য কলেজে ঢোকা ছাত্রছাত্রীদের কাছে বলে যাচ্ছেন। ইতিহাসবিদ্যা চর্চার বিবর্তনের প্রেক্ষিতেই ঐতিহাসিক প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, এই ধারণা বালখিল্যদের মনে গেঁথে যেতে দেরি হয়নি। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় বর্ষে অমলেশবাবু ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়াতেন, রাজা-রানি আর পার্লামেন্টের ইতিহাসের বাইরে গিয়ে তুলে ধরতেন বাইবেলের অনুবাদ বা জিশুর শেষ ভোজের তাৎপর্য নিয়ে নানা গোষ্ঠীর বিতর্ক। নিখাদ বাংলা স্কুলের ছাত্র, খুব ভাল বুঝতাম না, এক দিন সাহসভরে এই বিষয়টি পড়ানোর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্নও করেছিলাম। মাস্টারমশাই জবাব দিয়েছিলেন, ধর্মতত্ত্বের মূল বিসংবাদ না জানা থাকলে, ধর্মান্দোলন ও লোক মানসিকতা বোঝা যাবে না। পড়ানোর ঘরানাটাই তো আলাদা, পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ানোর সঙ্গে এই গোত্রের শিক্ষণের সম্পর্ক নেই।
পড়াতেন ইউরোপের ইতিহাস, সুবিধা বুঝলেই তুলনা দিতেন স্বদেশ কথার, নিদর্শনগুলি বেশির ভাগ সাহিত্যের। ফরাসি দরবারি অভিজাতরা অমিতব্যয়ী, কোনও সদুপদেশই তাদের কানে ঢুকছে না। এই অপরিণামদর্শী মানসিকতা বোঝাতে স্যর দেবী চৌধুরানীর হরবল্লভ রায়ের জবানি উল্লেখ করেছিলেন, মা লক্ষ্মীকে তাঁর মতো লোকেরা বলত, মা, তোমায় ছাড়িলাম, চাল ছাড়িতে পারি না। মনে আছে, সে দিন ক্লাসে নোট নেওয়া কলমগুলি মুহূর্তের জন্য থমকে যায়।
কোনও এক সূত্রে রিচার্ড কব-এর সদ্যপ্রকাশিত দ্য পুলিশ অ্যান্ড দ্য পিপল আমার কাছে এসেছিল। দুর্দান্ত পড়ুয়া মাস্টারমশাই বইটা পড়ার জন্য আমার কাছ থেকে নিলেন। ফেরত দেওয়ার সময় জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি বইটা পড়েছ?” বরাবর দুর্বিনীত ছাত্র আমি। বললাম, আপনি কি পড়তে মানা করছেন? নিমেষে স্যরের চোখ জ্বলে উঠেছিল, বললেন, “আমি কোনও দিন কাউকে কোনও বই পড়তে মানা করি না। তবে বই পড়ার সঙ্গে নম্বর পাওয়া ও সাফল্যের কোনও যোগ নেই। দুটো গুলিয়ে ফেলো না। নিজের খুশিতে বই পড়বে, ব্যস।” মাস্টারমশাইয়ের বিদ্যাবংশের তুচ্ছ অংশী আমি, কত কাল আগে শোনা স্যরের বজ্রবাণীটা আমার মতো বুড়োর কানে আজও বাজে।
গৌতম ভদ্র
কলকাতা-৩২