নতুন হোক পুজো, নতুন হই আমরাও
ছেলেটাকে একটু বোঝান না, স্যর?
—কেন কি হয়েছে?
—সেই আপনাকে বলেছিলাম না, সারাদিন শুধু ফোনেই ব্যস্ত! কী আবার একটা খেলা হয়েছে, সেটাই খেলছে সারাদিন! রাত-দিন জ্ঞান নেই! খেতে ডাকলেও বিরক্তি! আপনি বললেই শুনবে।
স্যর, মানে ওই অভিভাবকের অষ্টম শ্রেণির ছেলের কলেজপড়ুয়া শিক্ষক বললেন, ‘‘আচ্ছা দেখছি।’’ দিনকুড়ি পর থেকে অভিভাবক দেখলেন, ছেলের যেন ফোনাসক্তি কিছুটা হলেও কমেছে। ফোনে স্যারকে ধরলেন অভিভাবক— ‘‘দেখলেন, আপনার কথা শুনেছে। তবে ক’দিন পর।’’ ‘‘হ্যাঁ, এই সেদিনই ওর সঙ্গে কথা বলেছি।’’ বলে ফোন রাখলেন স্যর। আর যেটা বললেন না, তা হল, তাঁর নিজেরও ওই খেলা বা মোবাইলের প্রতি আসক্তি কোনও অংশে কম ছিল না। ছাত্রকে বারণ করলেই সে যে শুনবে, এ তিনিও জানতেন। কিন্তু কোথাও যেন বাধছিল। তাই নিজেকে শুধরে, দিনকুড়ি ফোন কম ব্যবহার করে ওকে বলেছেন তিনি।
হয়তো একটা কাল্পনিক গল্প। হয়তো নয়। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন কথাও নয়। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’— এই লাইনটি যতবার পরীক্ষার খাতায় লিখে নম্বর পাওয়া গিয়েছে, তার অর্ধেক সময়ও কি মরমে পশিয়াছে? মিম আর স্টেটাসে জ্ঞান বিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া উপচে ফেলা আমরা সেই জ্ঞানের কতটা নিজেরা মেনে চলতে পেরেছি? খুঁচিয়ে কুকুরছানা মেরে ফেলা হোক বা গর্ভবতী হাতিকে হত্যার ঘটনা— যে ভাবে গর্জে উঠেছি (বেশিটাই অবশ্য ভার্চুয়াল), তার কতটা আদৌ মনে দাগ কেটেছে? তার কতটার সত্যিকারের কোনও প্রভাব আমাদের প্রতিদিনের জীবনে পড়েছে? পাখি দেখলে ঢিল ছোড়াটা বাদ যায়নি, এখনও কুকুরের লেজে পটকা বাঁধা হচ্ছে ফি-বছর। লক্ষ টাকার মণ্ডপের পাশে অভুক্ত মা তাঁর শিশুকে নিয়ে বসে থেকেছেন। আমরা পাশ কাটিয়েছি।
বলা হয়, শিশু তার পরিবার আর পারিপার্শ্বিক সমাজের প্রতিফলন। যে ভাবে সে কথা বলে, যে ভাবে চিন্তা করে বা যা কাজ করে, সবটাই আসলে তার আশপাশের আয়না। কোনও শিশু তাই যখন জেনে যায়, কোনটা তার আর কোনটা তার নয়, বিভেদের বিষবৃক্ষের প্রথম বীজটি অজান্তেই বুনে ফেলি আমরা। সে বুঝে যায়, বেড়ার ওপারটা অন্য কারও। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ না দেখলে প্লাস্টিকের প্যাকেট বা পচা পেয়ারাটা ওদিকে ফেলে দেওয়া যায়। কখন যে এই ‘দেওয়া যায়’টা ‘দিতে হয়’ হয়ে যায়, আমরা নিজেরাও টের পাই না। আর ক্ষমতা পেলে তো পোয়া বারো। সেটা করতে গিয়ে আর দ্বিতীয় বার ভাবতে হয় না। তাই রাস্তার মাঝে পড়ে থাকা পাথর সরাতে তার পা সরে না বা পথের ধারে পড়ে থাকা অসুস্থকে সাহায্য করতেও তার আর ইচ্ছা হয় না। ওগুলো তো আলাদা, অন্য, অন্যের, ওই পাথরে হোঁচট খেয়ে কেউ পড়ে যেতে পারেন বা ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা— কিন্ত তা তো ‘অন্য’ কারও, তাতে আমার কী!
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ভাঙন শুরু হয় সমাজে, নিজের জীবনে, যেটা চলে আজীবন। মূল্য চোকায় সে, তার পরিবার, তার প্রতিবেশ, আর প্রত্যেকের ভাল থাকা। কারণ, সে নিজের ‘আমি’কে সবার চেয়ে আলাদা মনে করলেও আমরা তো একই গাছের শাখা-প্রশাখা। তাই অন্য জায়গায় ঘুণ ধরলে, আগুন লাগলে, সেই আঁচ থেকে কেউ বাঁচে না, বাঁচতে পারে না। অশিক্ষিত আমরা নিজের ঘরের আসবাব, জিনিসপত্র সামলাতে গিয়ে ভুলে যাই, বাড়িটাই আসলে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, ভাঙতে শুরু করেছে। কিন্তু তখনও ঘর সাজানোর কাজটা চলতেই থাকে।
আর এই সমাজ থেকেই উঠে আসেন ভবিষ্যতের নাগরিক আর ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারক। একজন তাঁর বিচারবোধ দিয়ে নির্বাচন করেন, অপরজন নির্বাচিত হন। কিন্তু যে বিচারবোধের কথা হচ্ছে, তা তৈরিতে আমরা, মানে আজকের যে সমাজকে দেখে আমাদেরই ভবিষ্যৎ শিখবে, তা কতটা তৎপর, বা বলা ভাল, সে জ্ঞানটুকু আমাদের কতখানি হয়েছে, তা নিয়ে শুধু নিষ্ফল প্রশ্ন উঠতে থাকে।
উৎসবের লগ্ন উপস্থিত। তার আগে এসেছে করোনা। নভেল করোনাভাইরাস ঘাঁটি গেড়েছে চার দিকে, চওড়া হয়েছে মানুষের মধ্যেকার দেওয়াল। নিউ-নর্মালের পুজোও তাই অন্য রকম। মিলনের উৎসবেও এ বার দূরত্ব। হাতের মেহেন্দি ঢাকবে দস্তানায়, পুজোর পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে জুতো-জামার সঙ্গে মনে করে কিনতে হচ্ছে পছন্দমতো মাস্ক। বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে বলা আমরাই ছোটদের বাইরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করছি। পাশের বাড়ির খেলার সঙ্গী আজ অনেক দূরে। পাড়ার গলিতে ছোটাছুটি সীমাবদ্ধ থাকছে অনলাইন খেলার ব্যাটেলগ্রাউন্ডে। এ সময় যখন বড়রাও অভ্যস্ত হতে অসুবিধায় পড়ছেন, তখন বেড়ে ওঠার সময়ে এই হঠাৎ পরিবর্তন ছোটদের কোথায় নিয়ে যাবে, তাও জানি না। আবার করোনাই দেখিয়েছে, পুজোর বাজেট বাড়ন্ত হলেও সহযোগিতার ডিঙার ভরসায় সমস্যার সাগর পাড়ি দেওয়া যায়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে লক্ষাধিক জনঘনত্ব নিয়েও মু্ম্বইয়ের ধারাভি করোনামুক্ত হয়ে উঠতে পারে।
দুর্গোৎসব সমাগত। আলোর বেণু বাজছে। ঢাকে উঠছে ঘট ভরতে যাওয়ার বোল। আমরা আবার উৎসব করব, আনন্দ করব। আর পুজো মানেই তো নতুন পোশাক, ঘরে নতুন রং, নতুন আসবাব, ঘর সাফ করা। মানে, সব ধুলো-ময়লা সরিয়ে নতুনের সূচনা। কিন্তু আমরা নিজেরা? আমাদের ভিতরের সেই ‘আমি’টা? সেটা পরিষ্কার হবে তো? নিজের তিনতলা বাড়িতে শিক্ষার আলো জ্বেলে পাশের কুঁড়েঘরের অন্ধকার দেখতে পাব তো? ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে সব সময় বড় বড় দোকানে না ঢুকে পাশের ঠ্যালাগাড়ি থেকে দু’টো আইসক্রিম কিনব তো? সবচেয়ে বড় কথা, দূরে থেকেও মন থেকে কাছাকাছি-পাশাপাশি থাকতে পারব তো?
পুজোয় সব নতুন, সব। আমরাও তো একটু নতুন হতে পারি। একটু চেষ্টা করলেই পারি। তার চমক অবশ্যই চোখে পড়বে না। যেমন, অরুণ বীণার সুর আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু চিন্ময়ীর আগমনে সে সুর বেজে ওঠে। প্রাণে তার স্পর্শ পাওয়া যায়। এ বারের পুজোও হোক তেমনই প্রাণের পুজো। সেই উৎসবের সুর মনের আস্তর ছুঁয়ে যাক আমাদের। জগতের আনন্দযজ্ঞে সামিল হই সবাই আমরা। সবাই মিলে।