বিরোধীকে বলতে দেওয়া চাই

ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার দমনে মোদীতন্ত্রের তান্ত্রিকরা কী পরিমাণ তৎপর, সেটা এখন আর অজানা নয়। তাঁদের কথা অনেক হয়েছে, হচ্ছে, আরও অনেক হবে, হওয়া দরকার।

Advertisement

চিরদীপ উপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

বিরোধীকে বলতে দাও। ১৯৮৯ সালে গানটি লিখেছিলেন সুমন। তখন সুমন চট্টোপাধ্যায়। (সঙ্গের ছবিতে) বিরোধীর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, ইতিহাস সেটা বার বার প্রমাণ করেছে। নানা দেশে, নানা পরিস্থিতিতে। যেমন এই মুহূর্তে ভারতে। যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারে এবং দেশের এক বিস্তীর্ণ ও ক্রমশ বেড়ে-চলা ভূখণ্ডে রাজ্য সরকারে ক্ষমতাসীন, তাঁদের স্ব-ভাবে বিরোধী মত শোনার অভ্যেস কম, যে কোনও বিষয়ে বিপরীত কথা শুনলেই তাঁদের ক্রোধ জেগে ওঠে, ক্ষমতার অস্ত্র— অনেক সময় আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র— হাতে নিয়ে সেই ক্রোধ বিরুদ্ধ মতের অনুগামীদের দমন করতে তৎপর হয়। এই অসহিষ্ণুতা নিয়ে এত কথা হয়েছে যে, তার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কেবল এই অতি-সাম্প্রতিক ঘটনাটুকুই লক্ষ করতে পারি যে, দেশের সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন কর্তাব্যক্তিরা অনেকে মিলে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অবস্থা কোথায় পৌঁছলে ভূতপূর্ব সেনানায়কদের গণতান্ত্রিক সহনশীলতার কথা বলতে হয়, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহকর্মীরা সেটা এক বার ভেবে দেখতে পারেন।

Advertisement

ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার দমনে মোদীতন্ত্রের তান্ত্রিকরা কী পরিমাণ তৎপর, সেটা এখন আর অজানা নয়। তাঁদের কথা অনেক হয়েছে, হচ্ছে, আরও অনেক হবে, হওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যাটা কেবল তাঁদের নিয়ে নয়। বিরোধীকে বলতে না দেওয়ার স্বভাব আমাদের দেশে অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতার বিরোধিতায় সরব ও সক্রিয়, তাঁরাও সচরাচর ভিন্ন মত শুনতে আগ্রহী নন। এই কথাটা ভাবতে গিয়ে আবার মনে পড়ল সুমনের ওই গানটির কথা। নব্বইয়ের দশকে তাঁর অনুষ্ঠানে তাঁর মুখেই জেনেছি, রোজা লুক্সেমবুর্গকে স্মরণ করে তিনি বেঁধেছিলেন এই গান। বামপন্থী আন্দোলনের বিকল্প পথ সন্ধান করতে গিয়ে, সেই বিকল্প পথে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে, নিজেদের বামপন্থী বলে অভিহিত করা ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের হাতেই ১৯১৯ সালের জার্মানিতে নিহত হয়েছিলেন রোজা লুক্সেমবুর্গ, যেমন তার পরবর্তী দশকগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে ও তথাকথিত সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতে ক্ষমতাসীন ‘কমিউনিস্ট’দের আক্রমণে নিহত হবেন বহু মানুষ। এই কারণেই তাঁর মৃত্যু খুব তাৎপর্যপূর্ণ, তা দেখিয়ে দেয়— প্রতিবাদের রাজনীতিতে সওয়ার হয়ে যারা ক্ষমতায় আসে, তারাও প্রতিবাদী স্বরকে দমন করতে চায়, বিরোধীকে বলতে দেওয়ার স্বাধীনতা তারাও দিতে নারাজ। এই ব্যাধি কেবল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ রাজনীতির নয়।

গত কয়েক বছরে এ দেশে ধর্মাশ্রিত সংখ্যাগুরুবাদের প্রবল দাপট। সেই দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা সংগত কারণেই সরব হয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্বের কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন নাগরিক সমাজকে, রাজনীতির কারবারিদের। কিন্তু এ কথাটাও খেয়াল না করলে ভুল হবে যে, তাঁদের প্রতিবাদী স্বরের যথেষ্ট জোর নেই। বিশেষ করে, সেই স্বর নাগরিক সমাজের সীমিত চৌহদ্দির বাইরে, বৃহত্তর ভারতে খুব একটা পৌঁছচ্ছে না, পৌঁছলেও কোনও সাড়া তুলছে না। আর হিন্দুত্ববাদীরা সেই সুযোগেই আরও বেশি করে নিজেদের কথাগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, কেন আমাদের দেশের উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা বৃহত্তর জনসমাজের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সচরাচর এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় তাঁদের সামাজিক দূরত্বের বাস্তবে। সেটা অযৌক্তিক নয়— তাঁরা সত্য সত্যই আমজনতা থেকে অনেক দূরে, কেবল জীবনযাপনের দৈনন্দিনতায় দূরে নয়, মানসিকতাতেও দূরে। ঘটনা হল, তাঁদের কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না, নিজেদের জীবন ও ভাবনার সঙ্গে সেই কেতাবি ধর্মনিরপেক্ষতা বা উদার গণতন্ত্রের বুলিকে মেলাতে পারেন না। এই দূরত্ব ঘোটানোর চেষ্টা নিশ্চয়ই করা দরকার।

Advertisement

কিন্তু সমস্যাটা নিছক দূরত্বের নয়। সমস্যা ভিন্ন মত না শোনারও। আমরা, যারা উদার গণতন্ত্রের কথা বলি, তারাও ভিন্ন মত মন দিয়ে শুনতে রাজি নই। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যাঁরা প্রশ্ন করেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা নারাজ। অথচ মনে রাখতে হবে, ধর্ম এবং রাজনীতিকে পরস্পর থেকে দূরে রাখার যে পশ্চিমি ধারণা আমাদের নাগরিক সমাজে স্বীকৃত হয়েছে, কিংবা সমস্ত ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের সমভাব পোষণের যে নীতি আমাদের দেশে গৃহীত হয়েছে, তার বাইরেও ধর্ম বিষয়ে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে নানা মত থাকতে পারে। সেই মত আমরা মানি বা না মানি, তার সঙ্গে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, আমাদের জনজীবনে এবং চিরাচরিত রাজনীতির পরিসরে ধর্মের খুব বড় ভূমিকা ছিল এবং আছে। তাকে বাদ দিয়ে চলতে গেলে সমাজের বিরাট অংশকে বাদ দিয়ে চলতে হয়। সেটা গণতন্ত্রের স্বধর্মের বিরোধী। এই ধর্মচ্যুতিই আমাদের ক্ষতি করেছে, ক্ষতি করে চলেছে। আর তার ফসল তুলছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারিরা।

তাই বিরোধীকে বলতে দাও— এই কথাটা খুব মূল্যবান। সব বিরোধীকে বলতে দেওয়া দরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement