মঞ্জুলিকা সেনগুপ্ত। নিজস্ব চিত্র
১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি কল্যাণপুরে আসি। আসানসোল শহরের উত্তরপ্রান্তে এই উপনগরীটি তখনও যথেষ্ট বাসভূমি হয়ে ওঠেনি। আড়াই হাজার ছোট ছোট বাড়ি ঘিরে একটু করে জমি। কয়েকটি মাত্র পরিবার আর পাশ দিয়ে একটি ভারি সুন্দর স্রোতস্বিনী। কিন্তু চারিধারে কেবল বাড়ি বাড়ি। অচেনা লোক। কী করি! আলাপ হল দুই প্রতিবেশিনীর সঙ্গে, ৪০ বছর দীর্ঘ এক বন্ধুত্বের সেই শুরু। পরিচিতি, ঘনিষ্ঠতার পরিধি ছড়াল একটু একটু করে। কিন্তু মঞ্জুলিকা সেনগুপ্ত এক ভিন্ন উৎস হয়েই রয়ে গিয়েছিল। দু’মাসের মাথায়, মার্চে কল্যাণপুরে বসন্ত উৎসব করলাম আমরা। তার আগে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রতিটি সন্ধ্যা পূর্ণ হয়ে রইল সম্মেলক বসন্তগানের সুরে। পাড়ার প্রায় অপরিচিত বাচ্চাদের নাচ, পাড়াসুদ্ধ সর্বজনের গানের তালিম চলছিল। গানের অক্লান্ত কাণ্ডারি মঞ্জু। সারা দিনের অফিস থেকে ফিরেই হারমোনিয়ামে, রাত ন’টা। না-শোনা, একটু কম পরিচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত, নিজের ইচ্ছেমতো পছন্দমতো তালিকা তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছি ততদিনে ‘মঞ্জু’ হয়ে ওঠা শিল্পীর কাছে। আর সে মৃদু হেসে এক এক বার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকভঙ্গিতে বলছে, ‘‘...এই গানটা? কিন্তু এটা যে শুনিনি কোনও দিন!’’ ‘‘...তা হলে কী হবে? ভারি সুন্দর কিন্তু...’’ এটুকুই যথেষ্ট, মঞ্জু বলবে, ‘‘দাঁড়াও দেখি!’’ আর দেখেও ফেলবে ঠিক। সেই ইউটিউব বিহীন দিনে স্বরবিতান থেকে হারমোনিয়ামে তুলে নিয়ে কেবল নিজে গাইবে না, অন্যদের শিখিয়েও নেবে। দোলের পরদিন থেকে রিহার্সাল শেষ হল বটে কিন্তু সুরের এক নিরালা প্রস্রবণ যেন বয়ে যেতে শুরু করল আমাদের এই ছোট থেকে বড় হয়ে উঠতে থাকা জনপদে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের ছাড়িয়ে মঞ্জুর সুর-সংসারের বৃত্ত বেড়েছে বছরের পর বছর।
ধীরে ধীরে জেনেছি, আমাদের কাছে নতুন হলেও এই শিল্পশহরে মঞ্জুলিকা বহুদিন ধরে ছিলেন পরিচিত আর সমাদৃত নাম। শহরে বা তার বাইরের অনেক সম্মান, অনেক সভা-সম্মেলনে গাইবার আমন্ত্রণ, প্রাপ্ত সংবর্ধনা— কখনও মঞ্জুলিকার কাছে কোনও আলাদা গুরুত্ব পায়নি। সেগুলিকে সে রেখেছে এক পাশে, মৃদু হাসির মধ্যে প্রচ্ছন্ন করেই। যেমন ছিল তার ম্যাজিক দেখানো। এমন প্রায় নির্বাক ম্যাজিশিয়ানের কাজে মুগ্ধ হওয়াও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পীর চেয়েও বেশি মনে হয় ছিল তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্ররচনার সম্পর্ক। গানগুলিকে সে পাঠ করত, ভালবাসত, বসিয়ে নিত তাদের নিজের ভিতরে। তাই মঞ্জু যখন গান শিখিয়েছে কাউকে, সেই গান যেন মূর্তি ধরে আবির্ভূত হয়েছে শ্রোতার সামনে। নাচ শেখানোর কাজ সহজ হয়ে যেত যেই গানের বাণীগুলি বেজে উঠত। স্পষ্ট প্রকাশ হত তার অর্থ।
রবীন্দ্রনাথের গান যে মানুষদের কাছে কেবল গানের চেয়ে অনেক বেশি, জীবনচর্যার ভূমি হয়ে ওঠে, মঞ্জুলিকা ছিল সেই মানুষদের এক জন। এক সময়ে যখন তাঁকে মেনে নিতে হল শারীরিক যন্ত্রণার অসহনীয় বন্দিদশা, সেই কাতর দিনকালেও কোনও দিন অপ্রসন্নতা দেখা দেয়নি তাঁর মুখে। বছরের পর বছর চলেছিল আমাদের বসন্ত-উৎসব, ভোরের গানের বৈতালিকে মঞ্জুই তো কেন্দ্রবিন্দু। মৃদু তাঁর স্বর, কিন্তু তাঁকেই জড়িয়ে যেন ডালপালা মেলে দিত স্বর আর সুরের উজ্জ্বল ফুলগুলি। কত বার কী শারীরিক কষ্ট নিয়ে সেই বৈতালিকে হেঁটেছে সে। বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদের নীচে বসা সন্ধ্যার আসর যখন বন্ধ হয়ে গেল, মঞ্জুলিকা তাকে তুলে নিল নিজের ছাদে। বছরে দু’বার তিন বার যে সব অনুষ্ঠান তখন এই অঞ্চলে হতে পারত, তাতে একটু তফাতে থাকা কল্যাণপুর সহজেই গুরুত্বের ঠাঁই করে নিয়েছিল আসানসোলের বৃহত্তর পরিধিতে। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব ছিল মঞ্জুর। অফিসের দায়িত্ব, আর্থারাইটিসের ক্রমশ পঙ্গু করে দেওয়া শারীরিক যন্ত্রণা আর মনের কষ্ট, সংসার— সব ক’টি ঘাটেই নিজেকে বিছিয়ে রাখছিল সে। তবু সবচেয়ে গভীর খেয়া বাইছিল বোধহয় সেই শিশু-কিশোর চিত্তগুলিতে যারা তাঁর কাছ থেকে গান নিতে আসত। সুরের বোধকে হৃদয়ে বসিয়ে নিয়ে ফিরত তারা। এক প্রজন্ম পার করে দ্বিতীয় প্রজন্মের কাছেও একই রকম নির্ভরের আশ্রয় হয়ে আছে তাদের পাওয়া সেই গানগুলির ব্যঞ্জনা। গানের চেয়ে অনেক বেশি করে যা জীবনের এক রকম পথনির্দেশ।
আসানসোল শহরের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের থেকে একবিংশের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যে অধ্যায়, সেখানে মঞ্জুলিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী আসন তো রইলই, তার সঙ্গে সুবিস্তৃত, সুগন্ধময় নিভৃত আসন রইল কল্যাণপুর হাউজিং থেকে জীবন শুরু করা অন্তত দশ হাজার মানুষের মনের মধ্যে। তাঁর মৃদু কিন্তু আশ্চর্য মধুর কন্ঠ ছিল যেন শিশিরপাতের শব্দের মত- ‘শব্দময়ী অপ্সররমণী গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি’। সেই মঞ্জুলিকা ছেড়ে গেল মাত্র কয়েক দিন আগে, ৩০ এপ্রিল।
খুব অসময়ে আমাদের ছেড়ে হিমালয়ের দূরদুর্গম পথের থেকে চলে গিয়েছিল আমাদের আরে এক সুরকন্যা, মঞ্জুর জুড়ি মাধবী, সেও ছিল এক কিন্নরী। সে বড় দূরে ছিল, তাই আমরা তাঁকে দেখতেও পাইনি। মঞ্জু ছিল আমাদের ঘরের কাছেই। তবু সময় বাদী হল। এমন সর্বপ্রিয় মানুষীকে ভাল করে দেখতে পেল না তাঁর অসংখ্য মানস-সন্তানেরা, তাঁর গুণমুগ্ধেরা। ভাল করে বিদায় জানানোরও অবসর হল না।