ঘটনার ঘাতে প্রতিঘাতে একটি কথা সমানেই পিছনে চলিয়া যায়, কিন্তু তাহা ভুলিলে চলিবে না। দিল্লির নবগঠিত নাগরিক ফোরাম কথাটি আবার মনে করাইয়া দিল। যে সকল সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদীকে সম্প্রতি দিল্লির হত্যাকাণ্ডের জন্য অন্যায় ভাবে অভিযুক্ত করা হইয়াছে, তাহাদের বিষয়ে তদন্তের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ হইতে সক্রিয় সহায়তা দরকার— ফোরামের বক্তব্য। সুপ্রিম কোর্টের কিছু প্রাক্তন বিচারপতি-সহ বহু মান্যগণ্য মানুষের এই ফোরামের বক্তব্যই মনে করাইয়া দেয়, ভারত দেশটি কোথায় পৌঁছাইয়াছে। দেশের বিশিষ্ট চিন্তাশীল নাগরিকরা রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর আশা হারাইয়া ফেলিয়াছেন, রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতার মুখের দিকে না তাকাইয়া সরাসরি মানুষের দরবারে আবেদন পাঠাইতেছেন। সংখ্যালঘু প্রশ্নে যে শাসক নেতৃত্ব কোনও সঙ্গত পদক্ষেপ করিতে পারেন, সেই ভরসা ত্যাগ করিয়াছেন। মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতিরাও সিস্টেম বা ব্যবস্থার বদলে জনসমাজের উপর সরাসরি নির্ভর করিতে বাধ্য হইতেছেন। ভারতবর্ষের সেই ১৯৪৭-এর মধ্যযামিনী-স্বপ্ন আজ চুরমার। সে এখন তাহার উদার গণতান্ত্রিক বহুসংস্কৃতি-সম্পন্ন সত্তাটি ত্যাগ করিয়া নব-অবতারে আবির্ভূত হইতে ব্যস্ত।
স্পষ্টতই, সংস্কৃতি-সম্পন্ন কথাটির মধ্যে লুকাইয়া আছে ‘সম্পদ’-এর ভাবনা। যে দেশের মধ্যে বহু সমাজ পাশাপাশি বাস করে, বহু সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে আপনা-আপনিই সংযোগ খুঁজিয়া লয়, বিপদে-আপদে পরস্পরের উপর নির্ভর করে, অথচ নিজ স্বকীয়তা কখনও ত্যাগ করে না, সে যখন রাজনৈতিক প্রণোদনায় একত্বের মরীচিকার পিছনে ছোটে, সে আসলে নিজের সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদটিকেই ত্যাগ করিতে চাহে। ভারত কেবল বিবিধ জাতি ও ধর্মের যুদ্ধভূমি নহে। তাহার ইতিহাস ও ভূগোল জুড়িয়া আছে বিবিধতার সম্পদ এবং সমন্বয়: কথাটি পুরাতন হইয়াছে বলিয়াই মিথ্যা হইয়া যায় নাই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকেও আজ বিশেষ ভাবে মনে রাখিতে হইবে তাহার এই ‘সম্পন্ন’ ঐতিহ্যের কথা, কেননা এই রাজ্যে আগামী নির্বাচনের দুন্দুভি বাজিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে তাহার নানা সম্প্রদায়ের মিলিত সামাজিক বুনটটি যেন ত্রাসে কাঁপিতে শুরু করিয়াছে। স্বাভাবিক: বিজেপির রাজনৈতিক নেতারা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন, এই সামাজিক বুনটটি তাঁহাদের কতখানি অপছন্দ, ইহাকে চূর্ণ করিতে তাঁহারা কতখানি ব্যগ্র।
বাংলার এই ত্রস্ত সমাজকে যে কোনও প্রকারে রক্ষা করিবার ভাবনাটি বিশেষ করিয়া উদ্দীপিত করিবার দিন আজ: কেননা আজ বাংলার এক বিশিষ্ট নেতার জন্মের সার্ধশতবর্ষ, যিনি এই সামাজিক ‘সম্পন্নতা’র ভাবনাটিকে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় লইয়া গিয়াছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কেবল বাঙালির সর্বকালের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য নহেন, এই প্রদেশের হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত সমাজের সুরক্ষা ছিল তাঁহার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক প্রকল্প। মহাত্মা গাঁধীর পাশে দাঁড়াইয়া তিনি অসামান্য নেতৃত্ব-দক্ষতায় বাংলা প্রদেশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে লইয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার অকালপ্রয়াণে ভারতে বাঙালির নেতৃত্ব-স্বপ্ন বিপর্যস্ত হইয়াছিল। কিন্তু ওই নেতৃত্ব-স্বপ্ন সে দিন সম্ভব মনে হইয়াছিল এই জন্যই যে দেশবন্ধু হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির যৌথ উত্তরণ পরিকল্পনা করিয়াছিলেন, পারস্পরিক সহযোগিতা যে উত্তরণের একমাত্র পথ, তাহা বুঝিয়াছিলেন। দুই ধর্মসম্প্রদায়ের সামাজিক সহযোগিতার সহিত তাহাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার নিবিড় সংযোগটি উপলব্ধি করিয়া তিনি প্রশাসনিক সংস্কারে উদ্যত হইয়াছিলেন। বাঙালি দেশবন্ধুর নামটি উদ্যাপন করিয়াছে, আরও করিবে: কিন্তু তাঁহার রাজনৈতিক মত ও পথ হদয়ঙ্গম করিয়াছে কি না, নিকট ভবিষ্যৎই সে কথা বুঝাইয়া দিবে। যদি করিয়া থাকে, তবে ভারতের বিনষ্ট স্বপ্নটির মেরামতির কাজে নেতৃত্ব দিতে হয়তো আগাইয়া আসিতে পারে পশ্চিমবঙ্গই।